আন্তর্জাতিক বাজারে যথেষ্ট চাহিদা সত্ত্বেও কাঁচা পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি কমার যৌক্তিকতা আছে কি?
এবি সিদ্দিক
আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচা পাট ও পাটজাত পণ্যের যথেষ্ট চাহিদা থাকা সত্ত্বেও এখাতে রপ্তানি আয় কমছে। চলতি অর্থবছরে ৮মাসে এখাতে রপ্তানি কমেছে ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ। গত অর্থবছরে এই সময়ে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কমেছিল ৪ দশমিক ৬৪ শতাংশ। সবচেয়ে কমছে কাঁচাপাট রপ্তানি। চলতি অর্থবছরে ৮ মাসে কমেছে ৩৭ দশমিক ৩৩ শতাংশ যা গত অর্থবছরে একই সময়ে কমেছিল ২৩ দশমিক ৪৩ শতাংশ। প্রতিবছরই পাট ও পাটজাত দ্রব্য রপ্তানি কমছে। অথচ আন্তার্জাতিক বাজারে যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। প্রতিবেশি ভারত থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্যে, এমন মার্কিন বাজারেও রয়েছে বাংলাদেশি পাট ও পাটজাত পণ্যের চাহিদা।
পাটকে একসময় বলা হতো সোনালী আঁশ। প্রধান অর্থকরি ফসল ছিল পাট। যার ফলে এদেশে গড়ে উঠেছিল পাট শিল্প। ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে সরকার দেশের বিভিন্ন খাতের সব শিল্প-কারখানা জাতীয়করণ করা হয়েছিল। এ শিল্পের অবাঙালি মালিকানার মিলগুলোর ব্যবস্থাপনার দায়িত্বভার গ্রহণ করতে হবে, কারণ তারা বর্তমানে বিদেশি। কিন্তু প্রজাতন্ত্রের সংবিধানে সন্নিবেশিত সমাজতন্ত্রের নামে জাতীয়করণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সকল জাতীয়করণকৃত মিলগুলোর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব বিভিন্ন কর্পোরেশন বা সংস্থাকে দেয়া হয় এবং বাংলাদেশ জুট মিলস কর্পোরেশনকে (বিজেএমসি) পাটকলগুলোর পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয়। কর্পোরেশনের প্রধান হবেন একজন চেয়ারম্যান এবং তাঁর পদমর্যাদা হবে সরকারের একজন সচিবের পদমর্যাদার সমান। বিজেএমসি ধীরে ধীরে কাঁচা পাট ক্রয়, বিক্রয়, অর্থ যোগান, নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব গ্রহণ করে। আর্থিকভাবে টাকার অবমূল্যায়ন শতকরা ৬৬ ভাগ হওয়ার কারণে ১৯৭৫-৭৬ সাল থেকে ১৯৭৮-৭৯ সাল পর্যন্ত বিজেএমসি-র আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৬০ কোটি ১৯ লাখ টাকা। পরিচালনার ক্ষেত্রে ক্ষতির মূল কারণ ছিল কাঁচাপাটের মূল্য বৃদ্ধি, গুদামজাতকরণের বর্ধিত ব্যয়, খুচরা যন্ত্রাংশের উচ্চমূল্য, মজুরি ও বেতন বৃদ্ধি এবং অবাধ ও অনিয়ন্ত্রিত দুর্নীতি।
১৯৭৫ সালে সরকার পরিবর্তনের পর পাটশিল্পের সমস্যার পর্যালোচনার জন্য বিশেষজ্ঞ বা দক্ষ কমিটি নিয়োগ দেয়া হয়। কমিটি এর পর্যালোচনায় উল্লেখ করে যে, মিলগুলোর ক্ষতির কারণ হলো: (ক) কর্মকর্তা ও শ্রমিকদের নৈতিক অবক্ষয়; (খ) প্রশাসনের সর্বস্তরে অপর্যাপ্ত তত্ত্বাববধান ও তদারকি; (গ) উদ্ধুদ্ধকরণ ও প্রণোদনার পূর্ণ অনুপস্থিতি এবং একত্ববোধের অভাব; এবং (ঘ) নির্বাহি কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতার অভাব। অন্য সব জাতীয়করণকৃত শিল্পখাতে এসব দুর্বলতা কম-বেশি বিদ্যমান ছিল, এবং এটি কোনো বিস্ময়কর বিষয়ও ছিল না, কারণ প্রয়োজনীয় আদর্শিক প্রস্তুতি ছাড়াই সমাজতন্ত্র প্রবর্তন করা হয়েছিল।
১৯৭৯-৮০ সালে বিশেষজ্ঞ বা দক্ষ কমিটির সুপারিশ অনুসারে শিল্প-কল-কারখানার বিরাষ্ট্রীয়করণ শুরু হয় এবং কমিটির সুপারিশ অনুসারে ৩ জন বাংলাদেশি মালিকের পাটকল ফেরত দেয়া হয় এবং এরূপ অন্য ৩টি মিল বাংলাদেশিদের নিকট নিলামে বিক্রয় করা হয়। পরবর্তীকালে সরকার এরূপ মিল প্রতিষ্ঠার জন্য পুরাতন ও ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি আমদানিসহ ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগের পরিমাণ উন্মুক্ত করে দেয়। ১৯৮২ সালে সরকার ৩৫টিরও বেশি পাটকল সাবেক বাংলাদেশি মালিকদের নিকট হস্তান্তর করে। ১৯৮২-৮৪ সালে বেসরকারি খাতের বেশকিছু পাটকল (বিজেএমসির প্রতিনিধিত্বে) মুনাফা অর্জন করে, কিন্তু পরবর্তীকালে এগুলোও পূর্বের ন্যায় ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
কেন্দ্রীয়ভাবে কাঁচাপাট ক্রয়, বিক্রয়, আনুপু্িক্ষক বিষয় পর্যালোচনার জন্য পূর্বোল্লেখিত কারণ ছাড়াও এরূপ ক্ষতির কারণগুলি হচ্ছে: (ক) ভারত কর্তৃক পাটজাত দ্রব্য সামগ্রীর মূল্য হ্রাস; (খ) বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি; এবং (গ) শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি। এরূপ ধাপে ধাপে মূল্য বৃদ্ধির কারণে সরকার ১৯৮৬-৮৯ সালে ১৩৫.৭৯ কোটি টাকা রপ্তানি কার্য-সম্পাদন সুবিধা হিসেবে ১৯৮৯-৯২ সালে ২৫৫.৪২ কোটি টাকা নগদ ভর্তুকি হিসেবে প্রদান করে। ১৯৯০ সালে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ সরকারকে পাট শিল্পে সমীক্ষা চালানোর পরামর্শ দেয়। এই সমীক্ষা পরিচালনার জন্য সরকার একজন বিদেশি পরামর্শক নিয়োগ দেয় যিনি স্থানীয় চার্টার্ড একাউন্ট্যান্টদের সহায়তায় এই সমীক্ষণ পরিচালনা করবেন। এই সমীক্ষণ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, ১৯৯১ সালের জুন মাসে পাটকলগুলোর ব্যাংকের নিকট পুঞ্জীভূত বা ক্রমবর্ধমান দায় বা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২০৭৫.৩২ কোটি টাকা যার মধ্যে বিজেএমসির মিলের ঋণের টাকার পরিমাণ ১২৯৯.০৫ কোটি টাকা এবং ৩৫টি বিরাষ্ট্রীয়করণ মিলের ঋণের টাকার পরিমাণ ৭৭৪.২৭ কোটি টাকা। এই সমীক্ষায় সুপারিশ করা হয় যে, মিলগুলোর অতিরিক্ত উৎপাদন ক্ষমতা ছাঁটাই করতে হবে এবং বিজেএমসি-র অধীনস্থ মিলগুলোকে রাষ্ট্রীয় মালিকানা থেকে ব্যক্তি মালিকানায় হস্তান্তর করতে হবে। এসব পদক্ষেপসহ অন্যান্য সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য বিশ্বব্যাংক নগদ ২৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি প্রদান করে।
বাংলাদেশ সরকার এসব সুপারিশ গ্রহণ করে ৪টি মিল বন্ধ করে দেয়, রপ্তানি ক্ষতিপূরণের জন্য তহবিল প্রদান করে এবং অতিরিক্ত শ্রমশক্তি ছাটাই করার জন্য বিজেএমসি-এর মিলগুলোকে আর্থিক সাহায্য প্রদান করে। বিশ্বব্যাংকের সুপারিশসমূহ বাস্তবায়ন সত্ত্বেও ১৯৯২-৯৫ সাল পর্যন্ত বিজেএমসি এবং বিজেএমএ-এর অধীনে পরিচালিত মিলগুলো বাণিজ্যিকভাবে বিকশিত হতে এবং টিকে থাকতে সক্ষম হয়নি বরং লোকসানের সম্মুখীন হতে থাকে। ১৯৯১-২০০০ সাল পর্যন্ত বিজেএমসি-এর অধীনে পরিচালিত মিলগুলোর মোট লোকসানের পরিমাণ ছিল ৬৯৫.৫৫ কোটি টাকা। ২০০২ সালের জুন মাসে সরকার এই খাতের সর্ববৃহৎ পাটকল আদমজি জুট মিল বন্ধ ঘোষণা করে। নিকট অতীতের অভিজ্ঞতাও প্রায় অনুরূপ। ২০০১-০২ থেকে ২০০৬-০৭ সাল পর্যন্ত বিজেএমসি-এর অধীনে পরিচালিত মিলগুলোর প্রায় ১৯১১ কোটি টাকা লোকসান হয়। বেসরকারি খাতের মিলগুলোও খুব একটা ভালো চলছিল না। ১৯৯৮ সালে এই খাতের ৪১টি পাটকলের মধ্যে ৩টি বন্ধ করে দেয়া হয় এবং দুটিকে লে-অফ ঘোষণা করা হয়। ১৯৯৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এসব মিলের পুঞ্জীভূত লোকসানের পরিমাণ ছিল ১২ বিলিয়ন টাকারও বেশি। এভাবে জাতীয়করণকৃত শিল্পসমূহের সমস্যা সমাধানের জন্য ব্যক্তি মালিকানায় রূপান্তরও কোনো সমাধান দিতে পারছে বলে মনে হয় না।
যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশের পাটশিল্প বিভিন্ন সমস্যার মোকাবেলা করে আসছে: (ক) স্থবিরতা বা রপ্তানি মূল্য হ্রাসের পরিপ্রেক্ষিতে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি; (খ) পুরাতন যন্ত্রপাতির উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস; (গ) শ্রমিক সমস্যা; (ঘ) বহুবিস্তৃত দুর্নীতি; (ঙ) অদক্ষ ব্যবস্থাপনা এবং এর ফলে পুঞ্জীভূত বিশাল পরিচালন লোকসান প্রভৃতি বহুবিধ কারণে এক সময়ের একটি গতিশীল শিল্প বর্তমানে ‘অস্তমিত’ শিল্প হিসেবে অভিহিত হচ্ছে এবং সোনালি আঁশ তার ঔজ্জ্বল্য অনেকাংশে হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু বর্তমানেও পাটশিল্প জাতীয় অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে: পাটশিল্পের ৪০ শতাংশ উৎপাদন ক্ষমতা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরও এই শিল্প প্রায় দেড় কোটি লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারে। বীমার অর্থ হিসেবে ১০০ কোটি টাকা প্রদান করে এবং প্রায় সমপরিমাণ টাকা খরচ হিসেবে কাঁচাপাটের অভ্যন্তরীণ পরিবহণে ব্যয় করতে পারে, ১৫০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারে এবং ৩০ লক্ষ টাকার কাঁচাপাট ব্যবহার করতে পারে। এভাবে পাটশিল্প লক্ষ লক্ষ পাটচাষীর জন্য কল্যাণ বয়ে আনতে পারে। লেখক: সাংবাদিক