যে পাখি অর্ধেক পুরুষ ও অর্ধেক স্ত্রী
বিশ্ব রঞ্জন গেস্বামী
পাখিদের জগতে সাধারণত পুরুষ ও স্ত্রী ভিন্ন প্রকৃতির হয়, তারা কেউ পুরুষ কিংবা স্ত্রী লিঙ্গের বৈশিষ্টযুক্ত হয়। অনেক ক্ষেত্রেই তাদের খুব সহজেই আলাদা করা যায়। উভলিঙ্গের পাখির কথা সচারচর খুব একটা শোনা যায় না। কিন্তু গবেষকেরা এমনই একটা পাখির কথা সন্ধান পেয়েছেন। সম্প্রতি গবেষকেরা একটি অসাধারন আকর্ষণীয় রঙ্গের গ্রীষ্মমন্ডলীয় পাখি আবিষ্কার করেছেন যার নাম হলো গ্রিন হানিক্রিপার। যার বিজ্ঞানসম্মত নাম ক্লোরোফেনেস স্পিজা। এ গ্রীন হানিত্রীপারের সাধারণ আবাসস্থলের পরিসর মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা, দক্ষিণ মেক্সিকো থেকে ব্রাজিল পর্যন্ত বিস্তৃত।
সাধারণত স্ত্রী ডগ্রন হানিক্রিপার ঘাসরঙা সবুজ পালক ও পুরুষরা উজ্জ্বল নীল রঙ্গের হয়। অথচ এ পাখিটির শরীরের অর্ধেকের উপর পুরুষের পালক ও অন্য অর্ধেক স্ত্রী পাখির পালক রয়েছে। যাহোক,এ পাখির শরীরের বামদিকে সবুজ ও ডানদিকে নীল রঙ্গের। অপেশাদার পাখি পর্যবেক্ষক ও প্রধান গবেষক জন মুরিলো ২০২১ সালে কলাম্বিয়ার ভলামারিয়ার কাছে তার খামারে প্রথম দুই-রঙা হানিত্রীপার দেখেছিলেন,পাখিটিকে শেষবার নিউজিল্যান্ডের ওটাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রানীবিদ্যার অধ্যাপক ও সহ গবেষক হামিস স্পেনসার ২০০৩ সালের জানুয়ারিতে পাখি পাখি দেখার সময় মুরিলের খামারে গিয়ে একই রকম পাখিটিকে দেখেছিলেন, যদিও এর বর্তমান অবস্থান অজানা।
পাখিটি ছিল একটি দ্বিপার্শীয়ভাবে প্রতিসম বা গাইনান্ড্রোমর্ফ যার অর্থ উভয় দিঙ্গের বৈশিষ্টযুক্ত ও তাত্বিক মতে উভয়েই পূনারুৎপাদন করতে পারে। জার্নাল অফ ফিল্ড অর্নিথোলজির প্রকাশিত ২০২৩ সালের ডিসেম্বর সংখ্যায় এই পাখি সম্পর্কে একটি নতুন গবেষণা অনুসারে এটি প্রজাতিটির মধ্যে এ রকম দ্বিতীয় রেকর্ড এবং ১০০ বছরেরও বেশি সময়ের মধ্যে প্রথম রেকর্ড বলে জানা যায়। এক সাক্ষাৎকারে হামিস স্পেনসার সায়েন্স পত্রিকাকে বলেন ‘আমি সত্যিই এটা বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে এখানে এ পাখিটির অর্ধেক পুরুষ ও অর্ধেক নারী বৈশিষ্টযুক্ত হয়। মুরিলোর তার পাখি সংগ্রহশালায় হানিত্রীপারসহ অনেক পাখি রাখেন, রোজ খাবার দেন যা রিজার্ভ ন্যাচারাল ডেমোস্টেটিভা ডন মিওয়েল নামে একটি ইকোটুরিজিম হিসাবে পরিচিত, তাতে মাছের খামারও আছে। তিনি মিশ্র লিঙ্গের এ পাখিটির একটি ছবিও তুলে রেখেছিলেন। একটি সমীক্ষা অনুসারে জানা যায় যে ২০২১ ও ২০২৩ সালের মধ্যে কোনো এক সময়ে মুরিলোরের সংগ্রহসালার চারপাশে কয়েক সপ্তাহ ধরে হানিত্রীপার দেখা গিয়েছিল। গবেষকেরা উল্লেখ করেছেন যে পাখিটি সেখানে কোন অস্বাভাবিক আচরণ করেনি। যাহোক, পাখিটি সেখানে খাবারের আগে অন্যান্য হানিত্রীপার চলে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করত এবং কখনও কখনও অন্য পাখিদের খাবার নেওয়ার সময় বাধা দিত।
