প্লাস্টিকমুক্ত পৃথিবী চাই
উত্তম কুমার মন্ডল
প্লাস্টিক হলো একধরনের জৈব পলিমার। বর্তমানে ব্যবহৃত সবচেয়ে সাধারণ প্লাস্টিক হলো পলিথিন। উচ্চচাপ [১০০০-১২০০ধঃস] ও তাপমাত্রায় [২০০ক্কঈ] সামান্য অক্সিজেনের উপস্থিতিতে তরলীভূত হয়ে অসংখ্য ইথিলিনের অণু পলিইথিলিন বা পলিথিন তৈরি করে। ব্রিটিশ উদ্ভাবক আলেকজান্ডার পার্কস ১৮৫৫ সালে মানবসৃষ্ট প্লাস্টিক আবিষ্কার করেন এবং ১৮৬২ সালে একটি প্রদর্শনীতে প্লাস্টিকের প্রদর্শন করেন। তখন এটিকে পার্কেসিন বলা হতো। পার্কেসিন তৈরি হয় মূলত সেলুলোজ থেকে। পরবর্তীতে নিউইয়র্কের উদ্ভাবক জন ওয়েসলি পার্কেসিনের উন্নত সংস্করণ সেলুলয়েড উদ্ভাবন করেন। এটি ছিল একটি উদ্বায়ী থার্মোপ্লাস্টিক যা নাইট্রো সেলুলোজ এবং কর্পূরের মিশ্রণে তৈরি হতো। থার্মোপ্লাস্টিক হলো এমন ধরনের প্লাস্টিক যাকে তাপ দিলে এটি নরম হয়ে যায়, কিন্তু তাপ অপসারণে আবার শক্ত পদার্থে পরিণত হয়। বিজ্ঞানী লিও ব্যাকেল্যান্ড আধুনিক প্লাস্টিক ব্যাকেলাইট উদ্ভাবন করেন।
সৈন্যদের প্রয়োজনের তাগিদে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে পলিইথিলিন, পলিস্টারিন, নাইলন আবিষ্কৃত হয়। কিন্তু ‘ যুদ্ধের পর এসব প্লাস্টিক জনগণের বন্ধু হয়ে ওঠে। প্লাস্টিকের নমণীয় ধর্ম, সস্তা উৎপাদন প্রণালী, হালকা ওজন, স্থায়ী ও টেকসই ধর্ম, দীর্ঘকাল ব্যবহার করা যায়। এজন্য এটি এত জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বর্তমানে আমরা প্লাস্টিকের নানা রকম ব্যবহার দেখি। সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় ওয়ান-টাইম ইউজড প্লাস্টিক। বিশ্বজুড়ে মাত্র এক মিনিটেই বিক্রি হচ্ছে এক মিলিয়ন প্লাস্টিক বোতল। পানির বোতল, বিস্কুটের ট্রে, প্লাস্টিকের কন্টেইনারে ব্যবহৃত হয় চঊঞ প্লাস্টিক, শ্যাম্পুর বোতল, দুধের বোতল, ফ্রিজার ব্যাগ, আইসক্রিমের কন্টেইনারে ব্যবহৃত হয় ঐউচঊ প্লাস্টিক। ব্যাগ, ট্রে, কন্টেইনার, ফুড প্যাকেজিং, ফ্লিমে ব্যবহৃত হয় খউচঊ প্লাস্টিক। চিপসের ব্যাগ, বোতলের ক্যাপ, ওয়ান-টাইম ইউজড ফেস মাস্কে ব্যবহৃত হয় চচ প্লাস্টিক, প্লাস্টিকের ক্যাপ, প্লেট তৈরিতে ব্যবহৃত হয় চঝ প্লাস্টিক।
বিংশ শতাব্দীর শুরুতেও প্লাস্টিকের ব্যবহার ছিল খুবই কম। কিন্তু ‘এ শতাব্দীর শেষ দিকে এ ব্যবহার তিনগুণে গিয়ে দাঁড়ায়। ২০০০ সালের শুরুতে প্লাস্টিক দূষণ সব রেকর্ড ভেঙ্গে ফেলে। এসব প্লাস্টিকের ৮৫শতাংশ এর শেষ ঠিকানা হয় অনাবাদি ভূমিতে বর্জ্য হিসেবে। এসব প্লাস্টিকের একটি বড় অংশের অবস্থান হয় নদী ও সমুদ্রের পানিতে। টঘঊচ’র তথ্য অনুসারে বিশ্বে প্রতি দিন ৩ কোটি টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়, যার ৮০ লাখ টন সাগরে গিয়ে পড়ে। এর মধ্যে প্রতিদিন বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ে ৭৩ হাজার মেট্রিকটন প্লাস্টিক বর্জ্য। এভাবে চলতে থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ সমুদে মাছের চেয়ে প্লাস্টিকের পরিমাণ বেশি হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।প্লাস্টিক নদীতে থাকুক অথবা স্থলভাগে, এটি বছরের পর বছর অবিয়োজিত থেকে যায়। ফলে এটি পরিবেশে কার্বণের মাত্রা ব্যাপকহারে বাড়িয়ে দিচ্ছে। বাস্তুতন্ত্র ও বন্যজীবনের ক্ষতিসাধন করছে, মাত্রাতিরিক্ত দূষণ ও লাগামহীন বর্জ্যের পরিমাণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। এটি গ্রিনহাউজ গ্যাসের পরিমাণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। প্লাস্টিকের কার্বন প্রায় ৩.৪ শতাংশ এ নির্গমনের সমান। মাইক্রোপ্লাস্টিক সহজেই মানবদেহে প্রবেশ করে। যেসব প্লাস্টিকের আকার ২স-৫সস তাদের মাইক্রোপ্লাস্টিক বলে। আমাদের ফুসফুস, যকৃৎ, স্পিøন এবং কিডনিতে এটি অবস্থান নেয়। সম্প্রতি জানা গেছে পরিণত ভ্রণতেও মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে। অর্থাৎ একটি নিষ্পাপ শিশুও পৃথিবীতে আসার আগেই এ ভয়াবহ দূষণের শিকার হচ্ছে। সমুদ্রের মাছে পাওয়া যাচ্ছে মাইক্রোপ্লাস্টিক। এর ফলে প্রতিবছর ১০ লাখেরও বেশি সামুদ্রিক পাখি ও এক লাখ সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণীর মৃত্যু ঘটছে। তাহলে এ ভয়াবহ দূষণ থেকে আমাদের পরবর্র্তী প্রজন্মকে কীভাবে রক্ষা করবো? কিছু উপায়ের কথা বলে যাচ্ছি-প্রথমত প্লাস্টিকের পরিপূর্ণ রিসাইকেল করা। বর্তমানে মাত্র ৯ শতাংশ রিসাইকেল করা হয়। ওয়ান-টাইম ইউজড প্লাস্টিকের ব্যবহার [যেমন-দোকানে জুস খেতে প্লাস্টিকের স্ট্র ব্যবহার, পানি খাওয়ার জন্য বোতল/প্লাস্টিকের গ্লাসের ব্যবহার ইত্যাদি] বাদ দেওয়া বা শূন্যের কাছাকাছি আনা। পরিবেশের পরিচ্ছন্নতায় সবাই অংশ নেওয়া এবং বর্জ্যগুলোকে নির্ধারিত স্থানে জমা করা। নদী, সমুদ্র, কৃষিজমিতে প্লাস্টিক ফেলা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা। যেসব পদার্থে মাইক্রোবিড ‘সূক্ষ্ম প্লাস্টিক কণা’ থাকে যেমনÑফেসওয়াশ, টুথপেস্ট, বডিওয়াশ ইত্যাদির বিকল্প ব্যবহার প্রচলন করা। প্লাস্টিক ইটিং এনজাইম ও প্লাস্টিক ইটিং মাশরুমের ব্যবহার জনপ্রিয় করে তোলা।
প্লাস্টিক বর্জ্যকে পিচের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করে ‘নেদারল্যান্ড একটি রাস্তা তৈরী করেছে’ রাস্তা নির্মাণ করা যায়। প্লাস্টিক বর্জ্যকে তেলে খরপবষষধ ঐড়ষফরহমং কোম্পানী এটি করেছে রূপান্তর করা যায়। এছাড়া যেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান প্লাস্টিক দূষণরোধে কাজ করছে তাদের স্বীকৃতি দেওয়া ও সহযোগিতা করা। শুধু তখনই প্লাস্টিক দূষণমুক্ত পৃথিবী আশা করতে পারি। এভাবেই তৈরি হবে একটি বাসযোগ্য পৃথিবী। লেখক: সিনিয়র শিক্ষক, যশোর জিলা স্কুল, যশোর