টাকা খরচ করলে সামগ্রিক অর্থনীতির চাকা ঘোরে!
কাজী এম. মুর্শেদ
টাকাপয়সার সংকট, সেটা ব্যক্তির জন্য যেমন প্রযোজ্য, ব্যাংকগুলোর আর্থিক তারল্যেও প্রযোজ্য। আমার ধারণা, কিছু লোকের হাতে যেমন অঢেল অর্থ আছে, তেমনি কিছু সরকারি সুবিধাভোগীÑ কারা সেটা জানেন, তাঁরাও ভালো আছেন। এর বাইরেও আরো অনেক মানুষের হাতে অর্থ আছে। সেই অর্থ ব্যাংকে নেই, হয়তো বালিশ কম্বলের মধ্যে আছে। কারণ একটা দুইটা না, বেশ কয়েকটা। প্রধান সম্ভবত আমানতকারীরা যখন দেখে তার টাকা ব্যাংকে জমা আছে, সেই টাকা চিহ্নিত ঋণখেলাপিরা নিচ্ছে, যা হয় ফেরত দেয় না বা বিদেশে পাচার করে বা পুনঃতফসিল করে সময় বাড়িয়ে নেয়, তখন ভরসা হারায়। ব্যাংকে রাখলে যদি ৭ শতাংশ সুদ পায়, যা ১০ শতাংশ মূল্যস্ফীতির সাথে সংযোজন করার পরও টাকার মূল্য ৩ শতাংশ কমে, সেখানে ঘরে রেখে দিলেও ১০ শতাংশ হারালেও অন্তত টাকা মার যায় না।
ইনফ্যাক্ট কারো টাকা মার যায় না, পুরোটাই সরকার ছাপিয়ে পূরণ করে দেয়, কিন্তু ঋণখেলাপিদের হাতে যাবার চেয়ে নিজ হাতে থাকা ভালো। ফলাফল ব্যাংকের লিক্যুইডিটি বা তারল্য সংকট হয়, যা পূরণ করতে টাকা ছাপানো। গত বছর ৩৮৪ কোটি টাকা খরচ হয়েছে শুধু টাকা ছাপাতে। সরকারের সংস্থাগুলো না পারছে বাজারমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে, না পারছে সিন্ডিকেট ভাঙতে। অবশ্য সিন্ডিকেটে হাত দেওয়ার তেমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার অবস্থায় আছে কিনা, সেটা আরেক প্রশ্ন। ডলার সংকটের সঠিক তথ্য জনগণ পায় না। আমদানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ক্যাপিটাল মেশিনারি ছাড়া উৎপাদন ব্যহত হয়ে রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। রেমিটেন্স এখনো হুন্ডির ভূত থেকে বের হতে পারেনি।
দ্রব্যমূল্যের দাম উঠানামা করছে। সরকার মাত্র কয়টা পদক্ষেপ নিলেই সেটা সামলানো সম্ভব। কিন্তু সরকারে অর্থনীতি বোঝা লোকের সংকট খুব বেশি। জ্বালানি সমস্যা এখন যেমন বিশাল আকার নিয়েছে, তেমনি ক্যাপাসিটি চার্জ আরেক সমস্যা। আমদানি করা বিদ্যুতের জন্য বিশাল মূল্য দিতে হচ্ছে। একের পর এক অপ্রয়োজনীয় মেগা প্রজেক্টের চাপ বৈদেশিক ঋণে পরছে, জনগণকে সুদসহ মেটাতে হয়। তার আবার যেসব শর্তে নেওয়া তার কোনোটাই প্রফেশনাল লোকেরা করে না। সাদা হাতীর মতো বাজেট যেখানে ২৩ শতাংশের মতো ঘাটতি বাজেট, সেই টাকা কীভাবে আসবে কেউ জানে না। যা অভ্যন্তরীণ আয় ধরা হয়েছিলো, ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা, তার মধ্যে সিপিডি বলছে ৮২ হাজার কোটি আসার সম্ভাবনা নেই।
