খাদ্য নিরাপত্তা, ব্যাংকের বেহাল দশা এবং কথার ফুলঝুরি!
কাকন রেজা
২০২২ সালে বিশ্বব্যাংক এক পরিসংখ্যানে বলেছিলো, খাদ্য সংকটে রয়েছে বাংলাদেশের প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ। এই হিসেব করোনা মহামারির পরের। কিন্তু তারপরেও সে সময় অ্যাস্টাব্লিশমেন্টের পক্ষ থেকে করোনার অজুহাত দেয়া হয়েছিলো। ২০২০ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা ক্রমেই বেড়েছে বিশ্বব্যাংকের সে পরিসংখ্যানে। সুতরাং মহামারির অজুহাত ধোপে টেকে না। ২০২১ সালে ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘুমাতে গেছে ৭ শতাংশ মানুষ যা ২০২২ এ দাঁড়িয়েছিলো ১৩ শতাংশে।
এখন ২০২৪ সাল। চারিদিকে উন্নয়নের কথামালা। বক্তৃতার ফুলঝুরি। কিন্তু বাস্তবে কী দেখা গেলো? দেখা গেলো ৪৩ শতাংশ মানুষকে ঋণ করে খাবার কিনতে হচ্ছে। খাবার কিনতেই যদি ঋণ করতে হয়, তবে বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা এসবের অবস্থা কী? এবারের পরিসংখ্যান জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির তথা ডব্লিউএফপি’র। বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে এই পরিসংখ্যানে ডব্লিউএফপি আরো জানিয়েছে, ৮১ শতাংশ পরিবার বাধ্য হয়ে কম খাবার কিনছে। গড়ে ১৭ শতাংশ মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীন। বিশ্বব্যাংক ২০২২ সালে জানিয়েছিলো ১৩ শতাংশের কথা, যারা ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘুমাতে যায়। দু’বছরের মাথায় খাদ্য নিরাপত্তাহীনের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৭ শতাংশে। মানুষের মৌলিক চাহিদার প্রধান হলো অন্ন তথা খাদ্য। তারপরের চিন্তায় বাসস্থান, স্বাস্থ্য, শিক্ষা। বাসস্থানের কথায় বলি, আমাদের দেশের ৩৪ লাখ শিশু এখনো রাস্তায় ঘুমায়। আর নোংরা অপরিচ্ছিন্ন পরিবেশে ঘুমায় কতজন শিশু তার কোনো পরিসংখ্যান আপাতত নেই। তবে আন্দাজ যে করা যায় না তা কিন্তু নয়।
জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মেয়াদ ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে। এটা যে হঠাৎ করেই হচ্ছে এমন নয়। দীর্ঘ সময় ধরেই শুরু হয়েছে এই পেছন যাত্রা। ২০২৩ সালের মার্চে অর্থাৎ এক বছর আগে একাত্তর টেলিভিশনের অনলাইনে একটি খবর ছিলো ‘সানেম’ এর গবেষণা নিয়ে। সেখানে বলা হয়েছিলো, দেশের ৭৪ শতাংশ নিম্ন আয়ের পরিবার ঋণ করে খাচ্ছে। ওই জরিপের তথ্যে ছিলো, দেশের গ্রাম ও শহরের নিম্ন আয়ের ৯০ শতাংশ পরিবারই অর্থনৈতিক চাপে রয়েছে এবং তাদের বাধ্য হয়েই খাদ্যাভাস পরিবর্তন করতে হয়েছে। বলা হয়েছিলো, নিম্ন আয়ের ৭৪ শতাংশ মানুষই ঋণ করে চলছে।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, এ হিসেবে তো নিম্ন আয়ের। বলি, উচ্চ আয়ের কারা, সরকারি কর্মকর্তা, অসাধু ব্যবসায়ী, লুটেরা, টাকা পাচারকারী এরাই তো? কিন্তু এদের সংখ্যা কত, কেউ কি এর পরিসংখ্যান দেবেন। পরিসংখ্যান দিতে গেলে বৈষম্যের পেরেকে উন্নয়নের ফাঁপা বেলুন তো চুপসে যাবে। পরিসংখ্যান দিতে গেলে বলতে হবে, সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে এ বছর বিদেশী ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১শ বিলিয়ন ডলারে। যার প্রায় ৮০ শতাংশই নিয়েছে সরকার। আভ্যন্তরীণ উৎস থেকে নেয়া ঋণের পরিমাণ আর না বললাম। বলতে গেলে তো এসে যাবে ব্যাংকগুলোর কথা। বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড জানাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের গোপন প্রতিবেদন থেকে যে, দেশের ৩৮টি ব্যাংক এখন দুর্বল। দুরাবস্থা কাটাতে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে টিকে থাকা ব্যাংকগুলোর সাথে জুড়ে দেয়া হচ্ছে। যাদের সাথে জুড়ে দেয়া হচ্ছে তারাও যে প্রবল ভাবে সবল তাও বলা যাবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের হেলথ ইনডেক্স বলছে, ৫৪টি ব্যাংকের মধ্যে মাত্র ১৬টি ব্যাংকের অবস্থা ভালো। যারমধ্যে আবার ৮টি বিদেশী ব্যাংক। অর্থাৎ দেশী ব্যাংকের মধ্যে ভালো মাত্র ৮টির অবস্থা।
শুরু করেছিলাম খাদ্য সংকট নিয়ে। কিন্তু লিখতে হলো ব্যাংক পর্যন্ত। তবুও যা লেখা হলো তাও অতিসামান্য, বলতে পারেন, ডুবোপাহাড়ের চূড়ো। যা রয়েছে খাদ্য সংকটের পেছনে। সুতরাং উন্নয়নের কথামালা বলার আগে এসব বিষয় নজরে রাখা উচিত। না হলে কথা হয়ে উঠবে ফুলঝুরির মতন। অর্থাৎ আতশবাজি, খানিক আলো ও শব্দ ছড়িয়েই যার সমাপ্তি। লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট