পোশাকশিল্পে বৈচিত্র্যকরণের গুরুত্ব ও আমাদের রপ্তানি খাত
সৈয়দ মনসুর হাশিম : বেশ কিছুদিন ধরেই বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের (আরএমজি) পণ্যের পোর্টফোলিওকে বৈচিত্র্যময় করার জন্য দ্ব্যর্থহীন পরামর্শ দিয়ে আসছেন। চীন ও ভিয়েতনামের মতো এর প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো তাদের পোশাক রপ্তানির ঝুড়িকে গুরুত্ব সহকারে বৈচিত্র্যময় করার প্রচেষ্টা নিয়েছে, যেখানে বাংলাদেশ এখনও উদাসীন রয়েছে। এমনকি ভারত ও ইন্দোনেশিয়াও ‘বৈচিত্র্য’-এর শ্রেণীতে পড়ে। যদিও বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়ে এক ধাপ উপরে তাও এটি খুব কমই কোনো ভালো পরিণতি বয়ে আনে। কারণ বৈশ্বিক পোশাক বাণিজ্যে বাংলাদেশ দুই নম্বরে রয়েছে ও বৈচিত্র্যকরণ শুরু করার সময় এসেছে। তাই যতো দ্রুত শুরু করা যায় ততো ভালো। মার্কিন বাজারের একটি আভাস বাংলাদেশের আরএমজির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তুলা পণ্যের উপর রপ্তানিকারক দেশের অপ্রতিরোধ্য নির্ভরতা প্রকাশ করে।
সম্প্রতি একটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন অনুসারে, সরকারি তথ্য দেখায় ‘গত অর্থবছরে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশের বেশি এসেছে টি-শার্ট, ট্রাউজার, শার্ট, সোয়েটার ও অন্তর্বাসের মতো মৌলিক আইটেমগুলো পশ্চিমা বাজারে পাঠানো থেকে। স্থানীয় পোশাক নির্মাতারা স্বীকার করে যে বৈচিত্র্য রাতারাতি ঘটে না। এর জন্য বিনিয়োগ, অবকাঠামোগত সহায়তা, সামঞ্জস্যপূর্ণ শক্তি, কাঁচামাল সরবরাহ ও অবশ্যই সময় প্রয়োজন।’ এগুলো ড. শেং লু, যিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডেলাওয়্যার ইউনিভার্সিটির ফ্যাশন অ্যান্ড অ্যাপারেল স্টাডিজ বিভাগের একজন সহযোগী অধ্যাপক ও স্নাতক স্টাডিজের পরিচালক; তার স্টাডজ আমাদের জানায় যে চীন তার গ্রাহকদের অফার করে পোশাক শৈলীর বিস্তৃত নির্বাচনের কারণে প্রাথমিকভাবে এক নম্বর রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে রয়ে গেছে।
ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে, এটা স্পষ্ট যে মার্কিন নীতিনির্ধারকেরা চীন থেকে দূরে থাকা পোশাকের সোর্সিংকে বৈচিত্র্যময় করতে আগ্রহী। ভিয়েতনাম ও ভারতের মতো কিছু দেশ সেই পাইয়ের একটি অংশ নেওয়ার জন্য উন্মুখ। ভিয়েতনাম বাংলাদেশের চেয়ে ভালোভাবে সজ্জিত গেমটিতে পা রাখছে কারণ এটি (ক্রেতার দৃষ্টিকোণ থেকে) বাছাই করার জন্য পণ্যের একটি বিস্তৃত নির্বাচন দিতে পারে যার মধ্যে রয়েছে বাইরের পোশাক, আন্ডার গার্মেন্টস ও সাঁতারের পোশাক। ভারত পোশাকের ক্ষেত্রে ভালো করছে যেখানে বাংলাদেশ এখনও মৌলিক নিটওয়্যার আইটেমের জন্য একটি প্রধান ক্রেতা গন্তব্য। বেসিক অর্থাৎ বাংলাদেশ এমন আইটেম উৎপাদনে খুব ভালো যেগুলোর দামও কম। পোশাক শিল্প সমিতি, বিজিএমইএ যে ক্ষেত্রগুলোকে খতিয়ে দেখছে তার মধ্যে একটি হলো মূল্য সংযোজন পণ্য। বিশেষ করে নন-কটন সামগ্রী যার মধ্যে পলিয়েস্টার ও ম্যানমেড ফাইবার (এমএমএফ) রয়েছে। এটি তুলা থেকে দূরে সরে যাওয়ার একটি প্রচেষ্টা। ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য শিল্পে মৌলিক কিছু পরিবর্তন প্রয়োজন। এমএমএফ-এর কাছে তুলা-ভিত্তিক পোশাকের উপর অতিরিক্ত নির্ভরতা থেকে দূরে সরে যাওয়া।
‘বিয়ন্ড কটন: এ স্ট্র্যাটেজিক ব্লুপ্রিন্ট ফর ফাইবার ডাইভারসিফিকেশন ইন বাংলাদেশ অ্যাপারেল ইন্ডাস্ট্রি’ শীর্ষক সম্প্রতি উন্মোচিত বিজিএমইএ স্টাডজে, বৈশ্বিক পোশাকের বাজারে বাংলাদেশের জন্য নন-কটন টেক্সটাইল ও পোশাকের ফাইবার বৈচিতত্র্যকরণের সম্ভাবনা অন্বেষণ করা হয়েছে। ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বৈশ্বিক বাণিজ্য (তুলা ও নন-কটন) ১.০ শতাংশ থেকে সামান্য বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রকৃতপক্ষে উলের ফাইবার, সুতা ও কাপড়ের বাণিজ্য গত পাঁচ বছরে উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। যখন একই সময়ের মধ্যে এক্রাইলিক কাপড় রপ্তানি ২০১৮ সাল থেকে বেড়েছে। স্টাডজ প্রকাশ করে চীন, ভিয়েতনাম, ইতালি ও স্পেনের নন-কটন পোশাক রপ্তানি সেই বিশেষ পোশাক রপ্তানির দৃশ্যে আধিপত্য বিস্তার করেছে যেখানে এটি মোট রপ্তানির ৫০ শতাংশেরও বেশি। ‘বিশ্বব্যাপী দ্রুত বর্ধনশীল নন-কটন ক্যাটাগরি, জার্সি ও পুলওভার অফ ম্যান-মেড ফাইবারস (এমএমএফ) পথ দেখায় ও মহিলাদের পোশাকের বিভাগগুলো (বাহ্যিক পোশাক, পোশাক ও ট্রাউজারগুলো তালিকায় প্রাধান্য পায়।’ তাহলে, বাংলাদেশ কী করবে? এটি উৎপাদনে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ও আন্তর্জাতিক বাজারের বর্তমান বাজারের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এমএমএফ ও নন-কটন সেগমেন্টে এর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে সক্ষম হতে কিছু সমস্যা রয়ে গেছে। অভাবের চ্যালেঞ্জ রয়েছে, প্রযুক্তিগত জনশক্তি, আমদানি করা কাঁচামালের উপর সামগ্রিক নির্ভরতা, উচ্চ উৎপাদন ব্যয় ও উল্লেখযোগ্য মূলধন ব্যয়ের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
শিল্পটি যা খুঁজছে তা হলো নীতি স্তরে এটির সম্মুখীন হওয়া সমস্যাগুলোর বৃহত্তর বোঝা। বিনিয়োগের পুঁজি-নিবিড় প্রকৃতির জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দ্বারা চার্জ করা উচ্চ সুদের হার ও আরও তুলা-কেন্দ্রিক সরকারি নীতিগুলোর পুনর্বিবেচনা প্রয়োজন। বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটগুলোর একটি বিশাল চাহিদা রয়েছে যা বাংলাদেশি শ্রমিকদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা ও অবশ্যই ধারাবাহিক বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রাপ্যতাকে মোকাবেলা করতে অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারে। বৈচিত্র্যকরণ যাদুকরীভাবে ঘটবে না। এর জন্য একটি সক্ষম পরিবেশ প্রয়োজন যেখানে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীরা কেবলমাত্র টপ-ডাউন পদ্ধতি অবলম্বন করার পরিবর্তে সমাধান খুঁজতে শিল্পের সঙ্গে কাজ করে। এগুলো গুরুতর সমস্যা। যেহেতু আরএমজি বার্ষিক রপ্তানিতে শীর্ষ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী হিসেবে রয়ে গেছে, তাই বাংলাদেশকে বৈশ্বিক পোশাক বাণিজ্যে একটি প্রভাবশালী খেলোয়াড় হিসেবে থাকতে হলে এই সমস্যাগুলো মোকাবেলা করতে হবে।
সধহংঁৎ.ঃযবভরহধহপরধষবীঢ়ৎবংং@মসধরষ.পড়স অনুবাদ : জান্নাতুল ফেরদৌস। সূত্র : দি ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস