ভারতীয় পণ্য বর্জনের সিদ্ধান্ত কি দলীয়, নাকি রুহুল কবিরের একক সিদ্ধান্ত?
গোলাম মোর্তোজা
ভারত ইস্যুতে আওয়ামী লীগ-বিএনপি মুখোমুখি অস্থানে। বিএনপির ভারতীয় ‘পণ্য বর্জন’ ঘোষণার কারণেই দেশে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছেÑ এরপর হয়তো এমন প্রচারণায মেতে উঠবেন আওয়ামী লীগ নেতা-মন্ত্রীরা। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনীতি সবসময়ই মুখোমুখী অবস্থানে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতবিরোধী রাজনীতি এবং ভারতবিরোধী একটি জনমত এ দেশে বহু আগে থেকেই আছে, যেটাকে বলা হয় সাম্প্রতিক সময়ে ও বছরে বেড়েছে, সেটা একটা ব্যাপার। বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনীতির যে পরিস্থিতি চলছে, সেটা হলো ভারতের পক্ষে আওয়ামী লীগের প্রকাশ্য অবস্থান এবং বিএনপি এতোদিন রাখঢাক রাখলেও বর্তমানে সরাসরি ভারতবিরোধী অবস্থান নিয়েছে। এই অবস্থান বিএনপি নিয়েছে নাকি বিএনপির একজন নেতা নিয়েছেন, সেটা নিয়ে এখনো প্রশ্ন আছে। বিএনপি কার্যালয়ের সামনে রুহুল কবীর রিজভী ভারতীয় পণ্য বর্জনকে বা ভারত বয়কটকে আহ্বান জানিয়েছেন নিজের ভারতীয় শাল মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে আনন্দ-উল্লাস প্রকাশ করেছেন। ভারতীয় পণ্য বর্জনের সিদ্ধান্ত কি দলীয় নাকি রুহুল কবিরের একক সিদ্ধান্ত? রুহুল কবীর রিজভী বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ নেতা। তিনি দলের যুগ্ম মহাসচিব। তিনি দলটির অন্যতম মুখপাত্র। সুতরাং উনি যা বলেন সেটা যে দলীয় সিদ্ধান্ত নয় সেদিক থেকে ভেবে দেখলে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে আরো দু’একদিন। মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দেশে ফিরেছেন। তিনি অসুস্থ। নানা রকমের গুঞ্জন আছে বিএনপির রাজনীতিকে নিয়ে।
আওয়ামী লীগ বিগত বেশ ক’বছর ধরে প্রকাশ্যে ভারতের পক্ষে অবস্থান নিয়ে রাজনীতি করেছে। কারণ হলো ভারত আওয়ামী লীগকে বিশ্বাস করে, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের একটা হৃদ্যতার সম্পর্ক। ভারতের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু ছিলো তাদের সেভেন সিস্টারস রাজ্যকে কেন্দ্র করে সশস্ত্র তৎপরতা। বাংলাদেশ বিশেষ করে বিএনপি, জাতীয় পার্টি সরকারের সময় বাংলাদেশে যে ভারতীয় সশস্ত্র গোষ্ঠির নেতাদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছিলো ঢাকায় ও চট্টগ্রামে। সশস্ত্র গোষ্ঠিগুলোকে বাংলাদেশ সীমান্তে আশ্রয় দেওয়া হতো ভরতের পক্ষ থেকে এই অভিযোগটি অনেক বছর ধরেই ছিল, বাংলাদেশ অস্বীকার করেছিলো। কিন্তু শেখ হাসিনার সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর ভারতীয় সশস্ত্র সংগঠনগুলোর নেতাদের ভারতীয়দের হাতে তুলে দিয়েছে। ভারতীয় গণমাধ্যমের দ্বারা এ তথ্যগুলো জানা গেছে। এটা ভারত মনে রেখেছে। তাই শেখ হাসিনার সরকারের কাছে ভারত কৃতজ্ঞ।
বিগত নির্বাচনে দেখা যায় যে, আওয়ামী লীগের পাশে ভারতের প্রকাশ্য অবস্থান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে নরম করার ক্ষেত্রে বা তার নীতি পরির্বতন করার ক্ষেত্রে ভারত অবস্থান নিয়েছে, সেটা গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু কৃতজ্ঞতা স্বরূপ আওয়ামী লীগের নেতারা ওবায়দুল কাদেরসহ বারবার সে কথাটি বলছেন। অর্থাৎ ভারতের পক্ষে আওয়ামী লীগের রাজনীতি দৃশ্যমান আর ভারতের বিপক্ষে বিএনপির রাজনীতি আগে ছিল মাঝে তা থেমে ছিল এখন আবার তা প্রবলভাবে চলছে। ভারতীয় পণ্য বর্জন সম্পূর্ণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নির্ভর আন্দোলন চলছিলো প্রচারণা চলছিল। ভারত থেকে বাংলাদেশকে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে জবাব দেওয়া হচ্ছিলো। এর মাঝে বিএনপির মতো বড় একটি দল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভারতের পণ্য বর্জনে খুব জোরালোভাবে অংশগ্রগণ করে এবং আন্দোলন করে তাহলে বুঝতে হবে আওয়ামী লীগ খুব বড় একটা সদ্ধান্ত নিয়ে নিয়ে ফেলেছেন। ভারতরে সঙ্গে একটা সীমারেখা তৈরি করছে নাকি রুহুল কবীর রিজভীকে দিয়ে বলিয়ে বিএনপি ভারতের দৃষ্টি আর্কষণ করার চেষ্টা করছে। ভারত এখন বিএনপির সঙ্গে একধরনের আলোচনা করতে চাইবে বিএনপি সেটা মনে করছে?
বিএনপি বিগত কয়েক বছর ধরে ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছিলো। তারা ধরেই নিয়েছিলো ভারত চাইলে সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে। কিন্তু তা হয়নি, ভারত তাদের প্রত্যাশা পূরণ করেনি। এজন্যই কি বিএনপি ভারতের দৃষ্টি আর্কষণ করতে ভারতের সঙ্গে তীব্র ভারতবিরোধী অবস্থান নেবে, সীমারেখা নির্ধারণের ব্যবস্থা নিয়ে নেবে, অথবা ভারতকে বলা যায় আমাদের সঙ্গে আলোচনা না করলে আমরা এ ধরনের অবস্থানে চলে যাবো। পরিস্থিতি কী হবে তা আগামী দিনগুলোতে দেখা যাবে নির্দিষ্ট করে বলা যাবে না। বাংলাদেশে ভারতীয় পণ্য বর্জন বলতে শুধু মশলা, পোশাক বর্জন বাংলাদেশের জন্য কঠিন নয়। কিন্তু চাল বা পেঁয়াজ বিকল্প উৎস থেকে আমদানি করতে হলে বা কোভিডের মতো পরিস্থিতিতে একমাত্র ভারত বাংলাদেশকে সাহায্য করেছিলো। বর্তমানে বাংলাদেশে যেকোনো প্রান্ত থেকে চাল, পেঁয়াজ আমদানি করতে পারবে কিন্তু, প্রশ্ন থেকে যায় যে, ভারতের মতো সহজলভ্য হবে কি? আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে চাল বা পেঁয়াজের রপ্তানি ভারত মাঝে মধ্যে বন্ধ করায় আমাদের বাজারে তার দাম বেড়ে যায়।
ভারতকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির যে মুখোমুখি রাজনীতিতে আ.লীগের জন্য কিছুটা সাপেবর পরিস্থিতি হতে পারে। জিনিসপত্রের দাম ভয়াবহভাবে ঊর্ধ্বমুখী প্রতিদিন প্রতিটি জিনিসের দাম বাড়ছে। কিন্তু কমছে না এরকম একটা পরিস্থিতিতে দাম কমাতে না পেরে সরকার চাপের মুখে আছে। বিএনপি যেহেতু ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দিয়েছে, তাই আওয়ামী লীগের নেতারা, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, ওবায়দুল কাদেরসহ অনেকেই বলছেন, দেশের জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি করার জন্যই বিএনপি ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দিয়েছে। অর্থাৎ জনগণের দুর্ভোগ বাড়াতেই ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দিয়েছে। এখন দেখার ব্যাপার যে মুখোমুখি রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির যুক্তি কী হয়?
জিনিসপত্রের দাম কমানোর ব্যর্থতাকে এবার আওয়ামী লীগ সরকার বা আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা ভারতীয় পণ্য বর্জন বিষয়ক কর্মসূচির জন্য বিএনপিকে দায়ী করবে, এই নিয়ে নানান প্রপাগান্ডা চলবে দুপক্ষের রাজনীতিতে। বাংলাদেশের মানুষের ভারতে যাওয়া না যাওয়াকে কেন্দ্র করে আমরা সহজভাবেই দেখি এর একটি ভিন্ন দিক আছে। বাংলাদেশ থেকে ভারতে বেশির ভাগ মানুষই চিকিৎসার জন্য যায়। বাংলাদেশ থেকে ভারতে দৈনিক ৮-১০ বা ১২টি ফ্লাইট আসে, এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইট,বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইট আরো অনেক ফ্লাইট আছে। প্রতিটি ফ্লাইটেই বাংলাদেশ থেকে অসুস্থ রোগীরা ভারতে গিয়ে চিকিৎসা নিতে যান। আমি নিজে পর্যন্ত চেন্নাই এপোলো হসপিটালে দেখেছি কমপক্ষে ৮০ শতাংশ রোগী বাংলাদেশি। অর্থাৎ বাংলাদেশের রোগীর উপর নির্ভর করেই এ হাসপাতালটি চলছে। ভারতীয় পণ্য বর্জন, ভারত বয়কট, ভারতে যাবো না এ কথাগুলো কি চিকিৎসা নিতে যাওয়া মানুষরা শুনবেন? তারা কী করবেন? তারা কি বিএনপির আহ্বান শুনবেন? সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যারা কথা বলছেন তাদের কথা শুনবেন? তখনই শুনবেন যদি দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পূর্ণ স্বয়ংসম্পন্ন হয় দেশের রোগীরা দেশেই যদি সঠিক চিকিৎসা পান এবং চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় আস্থা অর্জন করতে পারে। তবেই কথা শুনবেন। দেশের বড় নেতা-কর্মীরা ইউরোপ, আমেরিকা, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডে চলে যাবে। দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় আস্থা না থাকার কারণে বেশির ভাগ মানুষ ভারতে চলে যায় বা যাদের সামর্থ্য আছে তারা যাচ্ছে। আমাদের দেশে চিকিৎসা আছে, কিন্তু ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত দুর্বল।
বিএনপি ভারতীয় পণ্য ও ভারতকে বয়কট জানায় সেক্ষেত্রে এ সকল রোগীদের কী হবে? বিএনপিও অনেকবার সরাকারি ক্ষমতায় ছিলেন। কিন্তু কোনোবারই চিকিৎসা ব্যবস্থায় উন্নয়ন করেননি। এমনকি আওয়ামী লীগ সারকার তিন মেয়াদে সরকার ক্ষমতায় থেকেও কোনো উন্নয়ন করেনি। এ অবস্থায় ভারতের পক্ষে আওয়ামী লীগের রাজনীতি ভারতের বিরুদ্ধে বিএনপির রাজনীতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও অন্যান্য রাজনৈতিক দল। এ রাজনৈতিক পক্ষে পিক্ষে পরিস্থিতির কারণে চীন, ভারত সরকার সুযোগ নেবে। মালদ্বীপ, নেপাল ও শ্রীলঙ্কায় এমন ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু ঘটার পরিণতি ওই দেশের জন্য কতোটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। মালদ্বীপ শক্ত অবস্থানে, নেপালেও এমন হয়েছিলো। কিন্তু এর ফল না ভালো না খারাপ। সবচেয়ে বড় কথা শক্তি এবং দর কষাকষির সামর্থ্য অর্জন করা যায় সততার সঙ্গে কাজ করা যায় তাহলে বয়কট বা বর্জন করা যায় না বরং চোখে চোখ রেখে সরাসরি আলোচনা করা যায় সমস্যার সমাধান করা যায়।
তিস্তার পানি আমরা চাইÑ এ কথাটা আওয়ামী লীগ সরকার জোর গলায় বলতে পারে না, তারা অনেকটা ভারতের ভাষায় কথা বলে। তাই আমাদের এখানে ভারতবিরোধী মনোভাব তীব্র হয়। ভারত তার স্বার্থ দেখবে, বাংলাদেশ তার স্বার্থ দেখবে। কিন্তু বাংলাদেশর মন্ত্রী, উপদেষ্টারা যখন অন্য দেশের ভাষায় কথা বলেন, তখনই একধরনের বিরোধী মনোভাব জন্ম নেয়। এ কথাটাই আওয়ামী লীগের অনেক নেতারাই বুঝতে পারছেন না, সে সুযোগ অন্যরা নিচ্ছে। সীমান্ত হত্যার কারণ, দেশের নির্বাচন নানান কারণ মিলে এ দেশের অনেকেই ভারতের ওপর ক্ষুদ্ধ, তাই বয়কটের দিকে প্রভাবিত হচ্ছে। পরিচিতি: সিনিয়র সাংবাদিক। গোলাম মোর্তোজা ফেসবুক পেজের ভিডিও কনন্টেন্ট থেকে শ্রুতিলিখন করেছে রুদ্রাক্ষী আকরাম