টাকা-ডলারের বিনিময় হারে স্থিতিশীলতার আভাস?
তারেক আহমেদ রবিন : ২০২২ সাল থেকে মার্কিন ডলার ও বাংলাদেশি টাকার মধ্যে বিনিময় হার অস্থির ও ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ডলারের দামের লাগামহীন ওঠানামা জাতিকে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মুখে ফেলেছে। ২০২১ সালে ১ ডলার সাধারণভাবে ৮০-৯০ টাকায় বিনিময় করা হয়েছিলো। কিন্তু ২০২২ সালে রুশ-ইউক্রেনীয় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে, বিনিময় হার দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। যা বর্তমানে ১ ডলারের জন্য ১০০ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এমনকি কিছুদিন আগেও, ব্যাংক ও ফরেক্স ব্যবসায়ীরা ১১৮-১২০ টাকায় এক ডলার বিক্রি করছিলো। যা ছিলো একটি রেকর্ড। উচ্চ ডলারের হারে উদ্বেগজনক বৃদ্ধি অর্থনীতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে, নীতিনির্ধারকদের দ্রুত সমাধান খুঁজতে উদ্বুদ্ধ করেছে। এই প্রবণতার বিস্তৃত ফলাফল রয়েছে। যা মূল্যস্ফীতি ও আমদানি ব্যয় সহ বিভিন্ন দিককে প্রভাবিত করে। বাংলাদেশের অর্থনীতি ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি, আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি ও বাণিজ্য ঘাটতি বৃদ্ধির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ল্যান্ডস্কেপ অনেক সূচক উপস্থাপন করে যা দেশের আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে মূল্যবান অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে। এই সূচকগুলোর মধ্যে রয়েছে রেমিট্যান্স প্রবাহ, রপ্তানি আয়, আমদানি ব্যয় ও নগদ মজুদ।
সাম্প্রতিক তথ্যগুলো গতির একটি সম্ভাব্য ইতিবাচক পরিবর্তনের পরামর্শ দেয়। যা ডলারের বিনিময় হারের সম্ভাব্য স্থিতিশীলতা ও আরও ভালো অর্থনৈতিক সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয়। এই গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সূচকগুলোর বিশদ বিশ্লেষণ থেকে এই আশাবাদের উদ্ভব হয়। যার প্রতিটিই বাংলাদেশের আর্থিক সূচকের উপর একটি অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে। রেমিট্যান্স প্রবাহ একটি শক্তিশালী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে একটি অভূতপূর্ব মাত্রায় এটি বৃদ্ধি পেয়েছে। বিদেশ থেকে প্রবাসী বাংলাদেশিরা চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে ১৫ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছে। যা গত অর্থবছরের একই সময়ে রেকর্ড করা ১৪.১২ বিলিয়ন ডলারের বিপরীতে। রেমিট্যান্সের স্থির প্রবাহ, বর্তমানে প্রতি মাসে ২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে, যা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি লাইফলাইন হিসেবে কাজ করে। রপ্তানি আয়ও উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে এটি ৫১.৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা আগের বছরের তুলনায় ১২.৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। রপ্তানি আয়ের এই টেকসই বৃদ্ধি, রেমিট্যান্স প্রবাহের সঙ্গে মিলিত, বাণিজ্য ঘাটতি সংকুচিত করার, পূর্বে কমে যাওয়া বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে শক্তিশালী করার ও ডলারের হার স্থিতিশীল করার সম্ভাবনা দেখায়।
যদিও রেমিট্যান্স প্রবাহ ও রপ্তানি আয়ের সাম্প্রতিক বৃদ্ধি কিছুটা আশা জাগিয়েছে কিন্তু অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার দিকে বাংলাদেশের যাত্রা চ্যালেঞ্জ ছাড়া নয়। কাঠামোগত ভারসাম্যহীনতা, একটি বিস্তৃত বাণিজ্য ঘাটতি ও ক্রমবর্ধমান আমদানি ব্যয় দ্বারা প্রভাবিত, মুদ্রার হার স্থিতিশীলতার পথে উল্লেখযোগ্য বাধা তৈরি করে। এই অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি মেয়াদে আমদানি পরিশোধ বেড়ে ৩৬.০২ বিলিয়ন ডলার হয়েছে, যা আমদানি ব্যয় ও রপ্তানি আয়ের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ভারসাম্যহীনতাকে প্রতিফলিত করে। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ফেব্রুয়ারিতে আমদানি ব্যয় ১.৫২ শতাংশ বেড়েছে, যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের উপর চাপ বাড়িয়েছে। অধিকন্তু, নেট ওপেন পজিশন ও ব্যাংকগুলোর অনানুষ্ঠানিক বিনিময় হারের ওঠানামার কারণে বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে অস্থিরতা আরও খারাপ হয়। বৈদেশিক মুদ্রায় ব্যাংগুলোর এনওপি ১১ মার্চ, ২০২৪-এ ৬০৬ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা ফরেক্স মার্কেটে তারল্য পরিচালনা ও ঝুঁকি কমানোর জন্য সক্রিয় পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তার ইঙ্গিত দেয়। মহামারী পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সম্ভাব্য সংকট এড়াতে কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়েছে। এই চ্যালেঞ্জ ও জটিলতা বিবেচনা করে, অনেক বিশেষজ্ঞ অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করতে বাংলাদেশ সরকার কীভাবে ডলারের ঊর্ধ্বগতি মোকাবেলা করতে পারে সে সম্পর্কে কিছু ধারণা তৈরি করেছেন।
