শেয়ারবাজার কি আবারও অনিশ্চিত যাত্রায়? কারা খেলছে বাজারে?
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
দেশের শেয়ারবাজার কি আরও একবার অনিশ্চিত গন্তব্যের পথে যাত্রা করছে? সাম্প্রতিক সময়ের বেশকিছু ঘটনায় তাই মনে হচ্ছে। আমরা যদি পেছনে ফিরে তাকাই ১৯৯৭ বা ২০১০ পুঁজিবাজারে দুই দুইবার বড় ধরনের কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। মুখ থুবড়ে পড়েছিলো, অনেক চেষ্টা করেও উঠানো যায়নি। তবে একপ্রকার চলছিলো বলা যায়। তবে এখন মনে হচ্ছে সেই আগের পরিস্থিতিই মোকাবেলা করতে হচ্ছে শেয়ারবাজারকে। ধারাবাহিক দরপতন ঘটছে পুঁজিবাজারে। দৈনন্দিন লেনদেনে অংশ নেয়া কোম্পানির প্রতিটি শেয়ারের পরতির দিকে। সাম্প্রতিক প্রায় প্রতিটি সপ্তাহে এ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। আমার আশপাশের পরিচিত অনেকেই শেয়ার বাজারের পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলে তারা খুবই চিন্তিত। আরেকটি বিষয় দাম পরলেও বাজারে বিক্রির চাপ অস্বাভাবিকভাবেই বেড়ে যাচ্ছে এবং কেউ কেউ দর হারানোর আশঙ্কায় দ্রুত করে দর বিক্রি করে দিচ্ছে একে প্যানিক সেলিংও বলা যেতে পারে। অনেকের দর মার্জিন ঋণের বাধ্যবাধকতায় থাকায় তারা ফোর্স সেলের মুখে পরছে। তাছাড়া বাজারে ক্রেতাশূণ্যতা বেড়েছে। ক্রেতাশূন্য বাজারে বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ার হুঁ হুঁ করে কমে যাচ্ছে।
একপ্রকার অস্তিত্ব সংকট চলছে শেয়ারবাজারে। এটা মূলত তারল্য সংকট বা তারল্য ঘাটতির কারণে ঘটছে। তারল্য সংকট কেটে গেলে বা তারল্য প্রবাহ বাড়লে শেয়ারবাজারে একপ্রকার চাঙ্গা ভাব আসবে। কিন্তু সেটার জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। আমরা সেখানেও ঘাটতি দেখতে পাচ্ছি নিয়ণন্ত্রক সংস্থা বড় বড় বিনিয়োগকারী বলেন সবাই শুধু পর্যবেক্ষণ করছে কিন্তু বাজারে তারল্য প্রবাহ বাড়াতে সক্রিয় হচ্ছে না। মানুষ নতুন ব্যাংকে যাচ্ছে কারণ, ব্যাংক সঞ্চয় পত্রের চাইতেও বেশি সুদ দিচ্ছে ১১ শতাংশ হারে এফডিআর দিচ্ছে সেখানে শেয়ারবাজার তাকে কিছুই দিচ্ছে না। বাজারে সার্পোট দেবার মতো আইসিবি আছে। কিন্তু তাদের কাছে সীমিত নগদ টাকা থাকায় তারা সর্মথন জানাতে পারছে না। ফলে বাস্তবতা হলো বিনিয়োগকরীরা ফোর্স সেলের মুখে পরে যাচ্ছে।
বাজারে কোনো বিনিয়োগ না থাকায় বাজারে ক্রেতা নেই, তাই কেউ শেয়ার কিনতে পারছে না। শেয়ারবাজারের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারে আর্থিক খাত। অর্থাৎ ব্যাংক, লিজিং কোম্পানি, ইন্স্যুরেন্সগুলো। কিন্তু তারা সেভাবে ভূমিকা রাখতে পারছে না কারণ, তারাও সংকটের মুখে আছে। বাংলাদেশের বাজারে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো ভালো মৌল ভিক্তি সম্পন্ন কোম্পানি নেই এমনকি নতুন করে আসছেও না। আইপিউতে জালিয়াতি আছে, অত্যন্ত নিম্নমানের কোম্পানিগুলোকে আইপিউ ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে, অথবা নিয়ে আসা হয়েছে। ক্ষমতাবান ও বিত্তশালীরা রিপ্লেসম্যান্টের মতো কাজ করে থাকে।
বর্তমান সময়ে শেয়ারবাজারে মৌল ভিক্তি সম্পন্ন কোম্পানির বিরাট ঘাটতি রয়েছে এর বড় কারণ হলো, আস্থা সংকট। মানুষ মনে করে না যে, পর্দার আড়ালে শেয়ার বাজার নিয়ে আগে যেমন মানুষ খেলা চলতো এখনো খেলছে। ক্ষমতা কাঠামোর ভিতর থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করছে। আরেকটি বড় দিক হলো দৈনন্দিন লেনদেন সূচক অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাচ্ছে, অথবা কমে যাচ্ছে এ ধারাবাহিকতা অব্যহত থাকার কারণে শেয়ারবাজার ক্রমশ অস্থিতিশীল হয়ে পরছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা প্রতিনিয়ত মূলধন কমে যাচ্ছে এমনকি ক্রেতাশূন্য হয়ে যাচ্ছে শেয়ারবাজার। আস্থার মান তলানিতে নেমে গেছে। দিশাহীন বিনিয়োগকারীরা ২০২৪ সালে ২০১০ সালের পরিস্থিতি স্মরণ করছে। দীর্ঘ সময় পুঁজিবাজারে নিয়ন্ত্রক সংস্থা, সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ বিভিন্ন সময়ে আইনি ও প্রসাশনিকভাবে বাজারের উন্নয়নের স্বার্থে পর্যবেক্ষন করেছে। কিন্তু বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। এমনকি সঠিক সময়ে সঠিক উদ্যোগ না নেওয়ার ফলে আস্থা ও বিনিয়োগকারী হারিয়ে ফেলেছে।
শেয়ারবাজারকে অনকেই দৈনিক উপার্জনের মাধ্যম বলে মনে করেন, অথবা মনে করেন ১০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে মাসিক ১ লাখ টাকা আয় করে সংসার চালানোর যে প্রবণতা এ ধরণের চিন্তা থেকে দেশের মানুষ বেরিয়ে বাসতে পারেনি। অনেকেই মেনে নিতে চান না যে, শেয়ারবাজারে ফিক্সড আয় হতে পারে না। বাজারে বেশ বড় বড় প্লেয়ার থাকে, তাই অল্প টাকা নিয়ে বেকার তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো বেশি বিপদে পরে। বাজারে ভালো কোম্পানি তৈরি না হলে ভালো পরিবেশ আসে না এবং ভালো কোম্পানির নামে যে হতদরিদ্র কোম্পানি , প্রতিষ্ঠানকে বাজারে তালিকাভুক্ত করে একটা অবস্থানে নিয়ে গেছেন উচ্চপদের কর্মকর্তরাই। সম্প্রতি আমরা দেখেছি যে, হঠাৎ করেই ফ্লোর প্রাইস সীমা তুলে দেওয়া হয়েছিলো, এর ফলে লাভ হয়েছে যে, ভালো কিছু কোম্পানিকে ঘোষিত লভ্যাংশ না দেওয়ার কারণে তাদের জেড ক্যাটাগরিতে চিহ্নিত করায় বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পরেছে। অবশ্যই ভালো কোম্পানিকে লভ্যাংশ দিতে হবে। কিন্তু হঠাৎ এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ফলে মার্কেটে জেড ক্যাটাগরির সংখ্যা বেড়ে গেলো এবং ঘন ঘন অস্থিরতার আরেকটি কারণ হলো, গুজব। পুঁজিবাজারে যারা বিনিয়োগ করতে আসে তারা এসব গুজব কীভাবে মোকাবেলা করবেন বাজারকে কীভাবে দেখবেন এবং এটা একটা ডেইলি ট্রেনিং সেন্টার নয় বিনিয়োগের জায়গা চিন্তা না করে যদি আসেন তাহলে পুঁজিবাজারে তার জায়গা থাকবে না। অন্যদিকে যারা ম্যানুপুলেট করছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে সর্বদা তাদের জন্য সজাগ থাকতে হবে এবং নিয়ন্ত্রণ করতে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে তা না হলে শেয়ারবাজার কোনোদিন স্থিতিশীল হবে না। পরিচিতি: সিনিয়র সাংবাদিক। সৈয়দ ইশতিয়াক রেজার ফেসবুক পেজের ভিডিও কনটেন্ট থেকে শ্রুতিলিখন করেছেন রুদ্রাক্ষী আকরাম