কৃষিভিত্তিক শিল্প ও কৃষক কৃষিতে বাংলাদেশের স্বস্তি
ড. আহমদ আল কবির
বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির সকল আশা-আকাক্সক্ষা, চিন্তা-চেতনা ও আমাদের ভবিষ্যৎ কর্মসূচির একজন মহানুভব ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর চিন্তা-ভাবনাকে নিয়ে আমরা এই দেশটাকে যেমন তৈরি করেছি, ঠিক পাশাপাশি এই দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি। বঙ্গবন্ধুর জন্মের মাধ্যমে, আমরা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠিত করেছি। সেই দেশে আমাদের যে অবস্থা, সেই অবস্থাটিকে আমরা পাকিস্তানি আমলে আমাদের দেশটিতে যে রকমের ছিলো বিভিন্ন ধরনের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার সমস্যা। সেগুলোকে গত ৪০-৫০ বছরে আমরা কাটিয়ে উঠেছি। রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমানে অর্থনৈতিক মুক্তির লড়াইয়ে আমরা নতুন একটি অবস্থানে ফিরে এসেছি। আমরা দেশকে তুলে ধরেছি এবং আমাদের দেশের সকল ক্ষেত্রে আমরা নতুন একটি অবস্থানে দাঁড়িয়েছি। এর মূল কারণ হচ্ছে সঠিক নেতৃত্ব এবং সঠিক সঠিক দিকনির্দেশনা।
রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার যেমন বলিষ্ঠ নেতৃত্ব আছে, আবার তাঁর মাঝে সকল গুণাগুণও আছে। পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া অর্থনৈতিক মুক্তির নিদের্শনা যেগুলো ছিলো, সেগুলোকে তিনি প্রতিটি স্তরে কাজে লাগাচ্ছেন। এর প্রমাণস্বরূপ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমাদের কৃষিকে মুক্ত করতে। কৃষি ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতির মাধ্যমে আমাদের দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। শুধু ধান এবং চাল নয়, আমাদের অবস্থা কিন্তু মাছ ও অন্যান্য কৃষিজাত পণ্য, সবজি এবং তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য সকল ধরনের কৃষি পণ্য বা কৃষিভিত্তিক শিল্পকে ব্যাপকভাবে প্রসার করেছেন রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা। তাঁর পরবর্তী পর্যায়ে যদি আমরা ধরি সর্বজনীন যে শিক্ষা সাধারণ মানুষের গবির ছেলেমেয়েদের জন্য শুধু রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা যে শিক্ষাকে বিশেষ করে মেয়েদের জন্য শিক্ষাকে অবৈতনিক করেননি তা নয়। এর বাইরেও রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা প্রায় ৩৫ কোটি বই প্রতিবছর সমস্ত ছেলেমেয়েদের হাতে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন।
এর পাশাপাশি কারিগরি শিক্ষাকে ব্যাপকভাবে প্রসারের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন। এই কাজটি সহজ নয়। আমরা শিক্ষা ক্ষেত্রে একটি বিপ্লব ঘটাতে সক্ষম হয়েছি রাষ্ট্রীয়ভাবে। তবে আগামীতে মৌলিকভাবে আরও কিছু এই দ্বারকে অক্ষণ্ন্ন রেখে কাজ করে আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাবো। কৃষি এবং শিক্ষার বাইরে আমাদের স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক উন্নতি ঘটেছে। প্রতিটি ওয়ার্ডে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করে, স্বাস্থ্যসেবাকে একেবারে গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আগে কমিউনিটি ক্লিনিক নিয়ে অনেকেই বিভিন্ন ধরনের মন্ত্যব্য করেছিলেন। বর্তমানে কমিউনিটি ক্লিনিক নিরবিচ্ছন্ন স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করছে এবং মানুষের মধ্যে কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব নেই। বিশ্বের খুব কম দেশে এ ধরনের উন্নয়নশীল দেশে এ ধরনের পরিবর্তন হয়েছে। সেটার দৃষ্টান্ত বিরল। আমাদের দেশে কৃষি, খাদ্য, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ছাড়াও অন্যান্য খাতে আমরা ব্যাপকভাবে সফলতা অর্জন করেছি। যেমন আমরা ফার্মাসিউটিক্যাল খাতে অনেক উন্নতি করেছি, লক্ষণীয় যে, বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশে আমাদের উৎপাদিত ওষুধ যাচ্ছে। সংবাদপত্রে দেখেছি আমরা আমাদের দেশের একটি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির ওষুধ এফডিএর অনুমোদন পেয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশনের।
