দেশে ডলারের প্রকৃত চিত্র কী, তবে কি ডলার সংকট শিগগিরই কাটছে?
কাজী এম. মুর্শেদ
আজকে ডলার নিয়ে কথা বলি। বছর তিনেক আগে সরকার ঘোষিত ৪৮ বিলিয়ন ডলার হঠাৎ এতোটা নামার কারণ কী? সরকার ঘোষিত বর্তমান অবস্থান ২৫ বিলিয়ন। তবে যারা হিসাবপাতি বোঝেন তারা মনে করেন এটা ১৫-১৬ বিলিয়ন রেঞ্জে আছে। মনে করার কারণ হলো- [১] বাংলাদেশ ব্যাংক আপনাকে সঠিক তথ্য দিতে বাধ্য, এটা কারো নিজের ব্যাংক নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক বলে রিজার্ভ ২৫ বিলিয়ন আছে, তবে বিপিএম-৬ অনুযায়ী নীট ব্যালান্স তারা বলবে না। শুধু আইএমএফকে জানাবে। [২] গ্রোস হিসাবে ২৫ বিলিয়ন হলেও যখন বিপিএম বা ব্যালান্স অফ পেমেন্ট ধরা হয় তখন এর থেকে সম্ভাব্য আমদানি বিল পরিশোধ ও বৈদেশিক ঋণের সুদ-আসল বাদ দিতে হয়। সেই হিসাবে ১৫-১৬ বিলিয়ন কোনো ভুল সংখ্যা নয়। [৩] গত কয়মাসে এক্সপোর্ট প্রমোশন ব্যুরোর হিসাবে মোট এলসি হিসাবে যা রপ্তানির হিসাব ধরা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংক হিসাবে সেখানে প্রায় ৭-৮ বিলিয়ন ডলারের কমতি আছে। এর অর্থ রপ্তানির ডলার দেশে আসেনি। যদি না আসে অর্থনীতির উপর আরেক দফা চাপ আসবে।
[৪] বর্তমান সরকার ভোটের আগে ভারত এবং চীনের ব্যালান্স করতে গিয়ে আগ বাড়িয়ে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিলো। ভারতের রিজার্ভ ৬০০ বিলিয়নের উপর। ভারতের কথা শুনবেন, কিন্তু তারা কোনো অর্থ সাহায্য দেবে না। বড়জোর আবার লাইন অফ ক্রেডিট দেবে। এখন পর্যন্ত তাদের অনুমোদিত ৯ বিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে আমরা ১.৫ বিলিয়ন খরচ করেছি। লাইন অফ ক্রেডিটের শর্তে কাজ বাংলাদেশে হলেও কাজটা দিতে হবে ভারতকে। খরচ আপনার কিন্তু সেই টাকার চেহারা দেখবেন না, সুদ আসল পরিশোধ করতে হবে। চীনের পর্যাপ্ত রিজার্ভ থাকলেও তারা এখন বাংলাদেশকে গত বছর দুয়েক কোনো অর্থ বা প্রজেক্ট দেয়নি। সোজাসাপ্টা বলে দিয়েছে, তাদের দেবার মতো ডলার নেই। সেটাকে জনৈক মন্ত্রী অনুবাদ করেছেন, চীনের নিজেরই ডলার সংকট, তারা কী দেবে? কারণ আরো অনেক আছে। যারা খুব কাছ থেকে দেখেন এবং প্রতিটা রিপোর্ট যাচাই করে ট্রেন্ড তৈরি করেন তাদের হাতে ছেড়ে দিই।
আমি আপনাদের প্রাথমিক ধারণা সহজ ভাষায় দিতে চাই বলে হিসাবের গভীরে গেলাম না। এখনো আমি মনে করি ভারত-চীনের উপর ভরসা না করে সরকারের উচ্চমহলের উচিত আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয় ইউনিয়নের সাথে সম্পর্ক আগের অবস্থানে আনা। ডলার সংকটের মূল কারণ কী বোঝানোর চেষ্টা করি। এটা আমার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, আপনারা কিছু যুক্ত করতে চাইলে করতে পারেন। প্রথম কারণ- কিছু দরকারী প্রজেক্টের সাথে অদরকারী প্রজেক্ট নেয়া হয়েছে, যেখানে রিটার্ন অফ ইনভেস্টমেন্ট হিসাব করা হয়নি। দরকারী বলতে পদ্মা সেতু এবং মেট্রোরেল ধরলাম। অদরকারী বলতে কর্ণফুলী টানেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেস ধরলাম। আরো উদাহরণ দিতে পারি, পদ্মা সেতুর রেললাইন, কক্সবাজার রেললাইন, জয়দেবপুর এক্সপ্রেসওয়ে, আবহাওয়া স্যাটেলাইট ইত্যাদি কোনটা কোন বক্সে পরবে তা এখনই বলছি না। এসবই বৈদেশিক ঋণ এবং তার উচ্চ সুদহার, চুক্তিতে দুর্বলতা, গ্রেস পিরিয়ড ইত্যাদি যুক্ত হয়ে ডলারের চাপ বাড়িয়েছে।