সরকারি কর্মচারী ও প্রশাসন সবচেয়ে নিরাপদে আছে, বিশাল খরচের এই বহরে জনগণ সেবা কিভাবে নেয় জানা নেই। কারো সাথে কথা বলতে গেলে পূর্ব পরিচিত ছাড়া যেতেও পারবেন না, তারা সমস্ত ক্ষেত্রে আইন দ্বারা ধরা ছোঁয়ার বাইরে। এই বিসিএস ক্যাডার তুলে বয়স বাদ দিয়ে সাবজেক্ট ম্যাটার স্পেশালিস্ট দরকার। স্বাস্থ্যখাত নাজুক অবস্থায়, শিক্ষাখাতে যেসব পরিবর্তন কোনোটাই আন্তর্জাতিক মানের নয়। ফলাফল হয় চিকিৎসায় বিদেশ যাওয়া বা শিক্ষা খাতে মেধাপাচার। সরকারের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা দুইটা, তৈরি পোশাক রপ্তানি নির্ভরতা কমাতে ব্যর্থ এবং চাকরির সুযোগ তৈরিতে ব্যর্থ। সবকিছুর চাপ এসে পরে অর্থনীতিতে, যার ফলাফল জনগণকে ভোগ করতে হয়। আর কতো সময় লাগবে কিছু মেধাবী ব্যক্তিকে দিয়ে একটা টেকসই পরিকল্পনা করতে, সেটা পরিষ্কার নয়।
আগে বলেছিলাম খরচ কমাতে, আজ উল্টো বলি খরচ বাড়াতে। ধরেন আপনি ১০০ টাকা আয় করলেন, ৯০ টাকা খরচ করে ১০ টাকা জমালেন। এই ৯০ টাকা যিনি পাবেন তিনি ৮১ টাকা খরচ করে ৯ টাকা জমালেন। ৮১ টাকার মালিক ৯ টাকা জমিয়ে ৭২ টাকা খরচ করলেন। ৭২ টাকার মালিক ৬৩ টাকা খরচ করে ৯ টাকা জমালেন। এবার হিসাব করেন, টাকা রোটেশন বা পাঁচবার হাতঘোরার জন্য ১০০ টাকা মোট অর্থনীতিতে অবদান রেখেছে ৪০৬ টাকার এবং জমা হয়েছে ৩৭ টাকা। টাকা হাত বদল হলে অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখে, সেটা বালিশে ভরে রাখলে হয় না। আবার ব্যাংকে রাখলেও একই কাজ হয়, কিন্তু বেগমপাড়ায় গেলে হয় না। এই টাকা পাচার আর দুর্নীতি রোধ না করা গেলে অর্থনীতিতে যতো বজ্র আটুনি দেন, কোনো লাভ নেই। জনগণের ভরসা আদায় করা দরকার, অতো বছরেও হয়নি।
একটা গল্প দিয়ে শেষ করি। এক বিদেশি লোক অপরিচিত এক এলাকায় গেছেন, এক হোটেলে উঠলেন। হোটেল ম্যানেজার বললেন, দুই হাজার টাকা এডভান্স জিতে হবে। উনি দিয়ে বললেন, রুম কেমন দেখি। রুমে যেতেই হোটেল মালিক দৌড়ে গেলেন বাজারে, যার কাছ থেকে সদাই করে, তাকে দুই হাজার দিয়ে বললেন, তুমি আমার কাছে দুই হাজার পেতে, নাও শোধ করলাম। দোকানি দৌড়ে মাংস বিক্রেতার কাছে গিয়ে বললেন, তুমি দুই হাজার পেতে, এই নাও টাকা শোধ। মাংস বিক্রেতা দৌড়ে ব্যাংকে গেলেন। বললেন, আমার ইন্সটলমেন্টের টাকা দিলাম। ব্যাংকার দৌড়ে এলাকার দেহপসারিনীর কাছে গেলেন। বললেন, তুমি আমার কাছে দুই হাজার টাকা পেতে, এই নাও। দেহপসারিনী দৌড়ে হোটেল মালিককের কাছে গেলেন। বললেন, আপনার হোটেলে কাস্টমার নিয়ে রাত কাটাতে যে বাকি ছিলো, এই নেন দুই হাজার টাকা, টাকা শোধ।
যেই বিদেশি এসেছিলেন, তিনি রুম দেখে পছন্দ করেননি, নিচে নেমে এসে বললেন, আমার টাকা ফেরত দিন। এই ছারপোকার বিছানায় থাকবো না। হোটেল মালিক সেই দুই হাজার টাকা ফেরত দিলেন। একই দুই হাজার টাকা কয় হাত বদলালো চিন্তা করেন, ব্যক্তির কোনো খরচ হয়নি, মাঝে হোটেল মালিক, দোকানি, মাংস বিক্রেতা, ব্যাংকার ও দেহপসারিনী সবার ঋণ শোধ হয়ে গেছে। ঠিক এই কারণে বলি টাকা খরচ করলে সামগ্রিক অর্থনীতির চাকা ঘোরে। বালিশে রাখলে বা বেগমপাড়ায় দিলে টাকা হাত ঘোরে না, মূল্যমান বাড়ে না।
লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক