বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ঢাকা রোম ফ্লাইট : এবার হবে কি লাভজনক?
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
একসময় বলা হতো বিমান ন্যাশনাল ফ্ল্যাগ ক্যারিয়ার। জাতীয় পতাকাবাহী প্রতিষ্ঠান। আসলে এসবই ছিলো অতি কথা। কারণ বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স বাংলাদেশের পতাকা সরকারিভাবে বহন করে চলতো। কিন্তু এ বিমান কখনো মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। অনিয়ম, দুর্নীতি, সেবা ও মান অত্যন্ত নিচু বলে বিবেচিত। এমনকি বাংলাদেশের মানুষ যারা বিদেশে আসা-যাওয়া করে তারাও বিমানের সেবা ও মান সম্পর্কে সমালোচনা করে। বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স নিয়ে ছোট একটা গল্প ফেসবুকে পড়লাম যে, এক ভদ্রলোক বাচ্চার খাওয়ার সময় হলে একজন বিমানবালাকে ডেকে তার বাচ্চার ফিডারের দুধ গরম করে দিতে বলেন। বিমানবালা যখন ফিডারের দুধ আনলেন তখন ভদ্রলোক অবাক হয়ে দেখেন যে অর্ধদুধে ভর্তি ফিডারটি পরিপূর্ণ হয়ে আছে। তখন তিনি বিমানবালাকে এর কারণ জিজ্ঞেস করায় তিনি বলেন, তাদের বিমানে দুধ গরম করার কোনো ব্যবস্থা নেই তাই আধা ফিডার দুধে গরম দুধ ঢেলে গরম করার চেষ্টা করেছি। এমন অনেক ঘটনাই হয়তো আমরা অনলাইনে, ফেসবুকে নানান মানুষের কাছে শুনবো।
১৫ বছর পর চালু হলো ঢাকা-রোম (ইতালি) ফ্লাইট। পুনরায় চালু হওয়ার পর থেকেই সামাজিক মাধ্যমসহ নানান মাধ্যমে মানুষের সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে বিমান ব্যবস্থা, সেবা ও মান নিয়ে। চরম ডলার সংকটের যুগে ব্যবসায়ীদের মহলে কান পাতলে শুনতে পাই যে, এলসি খুলতে পারছে না, ডলারের অভাব, ডলার সংকট নিয়ে নানা রকমের ব্যবস্থাপনা করছে বাংলাদেশ বিমান, অর্থমন্ত্রণালয় এমনকি আমদানি কম করা হচ্ছে সঞ্চয় করার জন্য। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ বিমান সৌজন্য টিকেটে লোকভর্তি বিমান নিয়ে গেছে রোমে। এতে প্রচুর খরচ হয়েছে এবং ডলার সংকটের দিনে বাংলাদেশ বিমান বিশেষ ব্যবস্থা করেছে। ৩০ জনের বেশি সম্পাদক, সাংবাদিক এবং একটি বড় অংশ এভিয়েশন বিটের যাদের সম্পর্কে প্রচারণা আছে এরা বিভিন্ন এয়ারলাইন্সে বিনা পয়সায় পৃথিবীর নানা প্রান্তে যায় এবং রিপোর্টের চেয়ে ভ্রমণ করে বেশি। বিমানের অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে বিশেষ করে তারাই চুপ। কোনো কোনো সাংবাদিক তাদের পরিবার নিয়ে গেছে বলে এমন একটা প্রচারণা আছে। আমার নজরে এই সম্পাদক ও সাংবাদিকরা চরম দৃষ্টান্তমূলক হয়ে থাকলো। স্বার্থের দ্বন্দ্বে তারা নিজেরা এটা উপলব্ধি করতে পারছে কিনা জানি না। তবে ভবিষ্যতে বিমানের বিষয়ে মুখ খোলা তাঁদের জন্য কঠিন হয়ে উঠবে।
লোকসানের কারণে ঢাকা-রোম ফ্লাইট বন্ধ হয়েছিলো। ২০১৫ সালের ৬ এপ্রিল শেষ ফ্লাইট পরিচালনা করা হয় এ রুটে এবং রুটটিতে ফ্লাইট প্রতি লোকসান ছিলো ১ কোটি টাকা। ফ্লাইট প্রতি কেবিন ফ্যাক্টর ছিলো মাত্র ৪০ শতাংশ। কেবিন ফ্যাক্টর ৭৫ শতাংশের কম হলে তা লাভজনক হয় না। এ রুটের লভাংশ্য অর্ধেকও ছিলো না। ঢাকা-রোম ও রোম-ফ্রান্স রুট পাশাপাশি ঢাকা মিলান রুট চালু করেছিলো। সেই বিমান কিন্তু ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার করেও যাত্রী পায়নি। ঢাকা-ফ্রান্স রুটের ফ্লাইটে ৩০-৩৫ জনের বেশি যাত্রী মিলতো না। সর্বশেষ যাত্রী ছিলো মাত্র ২৯ জন। ২০০৯ সালে বাংলাদেশ রোম রুটে বিমান বন্ধ করেছিলো, এখন আবার চালু হলো। এতোবার লোকসানের মুখে বিমান বন্ধ করে আবার চালু করায় পুরোনো যুক্তিকে ধারণা করা হচ্ছে। ইতালিতে বসবাসকারী বাংলাদেশির সংখ্যা দেড় লাখ বা তারও বেশি এবং বাংলাদেশ থেকে আসা-যাওয়া সব মিলিয়ে তিন লাখের বেশি হবে। এর মাঝে অনেকেই একাধিকবার যাতায়াত করে। রোমে যাতায়াত করে তারা স্বদেশি পণ্য বলে যে বিমানে যাবেন এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। লাভ করার জন্য বিমানকে অনেক ধরনের কাজ করতে হয়। শুধু বাংলাদেশের যাত্রীকে টার্গেট করলে রোমের রুট কোনো দিনই লাভ করতে পারবে না। অতিরিক্ত লাগেজ কম ভাড়া দিয়ে হয়তো বাঙালিকে আকৃষ্ট করতে পারবে। তবে বিদেশি যাত্রীদের আকৃষ্ট করার জন্য অন টাইম ফ্লাইট ব্যবস্থা করা যা বাংলাদেশের ইতিহাসে নেই। উন্নত সেবা, নিরবিচ্ছিন্ন কানেক্টিভিটি থাকাটাই বিমানের মূল ব্যবসা কিন্তু আমাদের দেশে তা নেই।
অনেকেই বলছেন সপ্তাহে দুই থেকে তিনটি ফ্লাইট দিয়ে এই রুট লাভজনক করা যাবে না, বরং সাত দিনই ফ্লাইট থাকতে হবে। সেই সঙ্গে ঢাকা, কলকাতা, কাঠমণ্ডু, ইয়াংগুন, ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর পর্যন্ত কানেক্টিভিটি থাকা দরকার যেন শাহজালাল বিমান বন্দর থেকে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ইউরোপের যাত্রীরা যেতে পারে। যারা শাহজালাল বিমান বন্দরে যাতায়াত করে তারা জানে ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়া কী ভয়ঙ্কর এবং বিমানে যাত্রী সেবাও নিম্নমানের। বিমানে কর্মরত কর্মচারীদের মধ্যে একদমই কর্পোরেট মনোভাব ও মানসিতা নেই। ফলে এটি একটি নেটওয়ার্ক এয়ারলাইন্স হতে পারবে না। শুধু বাংলাদেশি যাত্রী দিয়ে লাভ করা যাবে না। রোম থেকে ঢাকা হয়ে যারা বিভিন্ন জায়গায় যেতে চাইবে তাদের জন্য বিকল্প অনেক পথ আছে। সরাসরি কাঠমাণ্ডু, ব্যাংকক, ভারত যাবেন এ নেটওয়ার্কিং রুটটা খুব জরুরি তা না হলে এ রুটে লাভ করা যাবে না। পরিচিতি : সিনিয়র সাংবাদিক। সূত্র : সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ফেসবুক পেইজের ভিডিও কনন্টেন্ট থেকে শ্রুতিলিখন করেছেন রুদ্রাক্ষী আকরাম