বঙ্গবন্ধু এবং স্বাধীনতার প্রভাব কি মিলিয়ে যাচ্ছে?
প্রবীর বিকাশ সরকার
বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং বঙ্গবন্ধু সমার্থক। কিন্তু এই বিষয়ে মনে হচ্ছে মানুষের আগ্রহ আর আগের মতো নেই। ক্রমশ হ্রাস পেয়ে চলেছে। বেশ কয়েক বছর ধরেই দেশ-বিদেশে তদ্বিষয়ে কোনো সেমিনার বা আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে খবর পাচ্ছি না। জাপানের কথাই যদি ধরি, এদেশে বিগত তিন-চার দশক ধরে হাজারের অধিক বঙ্গবন্ধু বা আওয়ামী সমর্থক বসবাস করছেন। নব্বইএর দশকে প্রবল জোয়ার এসেছিল বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্র করে প্রবাসীদের মধ্যে। সম্মেলন, আলোচনা, স্বাধীনতা দিবস, শোক দিবস উদযাপন নিয়মিতই হয়েছে, কিন্তু শূন্য দশকে এসে দ্রুতই ¯ি’মিত হয়ে এসেছে। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, উল্লেখযোগ্য কোনো কাজই হয়নি। অথচ সেই সুযোগ ছিল। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাক দূরপ্রাচ্যের দেশ জাপানেও এসে পৌঁছেছিল। বাঙালি জাতির এই অবিসংবাদিত নেতার ডাক নাড়া দিয়েছিল তৎকালীন একাধিক বিশিষ্ট বাঙালিভক্তকে। তাঁদের মধ্যে জাপানশীর্ষ রবীন্দ্রগবেষক অধ্যাপক কাজুও আজুমা এবং ভাষাবিদ অধ্যাপক ডঃ নারা ৎসুয়োশি অন্যতম প্রধান। তাঁদের মুখে বঙ্গবন্ধুর কথা, বাঙালির স্বাধিকার সংগ্রামের কথা শুনেছি নব্বই দশকের প্রথমদিকে, আমি তখন জাপানের একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জাপানি ভাষা ও সংস্কৃতির ছাত্র। তাঁদের মাধ্যমে রবীন্দ্রভক্ত, বাঙালিভক্ত, বঙ্গবন্ধুভক্ত অন্যান্য জাপানি নাগরিকদের মধ্যেও ছড়িয়ে গিয়েছিল বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের সংবাদ। যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল পাকিস্তানি শাসকের বিরুদ্ধে অধ্যাপক ডঃ নারাসহ টোকিও বিদেশি ভাষা বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় জাপানি শিক্ষার্থী মিলে প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ, সাংসদ এবং প্রাক্তন শ্রম মন্ত্রী হায়াকাওয়া তাকাশিকে অবহিত করলেন যে, পূর্বপাকিস্তানে অবৈধভাবে অকাতরে বাঙালিকে হত্য করছে পাকসেনারা। স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়েছে। জাপানের উচিত নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ এবং রোধ করার জন্য জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করা। স্বাধীনতাকামী বাঙালির পাশে দাঁড়ানো এবং মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন জানানো জরুরি।
উক্ত জাপানিদের আহবানে সাড়া দিয়ে হায়াকাওয়া দ্রুত জাপান সরকার প্রধানকে অবহিত করেন এবং প্রভাব বিস্তার করে যথাসম্ভব পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য। সরকার পদক্ষেপ নিয়েছিল দুই পাকিস্তানেই সর্বপ্রকার উন্নয়ন সাহায্য বন্ধ করে দিয়েছিল। হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানিয়েছিল। হায়াকাওয়া তাকাশি প্রবীণ রাজনীতিবিদ তিনি জানতেন জাপান-বাংলা ভাববিনিময় সম্পর্কের কথা। তিনি নিজেও ছিলেন জাপানি-বাঙালি দুই জাতির মৈত্রী বন্ধনের ¯’পতি মনীষী ওকাকুরা তেনশিন এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে। ১৯০২ সালে এই সম্পর্কের সূচনা। সেই মৈত্রী সম্পর্ক দ্রুত রাজনৈতিক সম্পর্কে পরিণত হয়েছে ১৯১৫ সালে মহাবিপ্লবী রাসবিহারী বসু জাপানে আগমনের ফলে। রাজনীতি সচেতন মানুষ এবং বুদ্ধিজীবীরা জানতে শুরু করেন শতবছর ধরে শ্বেতাঙ্গ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ব্রিটিশদ্বারা নির্যাতিত, শোষিত হচ্ছে ভারতীয় অধিবাসী, তার মধ্যে অন্যতম প্রধান বাঙালি জাতি। ধারাবাহিকতা ধরে রবীন্দ্রনাথ পাঁচবার জাপান ভ্রমণ করেন, ওকাকুরা তেনশিন ভারত তথা কলকাতায় যান দুবার। স্বচক্ষে দেখেন ভারতবাসীর দুর্দশা এবং স্বাধীনতার আকুতি। তিনি জড়িয়ে গেলেন বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে। ভারতীয় স্বাধীনতার তিনিই প্রথম প্রতিবাদকারী সমর্থক। সেসব ইতিহাস ওকাকুরা-রবীন্দ্রভক্তরা জানতেন। তাঁরা মনেপ্রাণে চাইতেন বাঙালি স্বাধীন হোক, দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্তিলাভ করুক।
ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের আগুন জাপানেও ছড়িয়ে গেল রবীন্দ্রনাথ এবং রাসবিহারী বসুর প্রচেষ্টায়। সর্বপ্রকার সাহায্য, সহযোগিতা এবং সমর্থনের হাত বাড়িয়ে দিলেন প্রভাবশালী জাপানি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব গুরু তোওয়ামা মিৎসুরু, ইনোকুমা ৎসুয়োশি, তেরাও তোওরু, সুগিমতো জুনজোও, ওওকাওয়া শুউমেই, উচিদা রিয়োওহেই, মিয়াজাকি তোওতেন, নাকামুরা তাসুকু, কুজু য়োশিহিসা প্রমুখ। বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে শিক্ষাবিদ ও প্রকাশক শিমোনাকা ইয়াসাবুরোও, শিক্ষাবিদ ও কাগজ ব্যবসায়ী ডঃ ওওকুরা কুনিহিকো প্রমুখ।
জাপানে পলাতক বিপ্লবী রাসবিহারী বসু, বিপ্লবী হেরম্বলাল গুপ্ত, বিপ্লবী এ এম নায়ার, বিপ্লবী আনন্দমোহন সাহাই ক্রমাগত আন্দোলন চালিয়ে যেতে লাগলেন। ১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানকে আমেরিকা ষড়যন্ত্র করে জড়িয়ে ফেলল। সুযোগ এলো ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের দিক পাল্টানোর। গুরু তোওয়ামা মিৎসুরু, রাসবিহারী বসু, এ এম নায়ারের প্রাণপণ চেষ্টায় জার্মানিতে পলাতক সুভাষচন্দ্র বসুকে জাপানে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে আসা হলো ১৯৪৩ সালে। বার্ধক্যে উপনীতি মহাবিপ্লবী রাসবিহারী বসু জাপানে প্রতিষ্ঠিত ভারতীয় স্বাধীনতা লীগের প্রেসিডেন্টের ভার অর্পণ করেন নেতাজি সুভাষ বসুর ওপর। আগেই গঠিত আজাদ হিন্দ্ ফৌজ বা ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মিকে (আই এন এ) সুসংহত করলেন নেতাজি। তিনি হলেন এই বাহিনীর প্রধান সেনাপতি। তৎকালীন জাপানের প্রধান মন্ত্রী জেনারেল তোজো হিদেকিকে প্ররোচিত করে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যৌথভাবে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন। দুই-আড়াই বছরের প্রচণ্ড রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জাপানের কল্যাণে ভারত স্বাধীনতা অর্জন করল। জাপান ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট তারিখে পরাজয় স্বীকার করে নিল। বিজয়ী মিত্রশক্তি প্রধান আমেরিকা পূর্বষড়যন্ত্র মাফিক টোকিও মিলিটারি ট্রাইব্যুনালের আয়োজন করল টোকিওতে। ১১টি দেশের বিচারপতিদের মধ্যে ভারত থেকে একজন বিচারপতি রাধাবিনোদ পাল আসন গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন কলিকাতা উচ্চ আদালতের প্রাক্তন বিচারপতি, আন্তর্জাতিক আইনবিদ এবং কলিকাতা বিশ্ববিদ্যলিয়ের প্রাক্তন উপাচার্য। তাঁর জন্ম পূর্ববাংলার বর্তমান কুষ্টিয়া জেলায়।
তিনি আড়াই বছরের দীর্ঘ বিচারকার্য গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষানিরীক্ষা করে জাপানকে নির্দোষ বলে রায় দেন। অন্য বিচারপতিরা অভিযুক্ত করেন এশিয়ায় আগ্রাসন, গণহত্যা ইত্যাদির জন্য জাপান দায়ী। প্রাক্তন প্রধান মন্ত্রী জেনারেল তোজো হিদেকিসহ ২৫ জনকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত করে মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন শাস্তি প্রদান করা হয়। কিন্তু এই বিচার ছিল আন্তর্জাতিক আইন ও নীতি পরিপš’ী ষড়যন্ত্র মাত্র। বিচারপতি পাল একে প্রহসন, পরাজিতের প্রতি বিজয়ীর উল্লাস বলে কঠোর সমালোচনা করেন। তাঁর রায় বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে যায় সাংবাদিকদের কল্যাণে। বিশ্বের শতাধিক বিশিষ্ট ব্যক্তি এই বিচারের তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানান। সেই থেকে বিচারপতি পাল জাপানে বিখ্যাত এবং শ্রদ্ধার পাত্র। তাঁর এই অবদান জাপানি জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীরা বিস্মৃত হননি। ফলে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে জাপানিদের জোরালো সমর্থন ও বিপুল আর্থিক সহযোগিতা প্রদানের ক্ষেত্রে বিচারপতি পালের অবদানও বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছিল। বিচারপতি পাল ছিলেন গভীরভাবে রবীন্দ্রভক্ত এবং প্রবলভাবে জাতীয়তাবাদী। ১৯১৫ সালে বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর রাজনৈতিক আশ্রয় এবং ১৯২৪ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে জাপানে জাঁদরেল সংবর্ধনা প্রদানকারী এক”ছত্র প্রভাবশালী উগ্রজাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব প্যান-এশিয়ানিস্ট তোওয়ামা মিৎসুরুর সমাধিতে প্রার্থনা করেন ১৯৫২ সালে। তাতে বোঝা যায় কী রকম জাতীয়তাবাদী ছিলেন তিনি।
বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই ১৯৭২ সালের ১০ই ফেব্রুয়ারি তারিখে জাপান স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে ইতিহাস সৃষ্টি করে মার্কিন বলয়ে থেকেও। আমেরিকা ও চিন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বাধীনতার রিরুদ্ধে অব¯’ান নিয়েছিল। ১৯৭৩ সালে হায়াকাওয়া তাকাশির উদ্যোগে জাপান সরকার বঙ্গবন্ধুকে জাপানে সরকারি সফরের আমন্ত্রণ জানান। অভূতপূর্ব ছিল বঙ্গবন্ধুকে প্রদত্ত সেই লালগালিচা বিছানো অভ্যর্থনা! এইসব ঘটনা আমি বিভিন্ন সময় একাধিক রচনায় উল্লেখ করে জাপানি ও বাংলাদেশিকে জানানোর চেষ্টা করে আসছি। আজও বৃহত্তর বাঙালি জানে না জাপান-বাংলা সম্পর্কের ইতিহাস, জানে না কেন জাপানিরা বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন জানিয়েছিল? এও জানা নেই যে, কী বিপুল পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল জাপান সরকারের সমর্থনে জাপানের প্রায় একশটি প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের আর্থ-বাণিজ্যিক ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের জন্য।
কিন্তু গভীর পরিতাপের বিষয় সেইসব পরিকল্পনা ভেস্তে যায় ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর। এক বিরাট দূরত্ব সৃষ্টি হয় জাপান ও বাংলাদেশের মধ্যে। জাপানে আজকে বিস্মৃত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৮৪ সালে যখন জাপানে আগমন করি ছাত্র হিসেবে তখন নিদারুণ বেদনার সঙ্গে লক্ষ করি কোনো প্রবাসী বাংলাদেশি বঙ্গবন্ধুর নাম মুখে নেয় না কোনো অনুষ্ঠানে, সমাবেশে। এমনকি ঘরোয়াভাবেও ভুলেও বঙ্গবন্ধুর নামটি স্মরণ করে না দেখে হতবাক হয়েছিলাম! মাত্র দশ বছরের ব্যবধানে জাপানিরাও বঙ্গবন্ধুকে একেবারেই বিস্মৃত হয়েছেন আঙুলেগোনা কতিপয় বুদ্ধিজীবী ছাড়া। সেই অনভিপ্রেত আঘাত আমার মধ্যে অ¯ি’রতা ও ক্ষোভের আগুন ধরিয়ে দেয়। ১৯৮৬ সাল থেকেই আমি বঙ্গবন্ধুর নাম বিভিন্ন সমাবেশে উচ্চারণ করতে শুরু করি। তখন বাংলাদেশ থেকে ক্রমাগত বেকার তরুণরা জাপানে প্রবেশ করছে অবৈধভাবে আদম ব্যাপারিদের মাধ্যমে ভাগ্যবদলের আশায়। স্বৈরাচারী এরশাদের আমল চলছে দেশে। প্রায় প্রতিদিনই জাপানি পত্রপত্রিকায় বাংলাদেশের সীমাহীন দুর্নীতি, রাজনৈতিক অ¯ি’রতা, গুম, হত্যাকাণ্ড, রাজপথে আন্দোলন, দারিদ্র, অভাবী মানুষের সচিত্র সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। টিভি চ্যানেলগুলোতেও একই ঘটনা। লজ্জায়, দুঃখে, ক্ষোভে জাপানে মুখ দেখানো কী যে কঠিন ছিল মনে পড়লে এখনো শিহরিত হই! কোথাও বঙ্গবন্ধুর নাম নেই। মুক্তিযুদ্ধের কথা নেই। সবর্ত্রই জেনারেল জিয়াউর রহমান ও হোসেইন মুহম্মদ এরশাদের জয়গান। তারাই বাংলাদেশের মহান নেতা। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের তারাই নেতৃত্ব দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু বলে কোনো রাজনীতিক বাংলাদেশে কখনোই ছিলেন নাÑÑএমন মনোভাব বাংলাদেশে এবং প্রবাসের বাংলাদেশি সমাজেও। তাজ্জব ব্যাপার!
একজন বাঙালি হিসেবে আত্মতাগিদে সাহস করে জাপানে বঙ্গবন্ধু পরিষদ জাপান শাখা গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করলাম ১৯৯০ সালে তৎকালীন বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রথম সচিব রবীন্দ্রনাথ ও বঙ্গবন্ধুর পরমভক্ত মোঃ মিজারুল কায়েসের সঙ্গে আলোচনা করে। তিনি বললেন, বৈধভাবে জাপানে আছেন, এগিয়ে যান। বঙ্গবন্ধু পরিষদের শাখা গঠন করলাম কতিপয় প্রবাসী বন্ধুকে নিয়ে। ১৯৯১ সালে প্রথম সম্মেলন ও শোক দিবস হিসেবে ১৫ই আগস্ট উদযাপন করা হলো ঘটা করে। বাংলাদেশ থেকে আমন্ত্রিত হয়ে এলেন বিচারপতি কে এম সোবহান এবং কণ্ঠশিল্পী আবদুল জব্বার। কমপক্ষে পাঁচশত বঙ্গবন্ধু সমর্থক অংশগ্রহণ করেছিলেন অনুষ্ঠানে। যাদের অধিকাংশই ভিসাহীন। পরিষদের জন্য প্যাড, খাম, প্রচারপত্র, পোস্টার, চাঁদার টিকিট ইত্যাদি সবই আমাকে ডিজাইন করতে হয়েছে। এমনকি সম্মেলনের উপ¯’াপনাও করতে হয়েছে আমাকেই। এই প্রথম জাপানে কোনো অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করা হয়। জানি না এই উদ্যোগ না নিলে কেউ বঙ্গবন্ধুর নাম জাপানে স্মরণ করতেন কিনা! অথবা বঙ্গবন্ধু পরিষদ গঠন করতেন কিনা! কারণ সেরকম দুঃসাহস আমি কারোর মাঝেই দেখিনি।
বঙ্গবন্ধু পরিষদ গঠনের পরপরই অনেকে আগ্রহী হয়ে ওঠেন আওয়ামী লীগ শাখা গঠনের জন্য। শুরু হয় নেতৃত্বের কোন্দল। চরম বাদানুবাদের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ গঠিত হয়। কেন্দ্রিয় আওয়ামী লীগ অনুমোদনও দেয়। কিন্তু বিদ্রোহী দল আরেকটি শাখা ঘোষণা করে। সেই কোন্দল আর নিরসন হয়নি। বরং সেটা এখন এতই বিস্তৃত হয়েছে যে চারটি শাখায় বিভক্ত সমর্থকরা। কেউ কোনোদিন উল্লেখযোগ্য কোনো সমাবেশ বা অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে পারেনি আজ পর্যন্ত।
বঙ্গবন্ধু পরিষদ তার গতিতে চলছিল। আমিও কিছুদিন জড়িত ছিলাম। পরে ব্যস্ততার কারণে সরে আসি। তবে যত সম্মেলন এবং স্মারক প্রকাশনার কাজ হয়েছে অধিকাংশই বঙ্গবন্ধু পরিষদ করেছে। যেগুলোর সম্পাদনা ও নির্দেশনায় আমিই ছিলাম। অবশ্য আওয়ামী লীগের প্রথম শাখাটিকে আমি সমর্থন দিয়েছি কিন্তু কোনোকালেই সদস্য বা কর্মী ছিলাম না। তথাপি, বিভিন্ন সময় আওয়ামী লীগের সমাবেশের পোস্টার এঁকেছি। দূতাবাসে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারদাবিকৃত আওয়ামী লীগের প্রদত্ত স্মারকপত্র আমিই লিখে দিয়েছি একাধিকবার। শুধু তই নয়, জাপাানে আমার প্রকাশিত ও সম্পাদিত মাসিক কাগজ “মানচিত্র” হয়ে উঠেছিল বঙ্গবন্ধু পরিষদ ও আওয়ামী লীগের মুখপত্রস্বরূপ। প্রধান মন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা জাপান সফরে এলে পরে আওয়ামী সমর্থকদের নাগরিক সংবর্ধনায় প্রদত্ত মানপত্র আমি দুবার লিখে দিয়েছি অথচ আমিই আমন্ত্রণ পাইনি অনুষ্ঠানে! বঙ্গবন্ধু পরিষদ গঠনের প্রথম উদ্যোক্তা হিসেবে নেত্রীর পাশে বসা তো দূরের কথা, কেউ পরিচয়টুকু করে দেয়ার মতো সৌজন্যও দেখায়নি! অথচ বঙ্গবন্ধু পরিষদ গঠিত হয়েছিল বলেই অনেকেই নেতা বলে পরিচিতি পেয়েছেন জাপানে এবং বাংলাদেশেও সম্মানিত হয়েছেন। বাংলাদেশ-জাপান দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে জোরদার করার ক্ষেত্রে তাদের কোনো ভূমিকাই নেই, যা ছিল প্রত্যাশিত। না নিতে পেরেছেন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর নামে বা মানুষের কল্যাণের জন্য কোনো প্রকল্পÑÑনা জাপানে বঙ্গবন্ধুর নামে কিছু করতে পেরেছেন। যেটা করা কঠিন কিছুই ছিল না। এখন কর্মকাণ্ডহীন বঙ্গবন্ধু পরিষদ এবং আওয়ামী কার্যক্রম নেই বললেই চলে। বঙ্গবন্ধুর দল বিগত ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় কিন্তু বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে একটি স্মারকগ্রš’ প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি জাপান-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর অবদান নিয়ে। নীরবে এই অব¯’া দেখে আসছিলাম দীর্ঘদিন ধরে। এবং গভীরভাবেই অনুভব করছিলাম, বঙ্গবন্ধুর প্রভাব ক্রমশ ম্রিয়মাণ হয়ে আসছে মানুষের মধ্যে। এই চিরআত্মত্যাগী মহান নেতার প্রতি তার সমর্থকদের শ্রদ্ধা- ভক্তি-ভালোবাসার টান ক্রমশ শিথিল হয়ে আসছে বললে কি মিথ্যে বলা হবে? বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনকে জাতীয় শিশু দিবস করা হয়েছে তাতেও কি কোনো সাড়া দেখা যাচ্ছে? শিশুদের জন্য একটি মুখপত্র, একটি টিভি চ্যানেল, বার্ষিক আনন্দউৎসবÑÑখুব কি কঠিন কাজ? বরং অনিয়ম, আত্মসাৎ, দুর্নীতি, অপচয়ের জয়জয়কার সর্বত্র, সর্বক্ষেত্রে। সাম্প্রদায়িক হিংসা-বিদ্বেষ, ভাঙচুর লেগেই আছে। এই কি ছিল স্বাধীনতার মূলমন্ত্র? এসবের জন্যই কি বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা চেয়েছিলেন?
কাউকে না কাউকে এগিয়ে আসতে হয় আত্মতাগিদে দায়িত্বের খাতিরে এটাই বুঝি নিয়ম। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উদযাপনের প্রতীক্ষায় ছিলাম। সে উপলক্ষে একটি স্মারকগ্রš’ লেখার প্র¯‘তি নি”িছলাম। সংগ্রহ করে আসছিলাম নানা তথ্য ও দলিলপত্র যা বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে জাপানে। ঢাকার একটি প্রকাশনা সং¯’ার সঙ্গে প্রতীক্ষাও করেছিলাম পাণ্ডুলিপিটি দেব বলে। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বাংলা একাডেমির একজন উচ্চপদ¯’ কর্মকর্তা যিনি বহুবিধ পুরস্কারে ভূষিত একজন ফরিদপুরী এবং এই বছর (২০২৪) একাডেমি কর্তৃক সাহিত্য পুরস্কারও পেয়েছেন, আমাকে ফোন করে বঙ্গবন্ধু ও জাপান সম্পর্ক নিয়ে একটি পাণ্ডুলিপি দেবার জন্য অনুরোধ করলেন। একাডেমি বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে ১০০টি গ্রš’ প্রকাশ করবে। জাপান-বঙ্গবন্ধু সম্পর্ক নিয়ে লেখার আর কেউ নেই। আমি প্রত্যাখান করি, কেননা অন্যখানে আমি প্রতীজ্ঞাবদ্ধ। কিন্তু বারংবার তার অনুরোধে তাকে “বঙ্গবন্ধু এবং জাপান সম্পর্ক” পাণ্ডুলিপিটি পাঠাই ওই বছরের অক্টোবর মাসে। প্রতীজ্ঞাবদ্ধ ঢাকার প্রকাশকের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিই। সেই পাণ্ডুলিপি চার বছর পড়েছিল একাডেমিতে কোনো কারণ দর্শানো ছাড়াই! শেষে খবর পেলাম একাডেমিতে কাগজ নেই! স্মারকগ্রšে’র মুখ দেখার আনন্দটাই মাটি হয়ে গেল! এ তো লেখকের প্রতি অবমাননাস্বরূপ! একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠানে বই প্রকাশের জন্য কাগজ নেই! অবমাননা শুধু লেখকের প্রতিই নয়, খোদ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিও! তাই নয় কি? পাণ্ডুলিপি দিয়ে কি অপরাধ করেছি? এই তো বঙ্গবন্ধুর প্রতি একাডেমির ভালোবাসার নমুনা। স্মারকগ্রš’ প্রকাশ করতে কি চার বছর সময় প্রয়োজন হয়? যখন সব আশা ও উত্তাপ শীতল হয়ে যায়!
পাণ্ডুলিপিটি ফিরিয়ে আনা হলো এক বন্ধুর মাধ্যমে। প্রকাশ করল অন্য এক পাবলিশার্স। পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, ফেইসবুকেও আমি তুলে ধরেছি। কিন্তু জাপান থেকে বঙ্গবন্ধু বা আওয়ামী সমর্থক দু-একজন ছাড়া কেউ অভিনন্দন জানায়নি! কোনো সাড়াশব্দই নেই! নেই উ”ছ¡াস! জানি না কী কারণ? বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কি আমাদের আগ্রহ এবং ভালোবাসা ক্রমেই মিলিয়ে যাচ্ছে? তাই যদি হয়, তাহলে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতা তাদের কাছে কী হিসেবে বিবেচিত বা আদৃত? স্বনামধন্য ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুনের মন্তব্যই কি সঠিক যে, বঙ্গবন্ধু একটি অনিচ্ছুক জাতিকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন?
শিশুসাহিত্যিক, কথাসাহিত্যিক ও গবেষক