প্রীতি উরাং ও তার দুই সহোদরা, তাদের নিয়ে একটি সরেজমিন প্রতিবেদন
ফারাহ তানজিম তিতলি
তিন জন শিশুর কথা বলব আজ। তাদের একজন এখন কৈশোরে পা দিয়েছে। অনেক কথা বলব নাকি অল্প কথা বলব, তাই নিয়ে আকুল আছি। সত্য নাম বলব নাকি ছদ্মনাম বলব সেটাও চিন্তার বিষয়। ছদ্মনামের দুর্বলতা হলো, সেটা বিষয়ের দগদগে ক্ষতকে অনুধাবন করতে দেয় না।
যে তিন কন্যার কথা বলতে এসেছি, তাদের প্রত্যেকেই দৈনিক ডেইলি স্টারের নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আশফাকুল হকের বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করেছে।
তিন জনের একজন প্রীতি উরাংয়ের কথা অনেকেই জানেন। প্রীতি সৈয়দ আশফাকের বাসা থেকে লাফিয়ে পড়ে মারা গেছে। প্রীতির এই মৃত্যু হত্যা নাকি প্ররোচনাজনিত আত্মহত্যা এ প্রশ্নের উত্তর অমীমাংসিত। মামলায় ঘটনাটিকে অবহেলাজনিত মৃত্যু বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
স্কুল শিক্ষকেরা বলেছেন প্রাকস্কুল ছাড়ার সর্বোচ্চ বয়স সাত বছর। সাত বছরে স্কুল ছাড়লে মৃত্যুকালে প্রীতির বয়স হয় তেরো বছর। পত্রিকা এবং এজাহারে যদিও পনেরো বছর লেখা হয়েছে। স্কুলের নথি এবং ভবনের সিসিটিভি ফুটেজ দুটোই অবশ্য হারিয়ে গেছে। শুনেছি প্রীতি খুব বুদ্ধিমতী ছিল। খোলা জানালা ধরে সে ঝুলে ছিল অন্তত বারো মিনিট। বাঁচার জন্য চিৎকার করেছিল। প্রতিবেশী দরিদ্র লোকেরা তাকে বাঁচাতে বারবার গার্ডকে বলেছিল ২/৭, নম্বর শাহজাহান রোডের গেট খুলতে। বারো মিনিট সময় পেয়েও তার জন্য নিচে একটা চাদর না ধরার জন্য কে দায়ী, আমি জানি না। দায়ী কি কেবল নাগরিক নির্লিপ্ততা?
প্রীতি আদিবাসী সমাজের মেয়ে। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের ওঁরাওরা নামের শেষে সাধারণত ওঁরাও পদবি ব্যবহার করলেও চা-বাগানে থিতু হওয়া ওঁরাওরা পদবীতে লেখে উরাং। প্রীতি উরাং মৌলভীবাজারের একটি চা-বাগানের একজন অস্থায়ী শ্রমিকের কন্যা।
আদিবাসীদের কষ্টসহিষ্ণুতা এবং বেঁচে থাকার ইচ্ছে সচরাচর বেশি থাকে। সে হোক উত্তর-জনপদের সমতলে, পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ে, গারো পাহাড়ের পাদদেশে বা চা-বাগানের সবুজে। প্রকৃতির কোলের এই মানুষেরা হতাশার জটিলতা জানে না। তারা সরল পরিশ্রম চেনে। তাই মরার সময়েও প্রীতি বাঁচতে চেষ্টা করেছিল।
আরেকজন শিশু গৃহসহকারীর ছদ্মনাম দিলাম ফুল। ফুলও গত বছর আগস্ট মাসে সৈয়দ আশফাকের বাসা থেকে লাফিয়ে পড়ে মরতে চেয়েছিল। আমরা কয়েকজন গিয়েছিলাম এই শিশুদের বাড়িগুলোতে, আসলে কী ঘটেছিল জানতে। ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় আমাদের দলে ছিলেন লেখক-গবেষক প্রিসিলা রাজ, সাংবাদিক এবং সমাজকর্মী মৃধা মোরাদ, আমি এবং আরো কয়েকজন। এই ফুলটির জীবন আর কখনো ফুটে উঠবে কিনা জানি না।
আমাদেরকে ফুল বলেছে সে মরে যেতে চেয়েছিল। চেনাশোনা সাত বছরের শিশুদের কথা স্মরণ করলাম। মৃত্যু সম্পর্কে তাদের পরিষ্কার ধারণা আছে বলে মনে হচ্ছে না। তবুও যে বাসা থেকে পড়ে প্রীতি মারা গেছে, সেই বাসার একই খোলা বারান্দা থেকে ফুল লাফ দিয়ে মরে যেতে চেয়েছিল।
ব্রাক্ষণবাড়িয়ার এক গ্রাম থেকে সৈয়দ আশফাকুল হকের বাড়িতে ঘরের কাজ করতে এসেছিল শিশুটি। একান্ত কথাবার্তার সময় ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে আঁতকে উঠছিল শিশুটি। কেঁদে লুটিয়ে পড়ছিল সে। তাকে প্রশ্ন করার অপরাধে তার কাছে আমি ক্ষমাপ্রার্থী। সে বলেছে, দুই পায়ের মাঝে ব্যথা পেয়েছে লাফিয়ে পড়ার পরে নয়, আগে। একদিন না চারদিনই সে নিপীড়নের শিকার হয়েছে। শেষের দিন ভয়ঙ্কর ব্যথা পেয়ে মরে যাবার জন্য সে লাফিয়ে পড়েছিল আটতলার জানালা দিয়ে।
সাত বছরের শিশুটি নারী পুরুষের ইচ্ছাকৃত বা জবরদস্তিমূলক শারীরিক সম্পর্ক বোঝে না। তার কাছ থেকে পাওয়া ছোট ছোট প্রশ্নের? উত্তর জোড়া দিতে হয়েছে। আলাপের প্রত্যক্ষ শ্রোতা ছিলেন সেখানকার আমাদের প্রিসিলা রাজ এবং একজন নারী ওয়ার্ড মেম্বার। মেডিকেল রিপোর্টে বলা হয়েছে প্রস্রাবের রাস্তা থেকে পায়ুপথ পর্যন্ত ৩-২-২ সেন্টিমিটার দীর্ঘ-চওড়া-গভীর ক্ষত হয়েছে। শিশুর মা-বাবা হাসপাতালে পৌঁছে দেখতে পান, তার জননাঙ্গের অপারেশন চলছে। নারীদেহের এই গভীর এবং সংরক্ষিত জায়গাটি বাইরের আঘাতে এমন ক্ষতবিক্ষত হতে পারে না বলে আমার ধারণা। কয়েকজন চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলেছি। বাচ্চার বাবা-মা বুঝে বা না বুঝে দুই লক্ষ টাকা নিয়ে মামলা তুলে নিয়েছেন। একেকবার একেক রকম কথা বলছেন। কিন্তু আমি ভুলতে পারছি না, অবুঝ শিশু বলেছে, আঘাত সে পেয়েছে লাফ দেয়ার আগেই। বাইরের প্রভাবমুক্ত মেডিকেল পরীক্ষার দাবি জানাচ্ছি আমি।
প্রীতির মতো আরেকটি ওঁরাও মেয়ে, তার নাম দেওয়া যাক শোভা। শোভা আট বছর বয়স থেকে সতেরো বছর বয়স পর্যন্ত সৈয়দ আশফাকুল হকের বাড়িতে কাজ করেছে। আমরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে মৌলভীবাজার পর্যন্ত ঘুরে আসার পর গিয়েছিলাম মোহম্মদপুরের ওই বহুতল ভবনটিতে। শুনলাম আশফাকুল হকের স্ত্রী তানিয়া খন্দকার শোভার বিষয়ে একজন প্রতিবেশীর কাছে বলেছেন, সে মাঝে মাঝে মিথ্যে গল্প বলে। শোভার মাথায় একটু গোলমাল আছে। জানি না, অন্য অনেক ছড়ানো মিথ্যের? মতো এই কথাও মিথ্যে কিনা। আমরা চারজন গিয়েছিলাম শোভার বাড়ি। সেখানে ছিলেন ফ্লোরা বাবলি তালাং যিনি কুবরাজ আন্তপুঞ্জি উন্নয়ন সংগঠন এর সাধারণ সম্পাদক, প্রিসিলা রাজ, মোঃ আবুল হাসান, সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট এবং আমি।
শোভার কাছে গিয়ে দেখলাম সবকিছু ঠিক আছে। তার কাছ থেকে আশফাকুল হকের গৃহের একটি শান্ত বিবরণ পাওয়া গেল। তবে আমাদের জানা মতে, শোভা দুটো প্রশ্নের উত্তরে সত্য তথ্য দেয়নি। এক, প্রীতি এবং সে দুজনেই ফোনে নিজেদের বাড়ির লোকের সঙ্গে কথা বলত। দুই, প্রীতি এবং ফুল দুটো আলাদা জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়েছে। ক্রস চেক থেকে এই দুটো মিথ্যে আমাদের কাছে প্রমাণিত হয়েছে। কারণ, প্রীতির সঙ্গে এক বছর পরিবারের যোগাযোগ ছিল না, যা প্রীতির মা-বাবা বারবার গণমাধ্যমে বলেছেন। আমাকেও প্রীতির বাবা তাই বলেছেন। আর আশফাকুল হকের শাহজাহান রোডের বাসার আশপাশের সব লোক বলেছে, দুজন এক জানালা দিয়েই পড়েছে। শোভা এক বিপর্যস্ত মুহূর্তে বলেছে, প্রীতিকে সে বাড়ি চলে যেতে বলেছিল। কারণ, এত মারধর সহ্য করে প্রীতি থাকতে পারবে না, যা শোভা সহ্য করেছে। আমাদের মনে হয়েছে, শোভাকে শুধু মারধর নয়, অন্যকিছুও সহ্য করতে হয়েছে। মনে হবার অসংখ্য কারণ রয়েছে। কয়েকটা বলি।
এক, একটা স্বাভাবিক গৃহে দুইবার দু’জন গৃহ সহকারী লাফিয়ে পড়তে পারে না।
দুই, শারীরিক সম্পর্কের মিথ্যে বয়ান দেবার জন্য যথেষ্ট বয়স হয়নি ফুলের। সে জবরদস্তিমূলক শারীরিক সম্পর্কের বয়ান দিয়েছে। তার জননাঙ্গে দীর্ঘ, প্রশ্বস্ত এবং গভীর ক্ষত রয়েছে। ফুলের মা বলেছে, তাকে বিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে না। ফুল বলেছে, সে চারদিন ওই বাড়িতে ছিল, চারদিন তার সঙ্গে এমন ঘটনা ঘটেছে। চতুর্থ দিনের ভয়াবহতায় সে মরে যাবার জন্য লাফ দিয়েছিল।
তিন, ফুল নামে শিশুটি লাফ দেবার দিন ওই বাড়িতে ছিল শোভা। তবে সে দাবি করেছে গার্ড ইন্টারকমে ফোন করার আগে সে কিছুই জানত না। সম্ভবত সে আসলে নানা কিছু জানে, তবে বলতে পারছে না।
চার, সাত বছরের শিশু যেখানে চারদিনের চারদিনই আক্রান্ত হলো, সেখানে এগারো এবং আট বছর বয়স থেকে দীর্ঘদিন অবস্থানকারী শিশু দুজনেরও একই রকমভাবে আক্রান্ত হওয়া স্বাভাবিক।
পাঁচ, এই ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চারটি স্পটে কমপক্ষে দুইশত লোকের সঙ্গে কথা বলেছি। সবার মধ্যেই একটা সাধারণ বিষয় ছিল, সেটা হলো, ভয়। ভয় এবং অন্যায্য অর্থ এসব জায়গায় ছড়িয়ে ছিল বলে আমাদের মনে দৃঢ ধারণা জন্মেছে।
ছয়, অন্যায় না করে এতো ভয় কেন ছড়ানো হলো, সেটা একটা প্রশ্ন।
সাত, ফুলের পরিবারকে দুই লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে মামলা তুলে নেবার জন্য। আরো অনেক টাকা সৈয়দ আশফাকুল হকের নিয়োজিত দালালরা নিয়ে গেছে বলে অভিযোগ পেয়েছি। টাকা দেওয়া হযেছে প্রীতি মারা যাবার পর। এই অর্থ প্রদানের মধ্যে প্রীতির মৃত্যুরহস্য চাপা দেবার অভিপ্রায় আছে বলে আমাদের ধারণা।
আট, প্রীতি বারো-তেরো মিনিট গ্রিল ধরে ঝুলেছিল। সে বাঁচার আকুতি করেছিল। ভবনের চারপাশে হাজার মানুষ বিক্ষোভ করছিল। তারা নিচে চাদর পেতে বাচ্চাটিকে বাঁচাতে চেয়েছিল। আশফাকুল হকের পরিবার এবং ভবনের গার্ডরা প্রীতিকে বাঁচানোর উদ্যোগ নেয়নি। এলাকাবাসীকেও ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। প্রীতির মৃত্যু কি আশফাকুল হকদের বড় কোনো অপরাধ ঢাকবার সুযোগ করে দিয়েছে?
নয়, এই ঘরে কেন শিশুদেরকেই শ্রমিক হিসেবে আনা হতো বারবার?
অনেক কথা লেখা হলো না। প্রশ্ন আসলে উত্তর দেব। এই সকল ঘটনা অনেক গভীর অপরাধের একটু প্রকাশ হতে পারে হয়তো। ব্যক্তিগত উদ্যোগে সবকিছু জানা সম্ভব নয়। সার্বিক বিষয়ের সুষ্ঠু তদন্ত এবং ন্যায়বিচার দাবি করছি। ভদ্রতা করে যারা চুপ করে আছেন, তাদেরকে ভদ্রলোক না হয়ে মানুষ হতে আহ্বান জানাচ্ছি। (লেখকের সরেজমিন প্রতিবেদনটি তার ফেসবুক পোস্ট থেকে নেয়া)