দ্বিতীয় কারণ বৈদেশিক মুদ্রার প্রধান সোর্স রফতানির হিসাবে গড়মিল। যে মাত্রায় এলসি এসেছে, সে মাত্রায় ডলার পেমেন্ট অন্তত দেশে আসেনি। তৃতীয় কারণ রেমিটেন্সের টাকা হুন্ডিতে আসা। যখন ডলারের ব্যাংক রেট আর হুন্ডি রেটে পার্থক্য ১৫ টাকা হয়, তখন কতো আর ইনসেন্টিভ দেবেন বলেন? তার উপর এখন আবার আইএমএফের প্রেসক্রিপশন (এটাকে ওহী নাজেল বলতে পারেন), রেমিটেন্সের উপর ট্যাক্স বসানো। চতুর্থ কারণ বিদেশ ভ্রমণ বা চিকিৎসা এবং বিদেশি কর্মকর্তা নিয়োগ করে তাদের টাকা বাইরে পাঠানোতে কোনো লাগাম নেই। দৃশ্যত সরকার কিছু দেখছেই না। আন্ডার ইনভয়েস আর ওভার ইনভয়েস সেটাও দেখছে না। সরকারের কাছের লোকজন যারা আমলা বা প্রশাসনে বা রাজনীতিবিদ বা ব্যবসায়ী তারা কীভাবে বিদেশে ডলার পাঠাচ্ছে, সরকারের ডিনাইয়াল সিনড্রোম বড়ই সন্দেহজনক।
অফশোর ব্যাংকে টাকা যাওয়া, লন্ডনে বাংলাদেশিরা বাড়ি কিনছে, দুবাইতে ব্যবসার লাইসেন্স, সব চোখ বুজে আছে। পঞ্চম ও শেষ কারণ জনগণের লোভ। এটা আলাদা ব্যাখ্যা করি। ২০২২ সালের এপ্রিল নাগাদ ডলার রেট ছিলো ৮৬ টাকা। হঠাৎ ৩ টাকা বাড়ায় এবং ব্যাংক এলসি বন্ধ করায় জনগণ বুঝতে পারলো এখন এটাই ইনভেস্টমেন্টের সময়। ২০২২ সালের শেষে এই রেট কার্ব মার্কেটে ১১০ ছাড়িয়ে যায়। ২০২৩ সালের কয়মাসে ১২০ হয়ে বছরের শেষে ১২৫ গিয়ে ঠেকে। মাঝে মাঝে ১৩০ হয়ে যায়। সরকারের বিভিন্ন চেষ্টা, যেগুলো বজ্র আটুনি ফসকা গেরো সত্ত্বেও সামলাতে পারেনি। সরকারের বিশেষ কিছু মহল নিজেই এই ডলার সংকট সাথে করে ব্যবসা করছে, এজন্য ঠেকানো সম্ভব নয়। ডলার দেশেই আছে, যখন সামান্য একটা কাগজের জন্য তেমন জায়গা লাগে না বা চোখে পড়ে না তার দাম ১২ হাজার টাকা হয়, তাহলে সেটাই লাভের ব্যবসা।
জনগণ ‘আরো লাভ করবো’ মনে করে বসে আছে ১৫০ বা ২০০ হলে ছাড়বে। সম্ভবত ছাড়বে না। এই লোভের জন্য যেটা ২০২৩ সালে ১১০ এ ছেড়ে দিলেও ২৮ শতাংশ লাভ হতো, সেটা আকড়ে বসে আছে। বর্তমানে বিভিন্ন ব্যাংক আরএফসিডি অ্যাকাউন্ট করে ব্যাংকে রাখার সুবিধা ও সাথে ইন্সেন্টিভ দেবার ঘোষনা দিলে যারা বালিশ বা তোষকে লুকিয়ে রেখেছে তারা ব্যাংকগুলোতে জমা দিলে কোনো ক্ষতি হতো না। কিন্তু ওই যে আরো বেশি দাম উঠার লোভ এখনো ছাড়তে পারেনি।
সমাধান কী? সমাধান আছে, তবে আরেক সময় হয়তো আলোচনা করা যাবে। আপাতত আমাদের আমলা আর অর্থনীতিবিদরা কথা বলুক, সাথে সর্বজ্ঞানে গুণান্বিত কিছু ব্যক্তি টকশোগুলোতে সবকিছুর সমাধান দেয় তারা দিক। উনারা প্লট, বিদেশভ্রমণ, পদ, পদক, পদবি পান। আমার তো কোনো ঠেকা নেই। থাকলে না হয় কথা বলা যেতো। দেখেন সমস্যা থাকলে সমাধান বের করা যায়। আমরা সমস্যা চিহ্নিত করতে পারি না, পারলে সমাধান আসবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে সমস্যা খুঁজতে পছন্দ করি, সমস্যা খোঁজা মানে দোষ দেওয়া না। বড় সাহেবরা আছেন সমাধান বের করতে। উনাদের বের করতে দিলাম। লেখক: অর্থনীতি পর্যবেক্ষক