পরামর্শগুলোর মধ্যে রয়েছে ডলারের জন্য বেসরকারি খাতের চাহিদার চাপ কমাতে একটি সরকারি আমদানি তহবিল তৈরি করা, রপ্তানি ধরে রাখার কোটা (ইআরকিউ) হ্রাস করা, বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বাড়াতে ব্যাংকগুলোর বর্তমান নেট ওপেন পজিশন (এনওপি) অবিলম্বে ৫০ শতাংশ হ্রাস করা, রিজার্ভ থেকে ১-২ বিলিয়ন ডলার ইনজেক্ট করা, টাকার অবমূল্যায়ন করা, ফরেক্স রিজার্ভকে বুদ্ধির সঙ্গে ব্যবহার করা, রেমিট্যান্স প্রবাহের উন্নতি করা ও ট্রেডিং ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ভবিষ্যৎ পণ্যের বাজারের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা। বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত কয়েকটি নীতি সেই পরামর্শগুলোর সঙ্গে মিল দেখায়, এপ্রিলের মধ্যে ডলারের হার স্থিতিশীল করার সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয়। রেমিটেন্সে ডলারের মূল্যের সাম্প্রতিক পতন বাজারের পরিবর্তনশীলতাকে প্রতিফলিত করে। মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে ১৫ মার্চ পর্যন্ত ডলারের বিনিময় হার ৬ থেকে ৮ টাকা কমেছে, যা বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা কমে যাওয়ার ইঙ্গিত দেয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে ফরেক্স মার্কেটে ৫ বিলিয়ন ডলার ইনজেকশন ও ডলার-টাকা অদলবদল প্রবর্তন সহ বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক গৃহীত হস্তক্ষেপমূলক পদক্ষেপগুলো স্থানীয় মুদ্রা বাজারে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় তারল্য ও স্থিতিশীলতা প্রদান করেছে। ডলার-টাকা অদলবদল শুরু হওয়ার পর থেকে ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকে প্রায় এক বিলিয়ন ডলার জমা করেছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পরিচালনা ও মুদ্রার অস্থিরতা প্রশমনে এই পদক্ষেপগুলোর কার্যকারিতার উপর জোর দেয়।
তাছাড়া, ব্যাংকিং খাতের মধ্যে নগদ মজুদ স্থিরভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। নগদ মজুদ এক মাসে ২৮ মিলিয়ন ডলার থেকে ৩২ মিলিয়ন ডলারে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা আরও ভালো তারল্য ব্যবস্থাপনা ও আর্থিক স্থিতিশীলতার ইঙ্গিত দেয়। চলতি অর্থবছরের জন্য ঋণ প্রতিশ্রুতির পরিমাণ ৭.২ বিলিয়ন ডলার, যা আন্তর্জাতিক ঋণদাতাদের মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনার প্রতি ক্রমবর্ধমান আস্থার ইঙ্গিত দেয়। যা বাংলাদেশের আর্থিক স্থিতিশীলতাকে আরও শক্তিশালী করে। অর্থনৈতিক সূচক ও অর্থনীতিকে প্রভাবিত করে এমন জটিলতা বিবেচনা করে প্রশ্ন থেকে যায় যে, এপ্রিলের মধ্যে ডলারের হার স্থিতিশীল হতে পারে কিনা? উত্তরটি অর্থনৈতিক পরিস্থিতির বাস্তবতা দ্বারা প্রভাবিত আশাবাদ ও সতর্কতার একটি সূক্ষ্ম ভারসাম্যের মধ্যে রয়েছে। রেমিট্যান্স প্রবাহ ও রপ্তানি আয় বৃদ্ধি বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে সাহায্য করতে পারে। কাঠামোগত ভারসাম্যহীনতা, ক্রমবর্ধমান আমদানি ব্যয় ও বাজারের ওঠানামা চ্যালেঞ্জ তৈরি করে। এই চ্যালেঞ্জগুলোকে কার্যকরভাবে নেভিগেট করার জন্য সক্রিয় সরকারি হস্তক্ষেপ ও নীতিমূলক পদক্ষেপগুলো অপরিহার্য হবে। বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতা মোকাবেলা করা, রপ্তানি প্রতিযোগিতা বাড়ানো, বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে তারল্য ব্যবস্থাপনা ডলারের হার স্থিতিশীল করা ও দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার প্রধান অগ্রাধিকার হবে। বৈশ্বিক অস্থিরতার মধ্যে বাংলাদেশ যখন অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন সক্রিয় পদক্ষেপ, সতর্ক নীতিনির্ধারণ ও কাঠামোগত ভারসাম্যহীনতা মোকাবেলার সক্ষমতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হবে।
ৎড়নরহ.ঃধৎবয়@মসধরষ.পড়স
অনুবাদ : জান্নাতুল ফেরদৌস। সূত্র : দি ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস