মুক্তিযুদ্ধ যেভাবে আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য অনুপ্রাণিত করেছিলো
ড. মীর মাহফুজুল হক : ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর পাকিস্তানি শাসকরা আরও বৈষম্যমূলক মনোভাব ও কর্মকাণ্ড নিয়ে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের বাঙালিদের ওপর আধিপত্য ও শোষণ শুরু করে। বাঙালিরা তাদের শোষণকে মেনে
নেয়নি ও তারা (বাঙালিরা) তাদের শোষণ, বৈষম্যমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে অবিরাম প্রতিবাদ করেছে। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান ও ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন পাকিস্তানি শাসকদের ষড়যন্ত্রের কারণে পাকিস্তানবিরোধী চেতনাকে বেগবান করতে ভূমিকা পালন করে। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও পাকিস্তানি শাসকরা বাঙালি ও বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর বিলম্বিত করার ষড়যন্ত্র করেছিলো যা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের দিকে উদ্বুদ্ধ করেছিলো। মুহূর্তেই বাঙালিদের পক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দজ উদ্যান) পাকিস্তানি শাসক ও সৈন্যদের বিরুদ্ধে নিরস্ত্র লড়াইয়ের প্রস্তুতির জন্য সমগ্র দেশবাসীকে আহ্বান জানান।
ফলে পাকিস্তানি শাসক ও আধিপত্যবাদীরা নিরস্ত্র লড়াই, সংগ্রামের বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর উত্থান ত্যাগ করে বাঙালিদের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়। এরই প্রেক্ষিতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর গণহত্যা শুরু করে ও ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকার অন্যান্য স্থানে হামলা চালায়। ওই রাতেই তারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ধরে নিয়ে যায়। গ্রেপ্তারের আগে বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ফলে ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবর্তমানে তার নেতৃত্বে গণমানুষ স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। স্বাধীনতাকামী বাঙালিরা ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে মুক্তিযুদ্ধে জয়লাভ করে ও মাত্র নয় মাস যুদ্ধের মাধ্যমে বিশ্ব মানচিত্রে একটি স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়। বাংলাদেশ বিশ্বে একটি নতুন জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে ও ২ লাখ নারীর পতনের লঙ্ঘনের মধ্যে বাঙালিরা পাকিস্তানি শাসকদের ২৪ বছরের বৈষম্যমূলক নিয়মের প্রতিশোধ নেয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি নিহতের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের জন্য জাতি চিরকাল ঋণী। স্বাধীনতা দিবস হলো মন্দের বিরুদ্ধে ভালো ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের অসামান্য অর্জনের প্রতীক।
রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্বের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় পাকিস্তানের কারাগার থেকে ফিরে এসে বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠনে অংশ নেওয়ার জন্য দেশবাসীকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। তিনি সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করতে সদ্য স্বাধীন দেশের জন্য সবুজ বিপ্লবের ওপরও জোর দেন। তদনুসারে, ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস ও বাংলাদেশের মানুষ প্রতি বছর ২৬ মার্চকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, জাতীয় দিবস হিসেবে পালন করে। একটি সুখী বাংলাদেশের জন্য দিবসটি উদযাপনের দাবি রাখে। তাই প্রধানমন্ত্রী আমাদেরকে উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে, গণতান্ত্রিক রাজনীতি সমুন্নত রাখতে, গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ সরকারকে পরাজিত করে সুশাসন প্রতিষ্ঠার অনুপ্রেরণা দেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে স্বাধীনতা অর্জন, শান্তিপূর্ণ ও সুখী জীবনযাপনের প্রত্যাশা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করায় সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের আশা-আকাঙ্খা পূরণ করতে সক্ষম হয়েছে।
আমরা এখন ভিশন ২০২১ অনুযায়ী একটি মধ্যম আয়ের দেশে আছি ও জাতিসংঘ কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে ২০২৬ সালে একটি উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হবে। আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) করতে চাই, যা একটি উন্নত-সমৃদ্ধ। মিশন ২০৪১ ও ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য ও আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশের মহান স্বার্থে, আমাদের স্বাধীনতার স্বার্থে বাংলাদেশকে একটি নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ বাড়িতে রূপান্তরিত করার লক্ষ্যে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে জাতির পিতার স্বপ্নের আলোকে সকল বৈষম্য ভুলে একটি উন্নত, সমৃদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে হবে। এখন গড় আয়ু, লিঙ্গ সমতা, সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা, নারী শিক্ষা, অধিকার, নারী ও শিশু মৃত্যুর হার, নারীর ক্ষমতায়ন, স্যানিটেশন, খাদ্যের প্রাপ্যতার মতো বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশ তার প্রতিবেশীদের ছাড়িয়ে গেছে।
দেশের সাধারণ মানুষ বিশেষ করে কৃষক-শ্রমিক-পেশাজীবীরা তাদের শ্রম, মেধা ও উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। সরকার শুধু নীতিগত সমর্থন দিয়ে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের জনগণ ইতোমধ্যে প্রমাণ করেছে যে তারা অনুকূল পরিবেশ পেলে যেকোনো অসম্ভবকে সম্ভবে রূপান্তর করতে পারে। অন্যদিকে আমাদের গর্বিত শহীদ বুদ্ধিজীবী, মুক্তিযুদ্ধে দেশের জন্য মূল্যবান জীবন বিসর্জন দেওয়া, দেশের মর্যাদা হারানো সকল শহীদ ও অপমানিত নারীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য একটি যোগ্য জাতি গড়ে তুলতে সর্বক্ষেত্রে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। সামগ্রিকভাবে, আমাদের আন্তরিক প্রচেষ্টা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মাধ্যমে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলায় পরিণত করে একটি সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে হবে। ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট অর্থনীতি, স্মার্ট সোসাইটি ও স্মার্ট সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার একটি রূপকল্প চালু করেছে।
‘স্মার্ট’ বলতে সমাজের বিভিন্ন দিককে উন্নত করার জন্য ইন্টারনেট অফ থিংস, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ডেটা অ্যানালিটিক্সের মতো উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার বোঝায়। এই দৃষ্টিভঙ্গি সমস্ত নাগরিকের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে পারে, প্রযুক্তিগত শক্তি ব্যবহার করে আরও টেকসই, দক্ষ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের জন্য নতুন অর্থনৈতিক সুযোগ, বিশ্বমানের অবকাঠামো তৈরি করতে পারে। এই প্রসঙ্গে, সরকার দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, পরিবহন, জ্বালানি, শাসন ও কৃষি খাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যা আরও বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে ও বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করবে। সর্বোপরি, আমাদের আন্তরিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় পরিণত হয়ে একটি সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে হবে। অপরদিকে, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর গৃহীত উদ্যোগ মোতাবেক এসডিজি-২০৩০, মিশন-২০৪১ ও ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ বাস্তবায়ন করতে হবে।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও অধ্যক্ষ, সরকারি হরগঙ্গা কলেজ, মুন্সীগঞ্জ। অনুবাদ : জান্নাতুল ফেরদৌস। সূত্র : ডেইলি অবজার্ভার