বৈদেশিক ঋণ, দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যিক ঋণ ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ
সৈয়দ ফাত্তাহুল আলিম : অতীতে করা কিছু গবেষণায় দেখা গেছে নিম্ন আয়ের দেশগুলোর ক্ষেত্রে মোট বৈদেশিক ঋণ জিডিপি বৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। কিন্তু মধ্যম আয়ের ক্ষেত্রে বৈদেশিক ঋণ ইতিবাচকভাবে আয় বৃদ্ধির সঙ্গে যুক্ত
ছিলো। এই সমীক্ষায় আরও দেখা গেছে যে, কিছু ক্ষেত্রে এমনকি ঋণ-থেকে-জিডিপি অনুপাত ২০ শতাংশের কম হলেও সংশ্লিষ্ট অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকারক হতে পারে। যখন অন্যদের জন্য ক্ষতিকারক প্রভাবগুলো প্রদর্শিত হতে শুরু করে তখন অনুপাত ৬০ শতাংশের মতো হয়। বিশেষ করে যখন বৈদেশিক ঋণের মাত্রা উচ্চ ও অস্বাভাবিক বলে প্রমাণিত হয়, তখন এটি উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। কারণ সেক্ষেত্রে তারা বিনিময় হারের ওঠানামা ও পুঁজি প্রবাহে পতনের সম্মুখীন হয়, যা ব্যাংকিং ও মুদ্রা সংকটের দিকে যেতে পারে। সুতরাং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির উপর বৈদেশিক ঋণের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব বিবেচনা করে একটি দেশের বৈদেশিক ঋণ সম্পর্কে নীতিনির্ধারকদের সতর্ক হওয়ার কারণ রয়েছে।
এই পর্যবেক্ষণগুলো বাংলাদেশের জন্য প্রাসঙ্গিক। কারণ এটি শীঘ্রই একটি স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) হিসেবে তার বর্তমান অবস্থা থেকে স্নাতক হওয়ার পরে মধ্যম আয়ের দেশের গ্রুপে যোগ দিতে চলেছে। এ প্রেক্ষাপটে দেশের বর্তমান বৈদেশিক ঋণ পরিস্থিতির ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের (বিবি) সাম্প্রতিক প্রতিবেদন বিষয়টির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বিবি রিপোর্ট বলছে, বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ প্রথমবারের মতো ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে ১০০.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। এটি আগের বছরের মোট ৯৬.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের চেয়ে ৪.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বেশি। এই ঋণের মধ্যে রয়েছে ৭৯.৬৯ বিলিয়ন ডলার সরকারি খাতের ঋণ ও ২০.১ বিলিয়ন ডলার বেসরকারি খাতের ঋণ। বিদেশি ঋণদাতা যাদের কাছে মোট বৈদেশিক ঋণ পাওনা রয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছে বিশ্বব্যাপী বহুপাক্ষিক ঋণদাতা, বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। সুসংবাদ হলো যে বৈদেশিক ঋণের ৮৫ শতাংশ দীর্ঘমেয়াদী, বাকিগুলো স্বল্পমেয়াদী। প্রতিবেদনটি এমন সময়ে এসেছে যখন দেশটি বৈদেশিক রেমিট্যান্সের অভ্যন্তরীণ প্রবাহের হার হ্রাস (অভিবাসী শ্রমিকদের কাছ থেকে), অস্থিতিশীল বৈদেশিক মুদ্রার বাজার, মার্কিন ডলারের বিপরীতে দেশীয় মুদ্রার মূল্য হ্রাস ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাসের মতো চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে।
গত বৃহস্পতিবার, বিবি ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের বৈদেশিক ঋণের অবস্থা জাতিকে জানিয়েছিলো। তবে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করার সময়, বিবির মুখপাত্র আশ্বাসের নোট সহ প্রেসকে বলেছিলেন যে ঋণ-টু-জিডিপি অনুপাত সহনীয় পর্যায়ে ছিলো। যে কোনও বহিরাগত উৎস থেকে অতিরিক্ত ঋণ চাওয়া হলেও কোনও সমস্যা হবে না। প্রকৃতপক্ষে বৈদেশিক ঋণের এই পরিমাণও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করেনি। কিন্তু বিবির মুখপাত্রের বক্তব্য যে দেশের কাঁধে এই বিশাল ঋণের বোঝা থাকা সত্ত্বেও দেশ এখনও ঋণের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ। একটি দেশের ক্রেডিট রেটিং একটি নির্দিষ্ট সময়ে সম্ভাব্য ঋণদাতাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনার বিষয়। দেশের জিডিপি-এর তুলনায় মোট ঋণের পরিমাণ ঠিক আছে এই সহজ কারণের জন্য যে এই বিপুল পরিমাণ ঋণের অর্থ পরিশোধ করতে হবে, তার জন্য আত্মতুষ্টির কোনো অবকাশ নেই। সুতরাং, সরকার কীভাবে ঋণ পরিশোধ করতে যাচ্ছে ও ঋণের গঠন কী তা জানা গুরুত্বপূর্ণ। তাহলে কীভাবে ঋণের পরিমাণ এতো বিশাল আকারে বেড়ে গেলো? কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনগুলো দেখায় যে মাত্র সাত বছর আগে ২০১৭ সালে দেশের মোট বৈদেশিক ঋণ ছিলো ৫০.৩১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
