ভারতীয় পণ্য বর্জন নাকি স্বদেশী পণ্য ব্যবহার?
হাসান তারেক চৌধুরী : শুরুতেই বলে নিচ্ছি, আমি এই ‘বর্জন’ আন্দোলনের সফলতা-ব্যর্থতা নিয়ে কিছু বলতে আসিনি। সেটা নিয়ে আলাপ করার মতো নির্ভরযোগ্য পর্যাপ্ত পরিমাণ তথ্য আমার কাছে নেই। তাহলে আলোচনা কী নিয়ে? আমার আলোচনা এই ‘বর্জন’ শব্দটি নিয়ে। আর এর মাধ্যমে কী অর্জন হতে পারে, কিবা ক্ষতি হতে পারে। তবে শব্দটি যে শক্তিশালী তা আমরা সহজেই বুঝতে পারছি। এতোটাই শক্তিশালী যে, আপামর জনসাধারণ তো বটেই, ভারতকে স্বঘোষিত বন্ধু দাবি করা ব্যক্তিবর্গ এবং মন্ত্রী থেকে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত এ আলোচনায় জড়িয়ে পড়েছেন।
তাহলে কি ‘বর্জন’ তত্ত্ব সফল? প্রথমত : একটি আন্দোলনের সফলতা নির্ভর করে তার উদ্দেশ্য কী ও লক্ষ্য কারা তার ওপর, দ্বিতীয়ত : তার তাৎক্ষণিক ও সুদূরপ্রসারী ফলাফল কী তার ওপর। প্রথম প্রসঙ্গে বলি ভারতীয় পণ্য বর্জনের এই আন্দোলনের উদ্দ্যেশ্য কী ও লক্ষ্য কারা। তাহলে প্রথমেই প্রশ্ন জাগে, এই আন্দোলনের ডাক দিয়েছে কারা? সাধারণ ভাবনায় এই আন্দোলনের ডাক দিয়েছে দেশের একটি প্রধান সরকারবিরোধী দল, তাদের সমর্থক ও সম্ভবত কিছু সাধারণ মানুষ। ব্যাপারটা কী আমাদের ভাবায় না? বিরোধীদলের বা সাধারণ জনগণের আন্দোলন হবে সরকারের বিরুদ্ধে, ভিন্ন একটি দেশের বিরুদ্ধে কেন? এর অর্থ দাঁড়ায় আপনি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভিন্ন রাষ্ট্রকে পরোক্ষভাবে মোড়ল মেনে নিচ্ছেন। বাস্তবতা যাই হোক না কেন, এই মেনে নেওয়ার সুদূরপ্রসারী বিপদ কি আপনারা বুঝতে পারছেন? এখন হয়তো অনেকেই বলবেন। এই বর্জন তো কাজ দিচ্ছে। তাদের নাড়া দিয়েছে।
তাহলে সমস্যা কী? এ উত্তর হচ্ছে বড় একটা সমস্যা আছে। কারণ এর সুদূরপ্রসারী ফল মারাত্মক। ‘বর্জন’ শব্দটি একপ্রকার ঘৃণার বাহক। যার মাধমে সাময়িক বিজয় পাওয়া গেলেও এর পরিণাম দীর্ঘ মেয়াদে কখনো ভালো হয় না। এটা জাতিগত ঘৃণা ছড়ায় একে কিছুতেই দেশপ্রেমের নিদর্শন বলা যায় না। দেশপ্রেমই যদি থাকতো, তাহলে এই বর্জন আন্দোলনেরই প্রয়োজন পড়তো না। এই আন্দোলনের ডাক যারা দিয়েছেন, তারা এর মাধ্যমে কী অর্জন করতে চান? সহজভাবে বলতে গেলে, বাংলাদেশ যেহেতু ভারতের একটি বড় বাজার; তারা এই বর্জনের মাধ্যমে ভারতকে চাপে ফেলতে চান, যেন ভারত বর্তমান সরকারকে সহায়তা না দেয়। এটা সত্য যে সত্যিকার বর্জন, ভারতকে, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গকে অর্থনৈতিক চাপে ফেলতে সক্ষম। কিন্তু তাতে কি সমস্যার সমাধান হবে? নাকি সরকার তখন অন্য কোনো উপায়ে ‘বন্ধু’ ভারতকে পুষিয়ে দিতে চেষ্টা করবে? তার ফলাফল আরও খারাপ হতে বাধ্য।
বরং, আন্দোলনটা পজিটিভ টোনে করা যেতে পারে। তাতে কোনরকম ঘৃণা ছড়ানো ছাড়াই, একই উদ্দেশ্যে হাসিল হবে। সেটা হতে পারে ‘স্বদেশিসপণ্য ব্যবহার’ আন্দোলন। যেসব পণ্যের দেশি বিকল্প আছে, সেসব ক্ষেত্রে সবাই যদি বিদেশি পণ্য পরিহার করে এবং দেশি পণ্য ব্যবহার করে। তবে সেটাও একই উদ্দ্যেশ্য অর্জনে সমর্থ হবে। এই আন্দোলন সফল হলে তা তরুণদের মধ্যে দেশপ্রেম ও জাতি সচেতনতা জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হবে। এই ফলাফল হবে সুদূরপ্রসারী। শেষ আরেকটি কথা বলছি। খেলা নিয়ে সাময়িক ঝগড়াঝাটি কথা আলাদা; কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে পাশাপাশি দুটা দেশের ভেতরে, বিশেষত যেখানে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ পরিবারগুলো দু’দেশে ছড়িয়ে আছে, সেখানে কী এধরনের বর্জন-প্রতিশোধ আসলেই সম্ভব? ম্যাপের উপর কলমের দাগ দু’টা তিনটি অঞ্চলে রক্ত-সম্পর্কের আত্মীয়দের বিচ্ছিন্ন করে দু’দেশে পাঠিয়ে দিয়েছিলো বাংলা, পাঞ্জাব ও কাশ্মীর। এক দেশে ভাই, অন্য দেশে বোন, এক দেশে বাবা, অন্যদেশে ছেলে এসব ঘটনা ঘরে ঘরে ঘটেছে। আজ তাদের অনেকেই বেঁচে আছেন, অথবা তাদের বংশধরেরা বেঁচে আছে। ঘৃণা ছড়িয়ে কি তাদের আলাদা করা সম্ভব? সম্ভব না?
এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য যা প্রয়োজন তা হলো সঠিক পথটি বেছে নেয়া। ভারতীয় পণ্য বর্জনের বদলে, কষ্ট স্বীকার করে হলেও দেশি পণ্য ব্যবহারের আন্দোলন গড়ে তোলা এবং এর মাধ্যমে দেশপ্রেম জাগিয়ে তোলা। তাতে বর্তমান ও ভবিষ্যত উভয় ক্ষেত্রেই আমরা লাভবান হবো। দুঃখজনক হলেও একথা সত্যি যে আমাদের দেশপ্রেম এখন নামতে নামতে এমন তলানিতে নেমেছে যে, তা শুধু ক্রিকেট আর মুরগীতে এসে দাঁড়িয়েছে। খাওয়ার সময় দেশি মুরগি আর দেশপ্রেমের একমাত্র চিহ্ন ক্রিকেট। এই দেশি মুরগি বলতে দেশে উৎপাদিত যেকোনো মুরগী বোঝায় না বরং এটি বিশেষ প্রজাতির মুরগী। অন্যদিকে, ক্রিকেটে আবার সাকিবিয়ান আর তামিমিয়ান নামে দুটা টক্সিক গ্রুপ আছে। সেই আলোচনায় আজ আর নাই গেলাম। ২৯.৩.২৪।
ফেসবুক থেকে