বিদ্যুৎ উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে গ্যাসের উৎপাদন বাড়াতে হবে
এবি সিদ্দিক
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে ৪৫ দশমিক ৮৩ শতাংশ বিদ্যুৎ গ্যাস নির্ভরশীল। ক্যাপটিভ বিদ্যুতে গ্যাসের চাহিদা ১৫ দশমিক ৬৬ শতাংশ। গৃহস্থালী খাতে গ্যাসের ব্যবহার ১৩ দশমিক ৩৭ শতাংশ, সাড়ে ৫ দশমিক ৪৯ শতাংশ,সিএনজি খাতে ৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ,বণিজ্যিক খাতে শূন্য দশমিক ৫৫ শতাংশ, চা শিল্পে শূন্য দশমিক ১১ শতাংশ আর ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প খাতে ১৫ দশমিক ৬৬ শতাংশ গ্যাসের চাহিদা রয়েছে বা বর্তমানে ব্যবহার হচ্ছে। পেট্রোবাংলার গত ২০২১ সালের মাসিক এম আই এস রিপোর্টে জানা যায়, গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে মোট গ্যাসের উৎপাদন ছিলো ২৭ হাজার ৫৫৯ দশমিক ২৫৫ এমএমসিএফ (মিলিয়ন ঘন ফুট) যা ২০২০-২১ সালের মে মাসে কমে দাঁড়ায় ২৩ হাজার ৯১ দশমিক ৮৬৭ এমএমসিএফ’এ। একই সময়ের ব্যবধানে দেশিয় কোম্পানীগুলো উৎপাদন ১১ হাজার ১৯৪ দশমিক ৩৮৩ এমএমসিএফ থেকে কমে ৭ হাজার ৯৮৭ দশমিক ৬৫৮ এমএমসিএফ’এ দাঁড়ায়। অপরদিকে আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানী (আইওসি) গুলোর উৎপাদনও একই সময়ের ব্যবধানে ১৬ হাজার ৬৪ দশমিক ৮৭২ থেকে কমে ১৫ হাজার ১০৫ দশমিক ২০৯ এমএমসিএফ দাঁড়ায়। এক কথায় গ্যাসের উৎপাদন দ্রুত কমে আসছে। গ্যাসের উৎপাদন ও সরবরাহ কমার সঙ্গে পেট্রোবাংলার মুনাফও কমছে বলে জানা গেছে।
গত ২০২১ সালে গ্যাস বিক্রয় বাবদ আয় ছিলো ১ হাজার ২৬ কোটি ৯৪ লাখ টাকা যা পরের মাসে বেড়ে ১ হাজার ১১৫ কোটি ৫০ লাখ ৯৪ হাজার টাকা। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে মোট আয় ছিলো ১০ হাজার ৯৫২ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। পেট্রোবাংলা গ্যাস, কয়লা সহ অন্যান্য উৎপাদিত দ্রব্য বিক্রি করে গত অর্থবছরে কর আন্তঃ নীট মুনাফা করে ১ হাজার ৬৫১ কোটি ৯০ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। আর রাষ্ট্রীয় কোষাগারে দিয়েছে ৭ হাজার ৯১৭ কোটি ১ লাখ ২৪ হাজার টাকা। সরকার গ্যাসে মুনাফা করলেও সংকট মোকাবেলায় এলএনজি আমদানিতে ভতুর্কি দিতে গিয়ে হিমহিস খেতে হচ্ছে। বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম বাড়ছেই। আর এলএনজি আমদানি করতে গিয়ে সরকারকে মোটা অংকের লোকসানও গুণতে হচ্ছে। গত ২০২০-২১ অর্থবছরে সরকার ১৭ হাজার কোটি টাকার এলএনজি আমদানির সিন্ধান্ত নেয়া হয় যাতে ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ ধরা হয় ২ হাজার ৮ শত কোটি টাকার বেশি। আর জাতীয় বাজেটের আওতায় এলএনজি আমদানি মূল্য পরিশোধ বাবদ পেট্রোবাংলাকে দেয়া হয় ১ হাজার ৪ শত কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে গ্যাস উৎপাদন ও এলএনজি আমদানিসহ গ্যাস সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ হাজার ৭৯ বিসিএফ। প্রতি ঘনমিটারে ভতুর্কি যাচ্ছে ২ টাকা ২১ পয়সা। এতে করে ভতুর্কি গুনতে হবে প্রায় ৬ হাজার ৮ শত কোটি টাকা। এর আগের অর্থবছরে ভতুর্কি দেয়া হয় আড়াই হাজার কোটি টাকা।
গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানোর বিষয়ে সরকারের কোনো মাথাব্যথা নেই। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্সকে যথাযথভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে না। বাপেক্স বেশ কয়েকটি ক্ষেত্র আবিষ্কার করেছে। আর নিজেরাও ৮টি ক্ষেত্রের ৭টিতে গ্যাস উৎপাদন করছে। তাদের দৈনিক উৎপাদিত গ্যাসের পরিমাণ প্রায় ৩ দশমিক ৬৯২ মিলিয়ন ঘনফুট (এমএমসিএফ)। তবে বাপেক্স-এর রয়েছে নানা সীমাবন্ধতা। অভিযোগ, তাদের আবিষ্কৃত ক্ষেত্র দেয়া হচ্ছে বিদেশি কোম্পানীকে। তাদের উৎপাদিত গ্যাসের দামও কম দেয়া হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ। বাপেক্স-এর একজন সাবেক কর্মকর্তা জানান, ৮টি গ্যাস ফিল্ডর ৫টি গ্যাস ক্ষেত্রেও এই স্তর থেকে গ্যাসের সন্ধান মিলেছে। এই স্তরের আরো নিচে গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। এর জন্য প্রয়োজন ডিপ ড্রিলিং বা মাটির আরো গভীবে খনন কাজ চালানো। তিনি আরো বলেন, বাপেক্স-এর রিগগুলো গড়ে ৫ হাজার মিটারে খনন করার স্বক্ষমতা রয়েছে। ৭ হাজার মিটারের বেশি গভীরতায় খনন করতে হলে নতুন রিগ দরকার। কিন্তু তাদের রিগ সংকট রয়েছে বলে তিনি জানান। কিন্তু সরকার বিষয়টির প্রতি নজর দিচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন। অপরদিকে সুমদ্রে ভারত, মায়ানমার তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদন চালিয়ে যাচ্ছে। আর বাংলাদেশ সরকার তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদন করার জন্য কোনো উদ্যোগই নিচ্ছেন না। দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে মজুদকৃত গ্যাসের পরিমাণ।
বর্তমানে দৈনিক চাহিদা ৩৭০ কোটি ঘনফুটের বেশি থাকলেও সরবরাহ করা যাচ্ছে প্রায় ৩০০ কোটি মিলিয়ন ঘনফুট। পেট্রোবাংলার গত জুলাই মাসের এম আই এস রিপোর্টে বলা হয়ছে, ২০২০ সালে গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছিলো ২১৭ কোটি ১০ লাখ ঘনফুটের বেশি যা ২০২১ সালের জুনে ২০৮ কোটি ১০ লাখ ঘনফুটে কমে আসে। চাহিদা অনুযায়ী গ্যাসের সরবরাহ করা যাচ্ছে না। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়ার সঙ্গে বাড়ছে গ্যাসের চাহিদা, অপরদিকে কমছে উৎপাদন। যার ফলে অচিরেই গ্যাস সংকট তীব্র আকার ধারণ করতে যাচ্ছে। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছে, আগামী ২০২৫ সালেই উত্তোলনকৃত মজুদ ফুরিয়ে যেতে পারে। তাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী বর্তমানে গ্যাস মোট জ্বালানি খাতে ৬৫ শতাংশ ভূমিকা রাখছে। গত ১ জুন ২১ তারিখ পর্যন্ত উত্তোলন যোগ্য গ্যাসের মজুদ ছিলো ১১ দশমিক ৪৭ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ), আর বছরে উত্তোলন হচ্ছে ১ টিসিএফ। যদি তাই হয় তাহলে তো আগামী ১১ বছরেই উত্তোলন যোগ্য গ্যাসের মজুদ শেষ হয়ে যাবে। কমিশন আরো বলেছে, গত এক দশকে এক টিসিএফ গ্যাসও রিজার্ভে যুক্ত হয়নি। এমতাবস্থায় চাহিদা মেটাতে বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানি করে চাহিদা মেটাতে হচ্ছে। পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, আগামী ২০২৫ সালে গ্যাসের রিজার্ভ ৬ টিসিএফ এবং ২০৩০ সালে ৫ টিসিএফ’এ নেমে আসবে যা ব্যাপক ভাবে এলএনজি আমদানি নির্ভর করে তুলবে এবং জ্বালানি নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়বে। পেট্রোবাংলা সূত্রে আরো জানা যায়, বর্তমানে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৪ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট যার বিপরীতে দেশি-বিদেশি কোম্পানীগুলো সহ মোট ২ হাজার ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট, সেই সঙ্গে সাড়ে ৫ শত মিলিয়ন ঘনফুট আমদানিকৃত এলএনজি সহ দৈনিক মোট ৩ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট সরবরাহ করা হচ্ছে। যতোই দিন যাচ্ছে, গ্যাসের উৎপাদন ততোই ফুরিয়ে যাচ্ছে। জ্বালানি তেলের ওপর নির্ভরশীল বিদ্যুৎ খাত ঝুঁকিতে পড়ছে। বিদ্যুতের স্বাভাবিক উৎপাদন ধরে রাখতে হলে গ্যাসের উৎপাদন বাড়াতে হবে। লেখক: সাংবাদিক।