হানিত্রীপার প্রজাতির অন্যান্য সদস্যদের এড়িয়ে চলার প্রবনতা দেখা দিত। দেখা গেছে তাদের একটি সঙ্গী পেতে অসুবিধা হতে পারে, যদিও এটা অজানা যে তারা পূনরুৎপাদন করতে পারে কিনা। গবেষকরা এর আগে অন্যান্য প্রজাতির গাইনান্ড্রোমর্ফিক পাখিদের ব্যবচ্ছেদ করেছেন ও দেখেছেন যে তাদের যৌন অঙ্গগুলো তাদের পালকের রংয়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ অর্থাৎ একদিকে একটি ডিম্বাশয় ও অন্যদিকে একটি শুক্রাশয় থাকে। বেশিরভাগ প্রজাতির স্ত্রী পাখিদের বাম পাশে শুধুমাত্র একটি কার্যকরী ডিম্বাশয় থাকে। যাহোক তাই যদি একটি গাইনান্ড্রোমর্ফিক পাখি এ হানিত্রীপারের মত বামদিকে স্ত্রী বৈশিষ্টপূর্ণ হয়, তাহলে এটি সম্ভাব্য বাম দিকে একটি স্ত্রী হিসাবে ও ডানদিকে একটি পুরুষ হিসাবে পুনারুৎপাদন করতে পারে। বেশিরভাগ পাখির বাহ্যিক যৌনাঙ্গ থাকে না, বরং ক্লোয়াকা নামক একটি একটি খোলা গঠন থাকে যার দ্বারা উভয়ের মধ্যে যৌন মিলন ঘটে। গবেষকেরা উল্লেখ্য তরেছেন যে অতীতে গাইনান্ড্রোমর্ফিক পাখিদের মিলন হতে দেখা গেছে। যেমন একটি আচরণগত গাইনান্ড্রোমর্ফিক পুরুষ জেব্রাফিঞ্চ একটি স্ত্রী জেব্রাফিঞ্চের সঙ্গে সঙ্গম করে, আবার যখন দুটি আচরণগতভাবে স্ত্রী গাইনান্ড্রোমর্ফিক গোল্ডিয়ান ফিঞ্চ ‘ক্লোয়েবিয়া গৌলডিরা’ পুরুষের সঙ্গে মিলিত হয় তখন অনুর্বর বা বাওয়া এবং উর্বর উভয় প্রকার ডিম উৎপাদন করে।
ওটাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা অনুসারে পোকামাকড়, গিরগিটিসহ অন্যান্য প্রাণীদের ক্ষেত্রেও গাইনান্ড্রোমর্ফিক আচরণ ঘটতে পারে। পাখিদের ক্ষেত্রে গবেষকরা সন্দেহ করেন যে এটি একটি ত্রুটির কারণে ঘটছে যা একটি স্ত্রী পাখির নিষিক্ত ডিম্বানুতে কোষগুলোর বিভাজনের সময় ঘটে যখন একটি ডিমের কোষে দুটি নিউক্লিয়াস তৈরি হয় যা পরে দুটি পৃথক শুক্রানু দ্বারা নিষিক্ত হয়। পাখিদের ক্ষেত্রে দুই ধরনের যৌন বা সেক্স ক্রোমজোম হয়, একটি ‘ত’ অন্যটি ড ক্রোমজোম। স্ত্রী পাখির সেক্স ক্রোমজোম তড বহন করে, আবার যখন পুরুষ একই ক্রোমজোমের দুটি কপি ‘তত’ বহন করে, অথচ বিপরীত বিষয় বা প্যাটার্নটি স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে দেখা যায়, এক্ষেত্রে স্ত্রীরা ‘ঢঢ’ ও পুরুষরা ‘ঢণ’ বহন করে। দুটি নিউক্লিয়াস-সহ একটি গাইনান্ড্রোমর্ফিক ডিম কোষে একটি নিউক্লিয়াস একটি ‘ত’ ক্রোমজোম এবং অন্যটিতে ‘ড’ ক্রোমজোম থাকে। দ্বৈত নিষিক্তকরণ যখন পুরুষ এবং ডান দিকে ঘটে তখন শুক্তানু পুরুষ ‘ত’ ক্রোমজোম বহন করে আনে, তখন ‘ত’ নিউক্লিয়াস গ্রহণ করে ‘তত’ ‘পুরুষ’ হয়ে যায়ও ‘ড’ নিউক্লিয়াস তখন একটি ভিন্ন ‘ত’ ক্রোমজোম গ্রহণ করে ‘তড’স্ত্রী হয়ে যায়। তাত্বিকভাবে গাইনান্ড্রোমর্ফিক হানিত্রীপারের পুরুষ ও স্ত্রী উভয়ের প্রজনন অঙ্গ থাকতে পারে। পুরুষ, ও স্ত্রী নিউক্লিয়াস একই পাখির দুটি পৃথক অর্ধেক গঠন করে। এক্ষেত্রে পাখি উভয় দিকের লিঙ্গ হতে পারে, স্ত্রীর ক্রোমজোম দুটি নিউক্লিয়াসের মধ্যে কীভাবে বিভক্ত হয় তার উপর নির্ভর করে। তাই স্পেনসার বলেছিলেন ‘আমাদের পর্যবেক্ষণটি গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কারণ হলো সবুজ
হানিত্রীপারের পূর্বের উদাহরণটি অন্যভাবে ছিল, এটি বাম দিকে পুরুষ ও ডানদিকে স্ত্রী ছিল এটি আমাদের যা বলে তা হলো উভয় ফলাফলই সম্ভব ও এটি দ্বৈত নিষেকের সঙ্গে খাপ খেয়ে যায়। লেখক : বিজ্ঞান লেখক। সদ্যস, জীব বৈচিত্র সংরক্ষণ একাডেমি, কলকাতা