ঘোড়াশাল সার কারখানার উৎপাদন ব্যাহত
মো. আখতারুজ্জামান : [১] উন্নত প্রযুক্তির ঘোড়াশাল-পলাশ ইউরিয়া সার কারখানা দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম ইউরিয়া উৎপাদনকারী। পর্যাপ্ত মজুত ব্যবস্থা না থাকায় নিয়মিত চালু রাখা যাচ্ছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন রেল সংযোগ ব্যবস্থা থাকলেও দ্রুত সরকার পরিবহন করা গেলে এই সমস্যা থাকত না। [২] বর্তমানে সার উৎপাদন করে দ্রুত তা বাজারে সরবরাহ করতে না পারা এবং ধারণক্ষমতার বেশি উৎপাদিত সার সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় সময়ে সময়ে উৎপাদন বন্ধ রাখতে হচ্ছে কারখানা কর্তৃপক্ষকে। [৩] চলতি মার্চ মাসের মাঝামাঝি থেকে এটি উৎপাদনে গেছে। কৃষি উৎপাদনের গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ ইউরিয়া সার, আমদানি-নির্ভরশীলতা কমিয়ে এই সার উৎপাদনে দেশকে স্বনির্ভর করে তোলাই ছিল এই কারখানা স্থাপনের মূল উদ্দেশ্য।
[৪] ঘোড়াশাল পলাশ ইউরিয়া ফার্টিলাইজার প্রকল্পের পরিচালক রাজিউর রহমান মল্লিক বলেন, টানা উৎপাদনকে ধারণ করার মতো স্টোরেজ (মজুত) সক্ষমতা না থাকায় মাঝেমধ্যেই কারখানা বন্ধ রাখতে হচ্ছে। কারখানা থেকে সার পরিবহনে রেলপথ না থাকার ঘটনাও উৎপাদনকে ব্যাহত করছে।
[৫] কারখানার দৈনিক উৎপাদন সক্ষমতা ২ হাজার ৮০০ টন, সেই হিসাবে টানা সাত দিন সার উৎপাদন করলেই বাল্ক ইউরিয়া স্টোরেজ পূর্ণ হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে জায়গার অভাবে কারখানা বন্ধ করে দিতে হয়।
[৬] রাজিউর বলেন, এখন লিন পিরিয়ড চলছে বলে সারের চাহিদা কম। তবুও বিসিআইসি এখন প্রায় দিনই ৩ হাজার মে. টন করে সার সরবরাহ নিচ্ছে। তবে সার বিক্রি করে ঋণের কিস্তি পরিশোধের যে লক্ষ্য ছিল সেটা পূরণ হয়নি।
[৭] চলতি বোরো মৌসুমে সারের চাহিদা কমে যাওয়ার কারণে উৎপাদিত সার কারখাতেই রয়ে যাচ্ছে। কর্মকর্তারা জানান, গত বছরের নভেম্বরে কারখানাটির উদ্বোধন হলেও তা বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করেছে মার্চের মাঝামাঝিতে। নভেম্বর বা ডিসেম্বরের দিকে পুরোদমে সারের বাণিজ্যিক উৎপাদন করতে পারলে দেশের বোরো মৌসুমে এই সার ব্যবহার করা যেত।
[৮] যেহেতু কারখানাটির বাণিজ্যিক উৎপাদন অনিশ্চয়তায় ছিল, সে কারণে বিসিআইসি অন্যান্য উৎস থেকে সার এনে মৌসুমের চাহিদা পূরণ করে। যে কারণে নতুন এই কারখানার সারগুলো আর ব্যবহার হয়নি।
[৯] সাড়ে ১৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত নতুন এবং সর্বাধুনিক এই কারখানাটির মোট মজুত সক্ষমতা ১ লাখ ১৫ হাজার টন। এরমধ্যে বাল্ক ইউরিয়া স্টোরেজ এর ধারণ ক্ষমতা ১ লাখ টন এবং ব্যাগড ইউরিয়ার ধারণ ক্ষমতা ১৫ হাজার টন।
[১০] নতুন এ কারখানাটির রেডিনেস ডেমোনস্ট্রেশন শেষে সম্প্রতি এর বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয়েছে। পরীক্ষামূলক পর্যায়েই সার উৎপাদন করা হয়েছে ১ লাখ ৪ হাজার ৫৪৭ টন, যেখান থেকে ব্যাগিং বা বস্তাজাত করা হয়েছে ১৮ হাজার ৬১৪ টন, বাকিটা বাল্ক স্টোরেজে রাখা হয়েছে।
[১১] এদিকে কারখানাটি নির্মাণে নেওয়া বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়ছে। এমতাবস্থায়, সার বিক্রি করে কারখানাটি যথেষ্ট আয় না করতে পারায় এগিয়ে আসতে হয়েছে সরকারকে। ফলস্বরূপ সরকারি ভর্তুকির অর্থেই জাপানি ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি পরিশোধ করা হয়েছে।
[১২] গত ১৩ মার্চ জাপানি মুদ্রায় ৫৩৭ কোটি ৩৫ লাখ টাকা কৃষি ভর্তুকির তহবিল থেকে পরিশোধ করা হয়েছে বলে শিল্প মন্ত্রণালয় নিশ্চিত করেছে। যদিও ঋণের এই কিস্তি পরিশোধ করার কথা ছিল নতুন কারখানাটির সার বিক্রি থেকে।
[১৩] বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন (বিসিআইসি) এবং ঘোড়াশাল পলাশ ইউরিয়া সার কারখানার কর্মকর্তারাও বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, উৎপাদিত সার বিক্রি করতে না পেরে এবারও ভর্তুকির টাকা থেকেই বিদেশি ঋণের টাকা পরিশোধ করা হয়েছে।
[১৪] ঘোড়াশাল পলাশ ইউরিয়া ফার্টিলাইজার প্রকল্পের পরিচালক রাজিউর রহমান অবশ্য আশাপ্রকাশ করেন যে, মে মাসের পরবর্তী কিস্তির ৩৩০ কোটি টাকা কারখানার নিজস্ব আয় থেকে পরিশোধ করা যাবে।
[১৫] ফেব্রুয়ারির শেষদিকে সার কারখানা প্রকল্পের স্টিয়ারিং কমিটির একটি সভা হয়েছে। বৈঠকে কারখানা থেকে সার পরিবহনে রেলপথকেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
[১৬] ২০১৮ সাল থেকে প্রকল্পটি শুরু হলেও রেলপথ নির্মাণের মেয়াদ দুইবার বেড়েছে, সর্বশেষ তা বাড়িয়ে করা হয়েছে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। স্টিয়ারিং কমিটি রেল সংযোগ নির্মাণের মেয়াদ আরো দুই বছর বাড়ানোর জন্য নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে।
[১৭] তবে কারখানার জন্য অত্যন্ত জরুরী এই রেলপথ নির্মাণ কাজ এখনও শুরু না হওয়ায় দেখা দিয়েছে লজিস্টিকস সংকট। এ সংকট দীর্ঘমেয়াদি হবেই বলে ধারণা করা হচ্ছে, কারণ রেলপথ তৈরি করতে আড়াই বছরেরও বেশি সময় লাগতে পারে।
[১৮] বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রধান প্রকৌশলী (পূর্বাঞ্চল) মো. আবু জাফর মিয়া জানান, চলমান একটি প্রকল্পের অংশ হিসেবে তারা প্রায় ১০ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করবেন।
[১৯] তিনি বলেন, সার কারখানার ভেতরে আড়াই কিলোমিটার রেলপথ স্থাপনের কাজ সম্প্রতি শুরু করা হয়েছে। তাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হচ্ছে। এখন কারখানার বাইরের সাড়ে ৭ কিলোমিটার রেলপথ স্থাপনের কাজ ক্রয় প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
[২০] জাফর আরও বলেন, সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির কাছে দরপত্রে পাওয়া প্রস্তাব উপস্থাপন করা হবে। এরপর ঠিকাদারের সাথে চুক্তি চূড়ান্ত করা হবে। ঠিকাদার নিয়োগের পরে নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করতে প্রায় এক বছর লাগতে পারে।
[২১] রেল সংযোগের সুবিধা না থাকার পাশাপাশি আরো কিছু সমস্যা কারখানার উৎপাদন কাজে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। এরমধ্যে রয়েছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসনের ঘাটতি এবং চলমান রেগুলেটিং অ্যান্ড মিটারিং স্টেশন (আরএমএস) স্থাপনের কাজ।
[২২] প্রকল্পের জিওবি অংশের মেয়াদ দুই বছর বাড়ানোর জন্য নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে প্রকল্পের স্টিয়ারিং কমিটি। এই সময়ের মধ্যে মূলত রেলপথ তৈরির কাজ করা হবে। তবে কর্মকর্তারা বলছেন, রেলপথ তৈরি করতে আড়াই বছরেরও বেশি সময় লাগতে পারে। কারখানা থেকে ঘোড়াশাল স্টেশন পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ করা হবে।
[২৩] এছাড়া কারখানার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বসবাসের জন্য আবাসন-সহ আনুসঙ্গিক অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণ করা হবে। যা বাস্তবায়নে ৬ মাস লাগতে পারে। অন্যদিকে তিতাস কর্তৃপক্ষ, আরএমএস স্থাপন কাজ সম্পন্ন করতে আগামী আগস্ট পর্যন্ত সময় চেয়েছে।
[২৪] তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিষ্ট্রিবিউশন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. হারুনুর রশীদ মোল্লাহ্ জানান, ঋণপত্র (এলসি) খুলতে সময় লেগেছে। বর্তমানে এলসি করা হয়েছে। ভৌত অবকাঠামোর কাজ শুরু হয়েছে। যন্ত্রপাতি বিদেশ থেকে প্রকল্প সাইটে আনা হয়েছে। আগষ্ট ২০২৪ এরমধ্যে নতুন আরএমএস স্থাপনের কাজ শেষ হবে।