তার মানে গত সাত বছরে এই পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে সর্বশেষ সংখ্যায় পৌঁছেছে ১০০ বিলিয়ন ডলারে। মাত্র এক দশক আগে ২০১৪ সালে মোট ঋণের পরিমাণ ছিলো ৩৭.৪৭ বিলিয়ন ডলার। অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ বেশ দ্রুতগতিতে বেড়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ব্যাপক বৃদ্ধির জন্য পদ্মা সেতু রেল সংযোগ, কর্ণফুলী টানেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মতো বড় অবকাঠামো প্রকল্প নির্মাণে চীন ও রাশিয়া থেকে দ্বিপাক্ষিক ঋণ প্রাপ্তির দিকে ইঙ্গিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এছাড়াও, মহামারীকালীন ভ্যাকসিন সহায়তা কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য বিশ্বব্যাংক (ডব্লিউবি), এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি), জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা), আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও ইউরোপীয় বিনিয়োগ ব্যাংক (আইএমএফ) সহ বহুপাক্ষিক দাতাদের দ্বারা ঋণ প্রসারিত করা হয়েছিলো। ২০১৯ ও ২০২১-এর মধ্যে মাত্র দুই বছরের মধ্যে, ঋণের পরিমাণ ২০১৯ সালে ৬০.২৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে ২০২১ সালে ৯০.৭৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। মহামারী চলাকালীন ব্যবসা ও বিনিয়োগগুলো মন্দার মধ্যে ছিলো। বোধগম্যভাবে, বহুপাক্ষিক দাতাদের কাছ থেকে ঋণগুলো সস্তা ছিলো ও ঋণদাতারাও বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে ঋণ অগ্রিম করতে আগ্রহী ছিলো যাতে তারা মহামারীর সঙ্গে আরও ভালোভাবে লড়াই করতে পারে।
সুতরাং সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বিভিন্ন বহুপাক্ষিক দাতাদের কাছ থেকে নেওয়া ৩০.৫০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের ঋণ, যা বেশিরভাগই দীর্ঘমেয়াদী নিয়ে গঠিত তা বড় উদ্বেগের বিষয় হওয়া উচিত নয়। তা সত্ত্বেও, বাস্তবতা রয়ে গেছে যে ঋণগুলো নিয়ে সরকারের একটি পরিকল্পনা থাকা উচিত যে বাণিজ্যিক প্রকৃতির দ্বিপাক্ষিক ঋণের অতিরিক্ত চাপ থাকলে কীভাবে সেগুলো পরিশোধ করা যায়। কিছু বিশেষজ্ঞের মতে দ্বিপাক্ষিক ঋণদাতাদের কাছ থেকে বিশেষ করে সরবরাহকারীদের ঋণের ভিত্তিতে সরকারের আর কোনো ঋণ নেওয়া উচিত নয়। এখন যেহেতু অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি শ্লথ হয়ে গেছে মূলত বৈদেশিক মুদ্রার সংকট মেটানোর কারণে বিদ্যমান ঋণের পরিচর্যা সমস্যাযুক্ত হতে পারে। উল্লেখযোগ্যভাবে, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে নভেম্বরের মধ্যে (২০২৩-২৪ অর্থবছর) সরকার, বহিরাগত ঋণ সেবার অংশ হিসেবে, সুদের হিসেবে ৫৬২ মিলিয়ন ডলার অর্থ প্রদান করেছে। এটি ঋণ সেবায় সরকারের ব্যয়ের ১৩৭.৬ শতাংশ বৃদ্ধিকে চিহ্নিত করে। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যিক ঋণ পরিশোধের সময় এলে পরিমাণ আরও একটি বড় হতে পারে। যেহেতু ঋণের মাধ্যমে বাস্তবায়িত প্রকল্পগুলো থেকে দ্বিপাক্ষিক বা অন্যথায়, ডলারে নয়, টাকাতে আসবে, তাই ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য বেশি হলে সরকার যে পরিমাণ অর্থ প্রদান করবে তার থেকে বেশি হবে প্রকল্প ঋণ পাওয়ার সময়। সুতরাং এই ধরনের অসামান্য পরিমাণের বাহ্যিক ঋণ মোকাবেলা করার সময় এই পয়েন্টগুলো বিবেচনা করতে হবে।
ংভধষরস.ফং@মসধরষ.পড়স অনুবাদ : জান্নাতুল ফেরদৌস। সূত্র : দি ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস