টানা পতনে শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীরা নি:স্ব হচ্ছে আড়াই মাসে ডিএসইর বাজার মূলধন কমেছে ১ লাখ ৯ হাজার কোটি টাকা
মাসুদ মিয়া: [১] দেশের শেয়ারবাজার টানা দরপতনের কারনে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা নি:স্ব হচ্ছে। গত আড়াই মাসে প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ ডিএসইর বাজার মূলধন কমেছে ১ লাখ ৯ হাজার কোটি টাকার উপরে।
[২] গত ১৭ জানুয়ারি ডিএসইর বাজার মূলধন ছিল ৭ লাখ ৮৮ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা। ধারাবাহিকভাবে কমে সেই বাজার মূলধন এখন ৬ লাখ ৭৯ হাজার ২২৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ ডিএসইর বাজার মূলধন হারিয়েছে ১ লাখ ৯ হাজার ২২০ কোটি টাকা। দরপতনের কবলে পড়ে প্রতিদিন বিনিয়োগ করা পুঁজি হারাচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। প্রায় আড়াই মাস ধরে এই দরপতন চলছে।
[৩] এবিষয়ে বাজার সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, টানা দরপতনে কারনে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা নি:স্ব হচ্ছে। ফলে অনেকেই লোকসানে শেয়ার বিক্রির করে দিচ্ছে।
[৪] এবিষয়ে ডিএসইর এক সদস্য বলেন, শেয়ারবাজারে এখন যে দরপতন হচ্ছে তাকে স্বাভাবিক বলা যায় না। কিছুটা গুজব বা গুঞ্জনের কারণে এই দরপতন হতে পারে। তবে আমি মনে করি এই দরপতনের জন্য মূলত বিনিয়োগকারীদের মাত্রাতিরিক্ত বিক্রির চাপ মূল দায়ি। বিনিয়োগকারীরা বিক্রির চাপ কমালে বাজার ঘুরে দাঁড়াবে।
[৫] এদিকে চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারির পর থেকে শুরু হওয়া এই পতনের ধারা অব্যাহত ছিল গত সপ্তাহজুড়েও। গত সপ্তাহে শেয়ারবাজারে লেনদেন হওয়া চার কার্যদিবসের মধ্যে তিন কার্যদিবসেই দরপতন হয়ছে। এতে সপ্তাহ ব্যবধানে প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) বাজার মূলধন ১৩ হাজার কোটি টাকার বেশি কমেছে।
[৬] দীর্ঘ দিন ফ্লোর প্রাইস দিয়ে শেয়ার দাম এক জায়গা আটকে রাখার পর গত ১৮ জানুয়ারি ফ্লোর প্রাইস তুলে নেয় বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এরপর শেয়ারবাজারে বড় ধাক্কা লাগে। এই ধাক্কা সামলে যখন শেয়ারবাজার ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল, ঠিক সেই সময়ে জেড গ্রুপ নিয়ে বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যা শেয়ারবাজারের পতন ত্বরাণিত করে। এরপর আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি শেয়ারবাজার।
[৭] গত ১৭ জানুয়ারি ডিএসইর বাজার মূলধন ছিল ৭ লাখ ৮৮ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা। ধারাবাহিকভাবে কমে সেই বাজার মূলধন এখন ৬ লাখ ৭৯ হাজার ২২৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ ডিএসইর বাজার মূলধন হারিয়েছে ১ লাখ ৯ হাজার ২২০ কোটি টাকা। বাজার মূলধন কমার অর্থ তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ার ও ইউনিটের দাম সম্মেলিতভাবে ওই পরিমাণ কমেছে। অন্যভাবে বলা যায় ওই পরিমাণ অর্থ হাওয়া হয়ে গেছে।
[৮] শেয়ারবাজারের বড় অঙ্কের টাকা হাওয়া হয়ে যাওয়ার পাশপাশি মূল্য সূচক ও লেনদেনেও বড় ধাক্কা লেগেছে। ১৭ জানুয়ারি ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচক ছিল ৬ হাজার ৩৪৬ পয়েন্ট। এখন সেই সূচক কমে ৫ হাজার ৭৭৮ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচক কমেছে ৫৬৮ পয়েন্ট।
[৯] বিএসইসির বর্তমান চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম নেতৃত্বাধীন কমিশনের আমলেও এতো খারাপ অবস্থায় আর কখনো পড়েনি দেশের শেয়ারবাজার। করোনা আতঙ্কে ২০২০ সালের শুরুর দিকে শেয়ারবাজারে ভয়াবহ ধস নামলে লেনদেন বন্ধ করে দেন সাবেক চেয়ারম্যান খায়রুল হোসেনের নেতৃত্বাধীন কমিশন। এমন পরিস্থিতিতে ২০২০ সালের মে মাসে বিএসইসি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম। তার সঙ্গে কমিশনার হিসেব যোগ দেন আরও তিনজন।
[১০] বিএসইসির দায়িত্ব নিয়ে নতুন কমিশন টানা ৬৬ দিন বন্ধ থাকা শেয়ারবাজারে আবার লেনদেন চালু করেন ওই বছরের ৩১ মে। বন্ধ থাকা লেনদেন চালু করার পাশাপাশি অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধে কড়া বার্তা দেয় শিবলী কমিশন। অনিয়মে জড়িত থাকায় একাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে বড় অঙ্কের জরিমানা করা হয়। সতর্ক করা হয় সরকারি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশকে (আইসিবি)। বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউসকে জরিমানার পাশাপাশি সতর্ক করা হয়। পরবর্তীতে আইসিবিকে পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। বাতিল করা হয় এক ডজন দুর্বল কোম্পানির আইপিও।
[১১] এ ধরনের পদক্ষেপ নিয়ে বিভিন্ন পক্ষের প্রশংসা কুড়ান শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম নেতৃত্বাধীন কমিশন। যার ইতিবাচক প্রভাব পড়ে শেয়ারবাজারেও। করোনা মহামারির মধ্যেই ঘুরে দাঁড়ায় শেয়ারবাজার। ৫০ কোটি টাকার ঘরে নেমে যাওয়া লেনদেন হাজার কোটি টাকায় চলে আসে।
[১২] এরপর মাঝে শেয়ারবাজারে কয়েক দফায় উত্থান-পতন চললেও এখন খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে রয়েছে শেয়াবাজার। চার বছরের জন্য দায়িত্ব পাওয়া শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম এবং তিন কমিশনের মেয়াদ প্রথম দফায় শেষ হচ্ছে আগামী মে মাসে। শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলামের প্রথম দফার মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগ মুহুর্তে এমন বেহাল অবস্থার মধ্যে পড়েছে শেয়ারবাজার।
[১৩] বএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, শেয়ারবাজারে এখন বিয়ারিশ ট্রেন্ড (মন্দা অবস্থা) চলছে। পেনিক সেল এবং ফোর্স সেলের কারণে এই রিয়ারিশ অবস্থা বিরাজ করছে বলে আমরা মনে করছি। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য কমিশন বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে।
[১৪] কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ক্যাপিটাল মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ড (সিএমএসএফ) থেকে পুঁজিবাজার মধ্যস্থতাকারীদের ১০০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, সেই অর্থ এখনো দেওয়া হয়নি। এই অর্থ যাতে দ্রুত দেওয়া হয়, কমিশন সেই চেষ্টা করছে। পাশাপাশি বাজার উন্নয়নে সব পক্ষের সঙ্গে সম্মেলিতভাবে কাজ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
[১৫] তিনি আরও বলেন, কেউ বিশেষ উদ্দেশ্যে বাজার অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে কি না সে বিষয়ে ক্ষতিয়ে দেখা হবে। কেউ এ ধরনের চেষ্টা করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
[১৬] গত সপ্তাহে শেয়ারবাজারে লেনদেন হওয়া চার কার্যদিবসের মধ্যে তিন কার্যদিবসেই দরপতন হয়েছে। এতে সপ্তাহজুড়ে ডিএসইতে লেনদেনে অংশ নেওয়া মাত্র ৩৫টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট দাম বাড়ার তালিকায় নাম লিখিয়েছে। বিপরীতে দাম কমেছে ৩৪৩টির। আর ১৫টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে।
[১৭] বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের দাম কমায় সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসের লেনদেন শেষে ডিএসইর বাজার মূলধন দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৭৯ হাজার ২২৯ কোটি টাকা। যা গত সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসে ছিল ৬ লাখ ৯২ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা। অর্থাৎ সপ্তাহের ব্যবধানে ডিএসইর বাজার মূলধন কমেছে ১৩ হাজার ৩১১ কোটি টাকা।
[১৮] এদিকে, ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচক ডিএসইএক্স কমেছে ১৬৩ দশমিক ৩৪ পয়েন্ট বা ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ। অপর দুই সূচকের মধ্যে বাছাই করা ভালো কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএসই-৩০ সূচক কমেছে ৪৬ দশমিক ৬৩ পয়েন্ট বা ২ দশমিক ২৭ শতাংশ। আর ইসলামী শরিয়াহ ভিত্তিতে পরিচালিত কোম্পানি নিয়ে গঠিত ডিএসই শরিয়াহ্ সূচক কমেছে ৩৮ দশমিক ৪৯ পয়েন্ট বা ২ দশমিক ৯৮ শতাংশ।
[১৯] মূল্য সূচকের বড় পতনের পাশাপাশি লেনদেনের গতিও কমেছে। সপ্তাহের প্রতি কার্যদিবসে ডিএসইতে গড়ে লেনদেন হয়েছে ৪৯৩ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। আগের সপ্তাহে প্রতিদিন গড়ে লেনদেন হয় ৪৯৬ কোটি ২৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রতি কার্যদিবসে গড় লেনদেন কমেছে ২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা বা দশমিক ৪৭ শতাংশ।
[২০] সপ্তাহজুড়ে ডিএসইতে টাকার অঙ্কে সব থেকে বেশি লেনদেন হয়েছে এশিয়াটিক ল্যাবরেটরিজের শেয়ার। দৈনিক গড়ে কোম্পানিটির শেয়ার লেনদেন হয়েছে ২৮ কোটি ৩২ লাখ টাকা, যা মোট লেনদেনের ৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ। দ্বিতীয় স্থানে থাকা সেন্ট্রাল ফার্মাসিউটিক্যালসের শেয়ার দৈনিক গড়ে লেনদেন হয়েছে ২৪ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। ১৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকা লেনাদেনের মাধ্যমে তৃতীয় স্থানে রয়েছে আলিফ ইন্ডাস্ট্রিজ।
[২১] এছাড়া লেনদেনের শীর্ষ দশ প্রতিষ্ঠানের তালিকায় রয়েছে, বেস্ট হোল্ডিং, গোল্ডেন সন, ফু-ওয়াং সিরামিক, শাহিনপুকুর সিরামিক, মালেক স্পিনিং, ফরচুন সুজ এবং এমারেল্ড অয়েল।