মজুরি আন্দোলনে শ্রমিক হতাহতের ঘটনা অনুসন্ধানে গণতদন্ত কমিটি গঠন
আনু মুহম্মদ
প্র্রতিবার বহুরকম সভা সমাবেশ আন্দোলন ছাড়া মজুরি নিয়ে কোনো নড়াচড়া হয় না। প্রতিবারই মজুরির কথা বলতে শ্রমিকদের রাস্তায় নামতে হয়! কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া কাজ করে না।….শ্রমিকদের দাবি-দাওয়ার বিষয়টি মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ ও যাচাই করার দায়িত্ব ছিল সরকার ও সরকারগঠিত ওয়েজ বোর্ডের। কিন্তু তারা তা না করে শুধু মালিকদের কথাই শুনেছে এবং পুলিশ বিজিবি সন্ত্রাসী বাহিনীর চাপের মুখে সেই কম মজুরি শ্রমিকদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। আন্দোলনকারী শ্রমিকের ওপর পুলিশ ও সন্ত্রাসীদের সম্মিলিত আক্রমণ হয়েছে। কমিউনিটি পুলিশ, ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ, থানার পুলিশ, বিজিবি, এমনকি আনসার, গোয়েন্দা সংস্থা এবং এলাকার ছাত্রলীগ-যুবলীগদের বাহিনী দিয়ে একযোগে শ্রমিকদের উপর নারী-শিশু নির্বিশেষে সাঁড়াশি আক্রমণ চালানো হয়েছে। গুলি করে ও পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে একজন ঘুমন্ত শ্রমিকসহ আরও তিনজন পথচারী শ্রমিককে, জখম হয়েছেন আরও অনেকে। এ নিয়ে কোনো তদন্ত বিচারের উদ্যোগও নেয়া হয়নি। উল্টো শতশত শ্রমিককে মামলা হয়রানি ও নির্যাতনের মধ্যে ফেলা হয়েছে।
এরপরও গত কিছুদিনে আমরা দেখতে পাচ্ছি মালিকপক্ষ নির্ধারিত সেই মজুরিও কোনো কোনো কারখানায় এখনও বাস্তবায়ন হয়নি, তার জন্য এখন বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকদের দাবি জানাতে হচ্ছে, রাস্তায় নামতেও বাধ্য হচ্ছেন তারা।
এই পরিস্থিতি এবারই প্রথম নয়। এর আগে ২০১৮ সালের মজুরি কমিশন ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে যে মজুরি কার্যকর করলো, তা নিয়ে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা নারায়ণগঞ্জ, আব্দুল্লাহপুর, টঙ্গি, আশুলিয়া আন্দোলন করছিলেন। সেসময় সাভারের হেমায়েতপুরে গুলিতে সুমন মিয়া নিহত হন। একই স্থানে আঁখি ও রুবিনা নামের দুই নারী কর্মী আহত হয়েছিলেন। কিন্তু ঐ হতাহতেরও কোনো তদন্ত ও বিচার পায়নি তার পরিবার ও শ্রমিকেরা।…
এই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা অনেকগুলো প্রশ্নের সম্মুখীন হই। শ্রমের বিনিময়ে প্রাপ্য ন্যূনতম মজুরি চাওয়ার পরিণামে শিল্পাঞ্চল রক্তাক্ত হয় কেন? কেন অকাল মৃত্যু হয় নারী পুরুষের? কেন জখম হন শত শত শ্রমিক? কেন প্রতিবছর ন্যূনতম মজুরি চাইতে আন্দোলনে নামতে হয়? কেন রাষ্ট্র তার সবরকম সংস্থা নিয়ে সবসময়ই শ্রমিকদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়? পুলিশসহ নানা বাহিনী কি প্রচলিত আইনও মান্য করে? এসব প্রশ্নের উত্তর জানার অধিকার বাংলাদেশের সকল নাগরিকের। সরকার এসব অনিয়ম, জুলুম ও হত্যাকান্ডের কোনো কার্যকর তদন্ত না করায় নাগরিকদের পক্ষ থেকে আমরা মজুরি আন্দোলনে নিহত শ্রমিক গণতদন্ত কমিটি’ গঠন করেছি। আইনজীবী, শ্রমিক সংগঠক, অর্থনীতিবিদ, লেখক, গবেষক সমন্বয়ে গঠিত ২৯ সদস্য বিশিষ্ট এই কমিটি অনুসন্ধান করবে:
১। কোন পরিস্থিতিতে শ্রমিকেরা রাস্তায় আন্দোলন করছিলেন? তাদের দাবি কী ছিল?
২। এই আন্দোলন নিয়ে মালিকপক্ষ, পুলিশ, বিজিএমইএসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ভ’মিকা কী ছিল?
৩। শ্রমিকদের আন্দোলনে হামলা চালানোতে কারা জড়িত ছিল?
৪। কারা গুলি চালিয়েছিল? কেন?
৫। নিহত আহত ব্যক্তিদের পরিচয় কী?
৬। হতাহতের ঘটনায় মামলা, তদন্ত, দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি বিধান বিষয়ে সরকার ও সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে? এ বিষয়ে তাদের ব্যাখ্যা কী?
৭। এবিষয়ে প্রচলিত আইনের মাপকাঠিতে পুলিশ, মালিক ও সরকারি বিভিন্ন সংস্থার ভূমিকা কি যথাযথ ছিল?
৮। এসব বিষয়ে মালিক ও বিজিএমইএ-র ভূমিকা কী?
৯। শ্রমিকদের মজুরি, কর্মপরিবেশ, অধিকার নিয়ে অস্থিরতা, সহিংসতা, দমনপীড়ন বন্ধ করতে করণীয় কী কী?
আমরা এসব প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করতে প্রকাশিত খবর, লেখালেখি, রিপোর্ট পর্যালোচনার পাশাপাশি শ্রমিক, মালিক ও পুলিশসহ সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের বক্তব্য গ্রহণ করবো। নিহত শ্রমিক পরিবারসহ প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষাৎকারও গ্রহণ করা হবে।
আমরা আশা করছি, শ্রমিকসহ সকলের সাংবিধানিক অধিকার ও দায়িত্ব বিবেচনায় নিয়ে প্রাথমিক তদন্ত কাজ আমরা ১৫ মে-র মধ্যে শেষ করবো এবং ৩১ মে-র মধ্যে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত রিপোর্ট দেশবাসীর সামনে উপস্থিত করতে সক্ষম হবো। আমরা এই কাজে সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতা কামনা করি। লেখক : অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক