কোনটা বেশি জরুরি : নিত্যপণ্যের দাম কমানো, নাকি মানুষের আয় বাড়ানো?
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
বাংলাদেশে গত কয়েক বছর ধরে উচ্চারিত ও আলোচিত বিষয় হলো দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি। কয়েক বছর ধরেই করোনার পর অর্থাৎ, ২০২০ সাল থেকেই বাংলাদেশে চাল, ডাল, পেঁয়াজসহ তেলের দাম ও অন্যান্য পণ্যের দাম যেভাবে বাড়ছে তা নিয়ে নিম্ন ও মধ্যআয়ের মানুষ ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ। সরকার সেটা বুঝে এমনকি চেষ্টাও করছে, বিভিন্ন নিত্যপণ্যের উপর থেকে শুল্ক প্রত্যাহারের মতো কার্যক্রমও করছে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। একটা বড় ধারণা তৈরি হয়েছে যে, সরকার ব্যবসায়ীদের সাথে পারছে না। এমনকি শুল্ক প্রত্যাহারের মতো ঘটনা সরকার ঘটিয়েছে, তার পুরো সুবিধা ব্যবসায়ীরা নিয়েছে, তারা অনেক বেপোরোয়া হয়েছে। জনগণ এটির সুফল কিছুই পায়নি। একটা অংশ গণমাধ্যমকে দোষারোপ করছে যে, বেশি কাভারেজের কারণেই চারপাশে এতো হৈ চৈ হচ্ছে।
তেল, পেঁয়াজ, সবজির দাম কিন্তু এখন কমেছে ও প্রতিনিয়ত কমছে। সেটা কিন্তু গণমাধ্যম বলছে না। এরকম একটা অভিযোগ আছে। একটা বিষয় বলে রাখা ভালো যে, চাহিদা এবং যোগানের যে সর্ম্পক বাজারে সেটা বাংলাদেশে সেই অর্থে তেমন কোনো সমস্যা তৈরি করেনি। কেন্দ্র থেকে প্রান্ত পর্যন্ত সরবরাহের কোনো ঘাটতি নেই। এই জায়গায় সরকার সফল হয়েছে এবং ব্যবসায়ীরাও সফল হয়েছে। কিন্তু দাম সহনীয় হচ্ছে না। অর্থাৎ, সংকটসরবরাহের নয় বরং সংকট দামে। বাজার ব্যবস্থাপনায় মানুষ একধরনের অসন্তোষ প্রকাশ করছে। কোথাও না কোথাও একটা ঘাটতি আছেই, না হলে এমন হবে কেন?
মানুষের মধ্যে একধরনের আতঙ্ক বিরাজ করে রোজার শুরুতে ও ঈদের সময়। তখন আমরা দেখি যে ব্যবসায়ীদের মধ্যে নীতি-নৈতিকতার সংকট আছে। বড় ধরনের প্রশ্ন থাকে তাদের নিয়ে এবং তাদের মধ্যে অতি মুনাফার অন্তহীন একটা লোভ আছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছু বড় কোম্পানির একটা একচেটিয়াত্ব আছে। কারণ ভোগ্যপণ্যের বাজার কয়েকটি পণ্যের কাছে বন্দি হয়ে আছে। ঠিক এ জায়গায় আমরা দেখি যে বাজারের দাম বাড়ার কারণে ব্যবসায়ীরাও বলেন ‘সরকার জানেন’। সম্প্রতি ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের সাথে দেখা হলে তিনি স্বীকার করেন যে, ‘মূল্যবৃদ্ধির একটা বড় কারণ হচ্ছে চাঁদাবাজি’। এমনকি কারওয়ান বাজারে মাল ঢোকা মাত্রই প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি শুরু হয়, যার ফলে দাম এক লাফে বহুগুণ বেড়ে যায়’। আমরাও এটা বিশ্বাস করি, চাঁদাবাজি বন্ধ করতে পারলেই দাম অর্ধেক দামে কমে যাবে।
জ্বালানি তেলের দাম কিন্তু যৌক্তিকভাবে পর্যায়ে নিয়ে আসলে বাজারে এর একটা নেতিবাচক প্রভাব পরতো। কিন্তু আমরা সেটাও দেখতে পাচ্ছি না। এগুলো সবই সরকারের নীতি-নৈতিকতার কৌশলের দুর্বলতা বা রাজনৈতিক সদিচ্ছার দুর্বলতা। সরকার যদি চাঁদাবাজি বন্ধে র্ব্যথ হয় তবে আমাদের বলার আর কিছুই নেই। ডলার সংকটের কারণে বহুদিন বাজার অস্থির হয়ে আছে। করোনাকাল থেকেই আমরা দেখছি অর্থনৈতিক দুরবস্থা চলছে। মানুষের আয়-রোজগার কোনো কিছুই বাড়ছে না। কিন্তু জিনিসপত্রের দাম ঠিকই বাড়ছে। সরকার যে উন্নয়নের কথা বলে, জিডিপি প্রবৃদ্ধির কথা বলে এবং মানুষের মাথপিছু আয়ের কথা বলে তা কিন্তু মানুষের জীবনে দৃশ্যমান না। মানুষ বলে আমাদের দেশ বিশ্বের অন্যতম আর্থিকভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠছে তাহলে আমার জেনারেশনের ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসছে না কেন? কেন আমার জীবন এতো কষ্টের? এ প্রশ্নের উত্তর মানুষকে কে দেবে? তা এক বড় প্রশ্ন।
৮০ শতাংশ মানুষ এখন গ্রামে বাস করছে। বাকি ২০ শতাংশ শহরে বসবাস করলেও উভয় ক্ষেত্রেই একটা বড় অংশ নিম্নমানের জীবনযাপন করছে। কারণ মানুষের আর্থিক অবস্থা অনুন্নতির দিকে যাচ্ছে। গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ কৃষি কাজ করছে, গো পালন করছে কিংবা ছোট ছোট ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে ব্যবসা করে দুমুঠো ভাত জোগাড় করছে। শহরের অবস্থা আরও কঠিন। আমি জানি এনজিওতে এ নিয়ে অনেক কাজ হচ্ছে। শহরের দারিদ্রতা নিয়ে কথা হয় কম। গ্রামের মানুষ টিকতে না পেরে শহরে চলে আসছে। একটা কথা বোধহয় আমরা বলতে ভুলে যাচ্ছি, শুধু কি দ্রব্যমূল্য? হাসপাতালে সহজে কোনো চিকিৎসা মেলে না, সহজ কোনো পরিবহন ব্যবস্থা নেই, সন্তানের শিক্ষার সুযোগ কমে আসছে। এমনকি বাড়ছে না দক্ষতা বাড়ানোর সুযোগ। সেই অর্থে দক্ষতা অনুসারে মানুষের আয়ের কোনো সুযোগ তৈরি হচ্ছে না। সবচেয়ে বড় কথা হলো বৃদ্ধ বয়সে মানুষের জীবনটা যে নিশ্চিন্তে কাটবে সেটাই বাংলাদেশে নেই। সুতরাং কিছুই আসলে নেই বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের জন্য।
মানুষের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার সাথে আসলে সরকারের উন্নয়ন গল্পের মানুষের জীবনের কোনোকিছুই মিলছে না, অনেকেই হয়তো অভিমান করতে পারে এ কথা শুনে। জনসংখ্যার বড় অংশই এ অবস্থায় পড়েছে, আর ক্ষুদ্র অংশ অনেক আনন্দ, অনেক আয় নিয়ে চলছে এটাকে আর্থিক বৈষম্য বলে। দেশের আয় বৃদ্ধি থাকা সত্ত্বেও নাগরিক সুযোগ সুবিধা থেকে পিছিয়ে থাকাকে উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ বলে। সরকার চেষ্টা করছে ঠিকই, তবে দ্রব্যমূল্যের দাম কমাতে পারবে না আমরা নিশ্চিত। কারণ এখানে বিশাল একটা ক্ষমতা তৈরি হয়েছে। রাষ্ট্রের ভেতরে আরেকটি রাষ্ট্র তৈরি হয়েছে, তারা কাউকে পাত্তা দিচ্ছে না। তারা তাদের মতো একটা মুনাফা জগৎ তৈরি করে ফেলেছে, একটা শাসন ব্যবস্থা তৈরি করে ফেলেছে যেখানে আসলে মানুষের কোনো অংশগ্রহণ নেই। তাহলে আমরা করবো কী? বা সরকারই কী করবে? সরকার চেষ্টা করুক অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের। সেটা করতে গেলে সুশাসন দরকার সবচেয়ে বেশি। ব্যাংক ও আর্থিক খাতে তার কোনো লক্ষণ আমরা দেখতে পাচ্ছি না। অনেক বছর ধরে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ স্থগিত মানুষের আয় বাড়ানো কিংবা কর্মসংস্থান বাড়ছে না। সব থমকে আছে, কোথাও কোনো সুবাতাস নেই। সাধারণ মানুষ বলছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম যেভাবে বাড়ছে, তাতে জীবনটাই থমকে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। সামনের দিনগুলোতে দ্রব্যমূল্যের এ উর্ধ্বগতি কোথায় গিয়ে ঠেকবে, সেটি ভেবে আতঙ্কিত হয়ে আছে। সরকারের কি জনগণের জন্য এতটুকু সংবেদনশীল মন আছে? পরিচিতি: সিনিয়র সাংবাদিক। সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ফেসবুক পেজের ভিডিও কনটেন্ট থেকে শ্রুতিলিখন করেছেন রুদ্রাক্ষী আকরাম