দুর্বল-সবল ব্যাংকের একীভূতকরণের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
ড. জাহিদ হোসেন
দুর্বল ব্যাংক ও সবল ব্যাংকগুলো কে বা কার সঙ্গে কীভাবে একীভূত হবে বা আদৌ হবে কিনা সে সিদ্ধান্ত বা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে ঠিকই, কিন্তু কার্যক্রমটি পরিচালনার যে পলিসি সেটা নিয়ে এখনো আলোচনা হচ্ছে। একীভূতকরণের পলিসি ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে তা পরিচালনা করা হবে। দুর্দশাগ্রস্ত ব্যাংকের দায়িত্ব সরকার নেবে, না সবল ব্যাংক নেবে কে নেবে এবং কতো দামে তা ট্রান্সফার করা হবে সে বিষয়গুলো পরিষ্কার হয়নি। তা না হওয়া পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে আমরা কোনো পদক্ষেপ নেবো না। কারণ এর ফলে সকল দায়ভার সবল ব্যাংককেই নিতে হবে এবং প্রতিষ্ঠানটি যদি যথেষ্ট সম্পদ না পায়, তাহলে ব্যাংকের ব্যালেন্স শিট আরও বেশি দুর্বল হয়ে যাবে।
দুর্বল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে উৎসাহিত করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক রেগুলেশনের ক্ষেত্রে কিছু ছাড় দেবে। যেমন, মূলধন ১০ শতাংশ হতে হবে। তবে ১২.৫ হলে ভালো। কিন্তু সেটা ছাড় দেওয়া হবে ব্যাংকের কাছে কোনো জবাবদিহিতা বা ব্যাখ্যা চাইবে না। এছাড়াও ডিপোজিটের একটা ঋণ সীমা আছে। ৮৭.৫ শতাংশের বেশি লোন দিতে পারবেন সেক্ষেত্রে বলা যেতে পারে যারা নিচ্ছে তাদের জন্য ৯০ থেকে ৯২ শতাংশ হোক। বাংলাদেশ ব্যাংকে ৪ শতাংশ টাকা ডিপোজিট রাখতে হয়, সেক্ষেত্রেও ছাড় দিতে পারে। এছাড়া প্রণোদনা দেওয়ার সুবিধা দিতে পারে, এর ফলে সবল ব্যাংকগুলো দুর্বল ব্যাংকগুলোর সঙ্গে একীভূত হতে আগ্রহী হতে পারে। তথ্য মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে কর্পোরেট ইনকাম ট্যাক্সের ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হতে পারে। এই বিষয়গুলোর সিদ্ধান্ত তথ্যমন্ত্রণালয়ের। সুতরাং সিদ্ধান্তগুলো পরিষ্কারভাবে ঘোষিত না হলে আর্থিক পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হবে না।
অর্থনৈতিক খাতের নিরাপত্তা ও ঝুঁকি প্রসঙ্গে যদি বলি, বাংলাদেশ ব্যাংক ও তথ্যমন্ত্রণালয় থেকে বলা হচ্ছে যে, ব্যাংকিং খাতে ডিপোজিটারদের ডিপোজিট যেন সুরক্ষিত থাকে সেদিকে নিশ্চয়তা দেওয়া হবে। এমনকি একীভূতকরণের প্রক্রিয়া যাইহোক না কেন, এর ফলে ডিপোজিটারদের অর্থ নিরাপদ ও সুরক্ষিত থাকবে। ডিপোজিটের অর্থ যেন হারিয়ে না যায়, সেটা ইনস্যুরেন্স কাভারেজের মাধ্যমে পরিচালনা করা হবে এবং যারা ইনস্যুরেন্স কাভারজের বাইরে তারাও নিরাপদ থাকবে। দুর্বল প্রতিষ্ঠানের মালিক ও শেয়ার হোল্ডারদের ঘাড়ে দোষ পরবে এবং সেটাই আসা উচিত। কারণ এ অনিয়ম ও দুর্বলতা ব্যাংকের পরিচালকরা থাকাকালীন দুর্বল হয়েছে, সেটা এ বিষয়গুলো রেগুলেশন মেকানিজমের কার্যক্রম প্রক্রিয়ার উপর যা এই মুহূর্তে পরিষ্কার না।
অর্থনৈতিক খাতকে সবল ও সুরক্ষিত রাখতে হলে সবল ব্যাংকের ঘাড়ে দুর্বল ব্যাংককে চাপানো যাবে না এবং ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে অবশ্যই পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ এতে সবল প্রতিষ্ঠান দুর্বল হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। যে সকল সবল ব্যাংক আগ্রহী হবে একীভূতকরণে কেবল তাদেরই অডিটের মাধ্যমে এই দায়িত্ব দেওয়া যাবে, অন্যথায় চাপিয়ে দেয়া হলে ঝুঁকি বাড়বে। রেগুলেশনের দিক থেকে বলা যায় অনেকেই বলেছে যে, সিআরআর কম হলে ক্যাপিটাল কম হলেও চলবে বলে একীভূতকরণের কথা বলছে। কিন্তু সেটা সার্বিক আর্থিক খাতকে সুরক্ষিত রাখার জন্য ঠিক আছে। এক্ষেত্রে কম্প্রোমাইজ করা ঠিক হবে না, তাহলে আবারও আর্থিক খাত দুর্বল হয়ে যাবে। ঋণ শোধ করার নীতিমালা নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কাজ করছে। একটা এসেস্ট ম্যানেজম্যান্ট কোম্পানি তৈরি করা হবে তারা ঋণ খেলাপি ও ঋণ আছে এমন কোম্পানিকে কিনবে। কিন্তু তারা কতো দামে কিনবে তা বলেনি। সম্পদের মূল্যে বুঝে কিনবেন অডিটের মাধ্যমে কিন্তু এখনো সেই অডিটটাই তৈরি হয়নি। যাচাই করতে হবে কতো টাকায় ঋণ উদ্ধার করা যাবে তারপর সেই অনুযায়ী কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে।
ন্যাশনাল ব্যাংকসহ ১০/১২টি ব্যাংক সমস্যায় ছিলো। ব্যাংকের সংখ্যা বেশি, এর মাঝেও নতুন ব্যাংক যোগ করা হয়েছে, এতে আর্থিক খাতের কোনো উন্নতি হলো না। তবে আমি মনে করি এর প্রধান কারণ হলো ঋণ খেলাপি করে পার পেয়ে যাওয়া সমস্যা সৃষ্টি করে। মামলা করার পর কোর্টে সেই মামলা বছরের পর বছর ঝুলে থাকে। রিট করলে তার সমাধান হয় না। অনেক রকম জটিলতার তৈরি হয়। সঠিক কোনো সমাধান না থাকার কারণে বড় বড় ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যাচ্ছে না, যার ফলে পার পেয়ে যাচ্ছে তারা। বাংলাদেশ ব্যাংক ইদানীং বলছে ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নতুন কোনো ট্রেড লাইসেন্স ইস্যু করা হবে না, ভ্রমণের উপর নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে এই ধরনের পদক্ষেপের কথা বলেছে। কিন্তু এগুলো বড় ধরনের কোনো শাস্তি নয় যা ৪-৫ হাজার কোটি টাকা ফেরত দিতে সাহায্য করবে।
ঋণ খেলাপিদের উদারতার সঙ্গে ছাড় দিয়ে, ঋণ পুর্নগঠনের সুযোগ দিয়েছে, ব্যাংকের ব্যালেন্স শীট থেকে রাইট অব করে দেওয়ার সুযোগ দিয়েছে। কারণ ঋণ পরিশোধ যেন সহজ হয়। ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি ও অনিচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিকে নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরি হবে এ বিষয়েও পরিষ্কার কোনো নির্দেশনা পাইনি। অনেকেই ভুয়া জামানত দিয়ে ঋণ নিয়ে থাকে। একই প্রতিষ্ঠান তিন চারবার ঋণ নিয়ে অন্য কোথাও সে অর্থ ব্যবহার করলে বা আর্থিক ক্ষমতা থাকা স্বত্ত্বেও ঋণ পরিশোধ না করা এ জাতীয় হলে ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসেবে ধরে নেওয়া হবে। এছাড়াও ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা আছে কী নেই এ বিষয়গুলো যাচাই করার জন্য সঠিক যে নির্দেশনা সেগুলো এখনো আমাদের কাছে আসেনি। তবে এসব জায়গায় ফাঁক-ফোকর আছে যেগুলো সমাধান না করলে আমরা আসল সমস্যার সমাধান করতে পারবো না। লেখক : বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