এর মানে হচ্ছে ব্যাপকভাবে আমাদের ওষুধের মান এবং সবকিছু বৃদ্ধি করে বিশ্ব বাজারে আমরা কিন্তু একটি বড় ধরনের পণ্য হিসেবে আমরা আর্বিভূত হয়েছি। বাংলাদেশিরা একদিকে যেসব দেশের ভেতরে উন্নয়ন অন্যদিকে আমাদের জনশক্তিকে বিদেশে রপ্তানি করে আমরা ব্যাপকভাবে আয় অর্জন করছি। ২০০৬ সালে বাংলাদেশের রেমিটেন্স আয় ৫ বিলিয়ন ডলারের নিচে ছিলো সেটা আজ কিন্তু বেড়ে গিয়ে প্রায় ৩০ বিলিয়ন অতিক্রম করেছে। এই যে ব্যাপক রেমিটেন্সের উল্লম্ফন এইটি কিন্তু ছোট করে দেখার কিছু নেই। অন্যদিকে আমরা পোশাক শিল্পসহ অন্যান্য শিল্পপণ্য বিদেশে ব্যাপকভাবে রপ্তানি করছি। আমাদের রপ্তানি আয় বেড়েছে। অন্যদিকে আমাদানি হারও বেড়েছে আমরা নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য শিল্পজাত পণ্য সামগ্রী, বিশেষ করে যন্ত্রপাতি আমদানি করে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আমরা নতুন এক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে এগোচ্ছি। দেশের ভেতরে যদি আমরা তাকাই তবে দেখবো আমাদের সমুদ্র বন্দরগুলো চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে ক্যাপাসিটি বা ধারণক্ষমতা ব্যাপকভাবে বৃদ্বি পেয়েছে গত ১০-১৫ বছরে।
পাশাপাশি পায়রা সমুদ্রবন্দর, পদ্ম সেতুসহ অন্যান্য সমুদ্রবন্দরের ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে। দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হচ্ছে পদ্ম সেতু। মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে কিংবা বঙ্গবন্ধু টানেল। রেল ব্যবস্থা। এই যে আমাদের অবস্থা, এগুলো কিন্তু আমাদের যোগাযোগ, তথ্য প্রযুক্তি এবং অন্যান্য খাতে যে আমাদের ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে সেগুলো বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আর্কষণ করেছে। যে দেশটি একসময় তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে পরিচিত ছিলো। আমেরিকার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ একটি তলাবিহীন ঝুড়ি’। সেই দেশটি কিন্তু এখন বলছে বাংলাদেশ বিশ্বের কাছে একটি উন্নয়নের দৃষ্টান্ত। শুধু তাই নয় জাতিসংঘসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশকে একটি ইমার্জিং টাইগার হিসেবে চিহ্নিত করেছে এবং বিশ্বের মুষ্টিমেয় যে কয়েকটি দেশ খুব দ্রুত উন্নতি করছে তার মধ্যে বাংলাদেশও চিহ্নিত হয়েছে।
করোনা মহামারির সময় আমরা দেখেছি বাংলাদেশের অর্থনীতি কতোটা শক্ত। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশ এই কোভিড-১৯ এর সময় দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। কিন্তু আমাদের অর্থনীতি এই আঘাতটাকে সুন্দরভাবে মোকাবেলা করতে পেরেছে এবং আমাদের সার্বিক অর্থনীতি অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হলেও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। এটি কিন্তু একটি বড় ধরনের দৃষ্টান্ত এবং বিশ্বের সকল উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশ সকলেই বাংলাদেশের এই অভিজ্ঞতাকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। আমরা যদি তাকাই আরেকটি জিনিস দেখুন আমাদের যে অগ্রগতি হচ্ছে এই অগ্রগতির মাধ্যমে আমরা কিন্তু এখন একটি নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছি। ২০২৫-২৬ সালে আমরা মধ্যম আয়ের দেশের পূর্ণ স্বীকৃতি পাবো। যদিও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ আমাদের অর্থনীতিতে কিছুটা চাপ এসেছে। নিত্যপণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী। সাধারণ মানুষের জন্য কিছু কষ্ট হচ্ছে, যা অনাকাক্সিক্ষত। সরকার চেষ্টা করছে নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে আসার। আমরা আশা করবো, খুব তাড়াতাড়িই নিত্যপণ্যের দাম একটা সহনীয় পর্যায়ে চলে আসবে।
বিশ্বের দরবারে গরিব হিসেবে চিহ্নিতভাবে যে দেশটিতে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়েও ক্ষুধা, দারিদ্র্য এবং অন্নবস্ত্রবিহীন মানুষের দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হতো, ঠিক সেই দেশটা বিশ্বের কাছে উন্নয়নের মডেল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। আমাদের লক্ষ্য এখন আমরা বিশ্বের মধ্যে ৪২তম অর্থনীতি হলেও আমরা কিন্তু আমাদের লক্ষ্য ২০৩০ সালে আমরা বিশ্বের ২৫তম অর্থনীতি হবো। ২৫তম অর্থনীতি যদি আমরা ২০৩০ সালে হতে পারি, তবে অবশ্যই ২০৪১ সালে আমরা রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার স্বপ্ন এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী একটি উন্নত দেশ হিসেবে বিশ্বের কাছে দাঁড়াতে পারবো এই প্রত্যাশা আমরা রাখি। জয় বাংলা। পরিচিতি : সাবেক চেয়ারম্যান, রূপালী ব্যাংক