শর্তসাপেক্ষে বিদেশি ঋণ ও বাংলাদেশের উন্নয়ন
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ
বাংলাদেশ এখনো বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল থেকে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে উত্তরণ ঘটাতে পারেনি। তাই ভবিষ্যতে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের সহনীয় মাত্রা অসহনীয় হয়ে উঠতে পারে। স্বাধীনতার পরপরই, বাংলাদেশকে তার যুদ্ধ-বিধ্বস্ত অর্থনীতির পুনর্গঠন ও পুনর্বাসন, অবকাঠামো উন্নয়ন, অর্থনীতির মূল খাতগুলোকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে বিভিন্ন সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য বিদেশি সাহায্য ও ঋণ গ্রহণ করতে হয়েছিলো। এই সহায়তা গ্রহণ করার সময় ছিলো, আছে ও প্রয়োজনীয় হবে। এটির সঙ্গে আসা শর্তাবলী সাবধানে বিবেচনা করা ও যাচাই করা গুরুত্বপূর্ণ। এটি প্রতিটি সেক্টরের প্রয়োজন ও সুবিধার উপর ভিত্তি করে হওয়া উচিত। কার্যকরী ব্যবহারের মাধ্যমে দ্রুত আয় অর্জনের লক্ষ্যে কর্ম পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা উচিত। গ্রেস পিরিয়ডের পর বৈদেশিক ঋণের সুদের কিস্তি ও মূল পরিশোধের ক্রমবর্ধমান বোঝা এখন বাংলাদেশের রাজস্ব বাজেটের অন্যতম প্রধান ব্যয় আইটেম। বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। বর্তমানে যে হার্ড-টার্ম ও সাপ্লায়ার ক্রেডিট লোন নেওয়া হচ্ছে তা ভবিষ্যতে ঋণ পরিশোধের বোঝা আরও বাড়িয়ে দেবে।
আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা আয় না বাড়লে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের সহনীয় মাত্রা এক পর্যায়ে অসহনীয় হয়ে উঠতে পারে। বেশিরভাগ সাহায্য গ্রহীতা দেশের ক্ষেত্রে এটি হওয়ার কথা নয় বিশেষ করে যদি প্রয়োজনের সময় বিদেশি সাহায্য পাওয়া যায়, ব্যয় করা হয় ও যথাযথ খাতে দ্রুত ব্যবহার করা হয়। ঋণ বা সাহায্যের বিষয় হলো বাজেট ঘাটতি মেটাতে নিজের সীমিত সম্পদকে আরও দক্ষ করে তোলা। প্রাপ্ত সহায়তা ও ঋণ যদি তাদের কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জনের দিকে পরিচালিত না করে। যেমন একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ও উৎপাদনশীল রাষ্ট্র, তবে এক পর্যায়ে ঋণের অর্থ সুদ সহ পরিশোধ করতে হবে, যা ‘ওহ , প্রভু, আমাকে বাঁচান’ পরিস্থিতির মতো হবে। যেমনটি কাছাকাছি ও দূরের বেশ কয়েকটি উন্নয়নশীল দেশ ও অর্থনীতিতে ঘটেছে। সাম্প্রতিক সময়ে গোষ্ঠী, পারিবারিক ও স্বৈরাচারী দুর্নীতি দ্বারা জর্জরিত বেশ কয়েকটি অর্থনীতির দুর্ভাগ্যজনক উদাহরণ রয়েছে। যা সেই অর্থনীতিগুলোকে প্রায় দেউলিয়া করে তুলেছে।
তাদের সাফল্য ও ব্যর্থতার কারণ বিশ্লেষণ করা বাংলাদেশের জন্য অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে আমাদের অভূতপূর্ব অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য অর্থায়নের জন্য আমাদের নিজস্ব নির্ভরতার কারণে। ১৯৭২ থেকে ২০১২ পর্যন্ত ৪০ বছরে ৫৭ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক সাহায্য এসেছিলো। গত দশ বছরে ৪৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি ব্যবহার করা হয়েছে, যার ৯৬ শতাংশ এসেছে ঋণ ও দ্বিপাক্ষিক উৎস থেকে। বহুপাক্ষিক উৎস থেকে ঋণের সুদের হার ও পরিশোধের সময়কাল সাধারণত বেশ সহনীয় (নরম), যখন দ্বিপাক্ষিক উৎস থেকে (জাপান ব্যতীত) ঋণগুলো উচ্চ সুদের হারে সীমিত পরিশোধের সময়কাল। এগুলো মূলত সরবরাহকারীর ক্রেডিট প্রকৃতির হয়। কোনো দেশই অনির্দিষ্টকালের জন্য বৈদেশিক সাহায্য ও সহায়তার ওপর নির্ভর করতে পারে না। সীমিত সময়ের জন্য বৈদেশিক সাহায্য সহায়তা গ্রহণ করা ও নিজেকে স্বাবলম্বী করা ভালো। কারণ একই পরিমাণে, একই শর্তে ও একই উৎস থেকে সব সময় সাহায্য পাওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিবেশের পরিবর্তনের উপর নির্ভর করে উপলব্ধ সাহায্য সহায়তার পরিমাণও পরিবর্তিত হয়।
১৯৯০-এর দশকের শুরু পর্যন্ত বিশ্ব দুটি শিবিরে বিভক্ত ছিলো। তখন বাংলাদেশের মতো প্রায় ডজনখানেক বৈদেশিক সাহায্য প্রার্থী দেশ ছিলো। উভয় শিবিরই এই উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সাহায্য করে তাদের প্রভাবের বলয়ে রাখতে চেয়েছিলো। ফলে সাহায্য-সহযোগিতা পেতে খুব একটা সংগ্রাম করতে হয়নি। ঋণ উপলব্ধ ছিলো তারা সহজ শর্তাবলী ছিলো এমনকি দ্বিপাক্ষিক ঋণ মাফ হয়েছে। বহুপাক্ষিক সংস্থা থেকে ঋণের ক্ষেত্রে অনেক শর্ত বা সতর্কতা সংযুক্ত ছিলো না। ১৯৯০-এর দশকে শীতল যুদ্ধের অবসানের পর থেকে বিশ্ব এখন একটি শিবিরের নেতৃত্বে রয়েছে ও সাহায্যপ্রার্থী দেশগুলোর সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সাহায্য-প্রদানকারী দেশগুলোর কাছে অতিরিক্ত অনুগ্রহ করার কোনো যৌক্তিক কারণ আর নেই। দ্বিপাক্ষিক ঋণ সহায়তা কিছু ক্ষেত্রে ওঠানামা করেছে, এমনকি বহুপাক্ষিক ঋণের প্রাপ্যতাও কঠিন হয়ে পড়ছে। ঋণ অনুমোদনের শর্ত বাড়ছে, সতর্কতাও বাড়ছে। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেতে হলে বাংলাদেশ নরমাল ঋণ পাবে না। বাংলাদেশের জন্য একটি উন্নয়নশীল দেশ কঠিন ঋণ অর্জন, পরিশোধ করা বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
একটি উন্নয়নশীল দেশকে দেখতে হবে কোন খাতে, কতোটা সাহায্য, কেন, কতোদিন লাগবে ও দ্রুত অগ্রগতি নিশ্চিত করতে হবে। ২০২১ সালের জুনের মধ্যে বাংলাদেশের প্রাপ্ত মোট প্রকল্প ঋণের ২৪.২৮ শতাংশ জ্বালানি, বিদ্যুৎ খাতে ও পরিবহন ও যোগাযোগ ২১.৭৮ শতাংশ (সড়ক, সেতু, রেলপথ ও টিএন্ডটি সহ) খাতে ব্যবহৃত হয়েছে। মাত্র ১২.৪৭ শতাংশ কৃষি ও পানিসম্পদ খাতে ব্যবহৃত হয়েছে, যা বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণশক্তি। স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও গ্রামীণ উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের মতো সামাজিক খাতে ব্যবহৃত মোট পরিমাণ হলো ১৫.৭৭ শতাংশ। তাই জ্বালানি, বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ খাতে বিনিয়োগ করা বিপুল পরিমাণ ঋণের অর্থ কাক্সিক্ষত ও টেকসই উন্নয়ন সক্ষম করেছে কিনা তা দেখতে হবে। উন্নয়নকে অর্থবহ করতে এই পর্যালোচনা প্রয়োজন। কিছু দেশের অর্থনৈতিক সাফল্যকে অতিরঞ্জিত ও প্রচার করার প্রবণতা রয়েছে যাদের উন্নয়ন ঋণের মাধ্যমে হয়েছে। এই ঋণগুলো দাতাদের প্রেসক্রিপশনের সঙ্গে আসে, যার মধ্যে প্রকল্প ব্যবস্থাপনায় বিদেশি পরামর্শক নিয়োগ দিয়েছে (যার জন্য বৈদেশিক মুদ্রা খরচ হয়)।
যেহেতু যে কোনো কর্তৃপক্ষ কর্তৃক গৃহীত ঋণ ও অনুদানের বোঝা তিন প্রজন্ম পর্যন্ত সকল নাগরিককে বহন করতে হবে, তাই গণমাধ্যমে আলোচনা ও বিতর্ক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জনসচেতনতা বৃদ্ধি, জনমত যাচাইয়ের ব্যবস্থা থাকতে হবে। জাতীয় সংসদে কতোদিন, কেন, কী কাজের জন্য ও কী শর্তে বৈদেশিক সাহায্য নেওয়া হচ্ছে, নেওয়া উচিত বা নেওয়া উচিত নয় তা দেখতে হবে। গণতন্ত্রে জনগণই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনৈতিক উন্নয়ন এসব মানুষের কল্যাণে নিবেদিত। এই লোকদের প্রতি দায়িত্ববোধের মাধ্যমে ও আবার সকল মানুষের দ্বারা যথাযথ দায়িত্ব পালনের মাধ্যমেই সমাজ সমৃদ্ধি লাভ করে। অন্যদিকে নির্দিষ্ট কিছু মানুষের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা সমাজের বড় ক্ষতি করে। একটি ব্যক্তি, একটি অর্থনীতি ও একটি সমাজের বৃদ্ধির একটি সীমা আছে, তাদের অবস্থা ও ক্ষমতা অনুযায়ী। এই সীমা অতিক্রম করলে ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। এটি একটি দ্রুতগামী গাড়ির মতো যা গতিসীমা অতিক্রম করে এমন একটি বিন্দুতে তার ইঞ্জিন ভেঙে যায় বা এটি বিপর্যস্ত হয়। একটি সমাজ বা অর্থনীতিও একই ধরনের দুর্দশার মুখোমুখি হতে পারে।
লেখক : বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সচিব ও এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান। অনুবাদ : জান্নাতুল ফেরদৌস। সূত্র : দি বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড