আমাদের লক্ষ্য অর্জন, কৌতূহল ও জিজ্ঞাসার নিবৃত্তিতে প্রকল্প ও ব্যখ্যা
মোঃ আব্দুস সামাদ
আমাদের প্রতিদিনের বাস্তব জীবনে আমরা বহু সমস্যার সম্মুখীন হই। আমরা প্রতিনিয়ত অনেক ঘটনা ঘটতে দেখি আমাদের চেখের সামনে। কিন্তু সব ঘটনা নিয়ে আমরা আগ্রহী হই না। যেসব সমস্যা আমাদের বাস্তব জীবনের সাথে মাকড়সার জালের মত জড়িয়ে যায় সেগুলো আমরা কখনো এড়িয়ে যেতে পারিনা। যেসব সমস্যার সমাধানের জন্য আমরা কেউ কেউ সেগুলোকে সাথে নিয়েই দূর্বিষহ জীবন যাপন করি। কিছু ঘটনা আছে যা খুবই জটিল। কিছু ঘটনা আছে যাদের প্রকৃত কারণ সম্পর্কে আমরা অবগত নই। কিন্তু এভাবেই কি সকল সমস্যা নিয়ে আমরা চলতে পারবো? প্রত্যেকের জীবনে পরিকল্পনা আছে। পরিকল্পনা ও লক্ষ্য বিহীন কোন মানুষ চলতে পারেনা। সমাজে অনেক ঘটনা ঘটে কিন্তু সব ঘটনার প্রকৃত রহস্য শনাক্তকরণ করা সহজ কোন কাজ নয়। এই সমাজের মানুষের মনে এখনো নির্বিচার বিশ^াস, অশিক্ষা, মানসিক সংকট ও অজ্ঞতা বিরাজ করছে। সত্যকে মিথ্যা আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। যে বিষয়গুলো খুব সহজেই উপস্থাপন করা সম্ভব সেগুলোকে জটিল ও দুর্বোধ্য ভাষায় তুলে ধরা হচ্ছে। এর ফলে মানব মনে তৈরি হচ্ছে ভ্রান্ত ধারণা। এই সকল সংকট উত্তরণে বৈধ প্রকল্প ও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার জ্ঞান অনেকাংশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
প্রথমে আমি প্রকল্প নিয়ে আলোচনা করবো। প্রকল্পের ইংরেজি প্রতিশব্দ ঐুঢ়ড়ঃযবংরং। সাধারণত আমরা কোন বিষয়ের কারণ আবিষ্কার করতে গিয়ে যে আনুমানিক ধারণা গঠন করি সেটাই মূলত প্রকল্প। এমন অনেক ঘটনা রয়েছে যার সম্পর্কে আমাদের অজানা, আবার এমন ঘটনা রয়েছে যার ব্যাখ্যা করার প্রচেষ্টা করি। এইসময় আমরা সেই বিষয় সম্পর্কে সম্ভাবনা অথবা আনুমানিক ধারণার সমন্বয় করি। সেটাই মূলত প্রকল্প জীবনের বহু ক্ষেত্রে প্রকল্পে গঠন খুবই প্রয়োজন। আমরা যদি সঠিকভাবে প্রকল্প তৈরি করতে পারি তাহলে যেকোন জটিল বিষয়ের সমাধান অনেক সহজতর হয়। যেমন একজন বিজ্ঞানী তার আবিষ্কারের ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের জন্য প্রকল্প গ্রহণ করেন। আমরা যদি বিজ্ঞানী আউনস্টাইনের কথা বলি তবে তিনি তার আপেক্ষিক তত্ত্ব আবিষ্কারের জন্য পূর্বেই প্রকল্প গঠন করেছিলেন। যে প্রকল্প বিজ্ঞানীকে তার সঠিক আবিষ্কারে সহায়তা করেছিলো।
আচ্ছা এবার আমরা এমন একটা ঘটনার কথা বলবো যা আমাদের চোখের সামনে ঘটেনি। একটা বাড়িতে একবার চুরি করল? আমরা হুটহাট করেই যে কাউকে সন্দেহ করতে পারিনা। সেজন্য প্রথমে সম্ভব্য কারা চুরি করতে পারে তাদের তালিকা তৈরি করতে হবে। এরপর কীভাবে জিজ্ঞেস করতে হবে এবং কি কি প্রশ্ন করা হবে তার আগাম একটা তালিকা তৈরি করতে হবে। এরপর মূল কাজে অগ্রসর হতে হবে। মূলত মূল কাজে অগ্রসর হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত যে কার্যক্রম তাই হলো প্রকল্প। এই প্রকল্পই আসলে আমাদের সকল কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অনেক ঘটনার সব কারণ আমরা জানতে পারিনা। যখন আমরা সেসব ঘটনার কারণ আবিষ্কার করতে অগ্রসর হই তখনই কিন্তু আমাদের প্রকল্প গঠন করতে হয়। যখন একদল গোয়েন্দা কোন অপরাধের রহস্য উন্মোচন করতে চায় তাদের প্রথমেই বেশকিছু আনুমানিক ধারণা গঠন করে অনুসন্ধান কাজে অগ্রসর হতে হয়।
পৃষ্ঠা-১
এবার একজন শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে প্রকল্প কতটুকু ভূমিকা রাখে তা জানার চেষ্টা করি। একজন শিক্ষার্থী মনস্থির করল সে এবার পরীক্ষায় প্রথম হবে। কিন্তু কীভাবে হবে তার জন্য কিন্তু পূর্বপরিকল্পনা প্রয়োজন। অর্থাৎ প্রথমে সে কী করবে? কতটুকু সময় সে কোন কোন বিষয় অধ্যয়ন করবে, কখন সে শিক্ষকের সহায়তা নিবে, পিতা মাতার কাছে থেকে সে কতটুকু সাহায্য নিবে ইত্যাদি বিষয়ে তাকে আগে থেকেই পরিকল্পনা করতে হবে। এই প্রাক কল্পনাকে যদি সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারা যায় তাহলে সে তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে। প্রতিটি মানুষের জীবনের লক্ষ্য রয়েছে। এইসব লক্ষ্য পূরণের জন্য অবশ্যই তাকে পূর্ব হতেই পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। সে বিষয়ে অবশ্যই ধারণা গঠন করে এগিয়ে যেতে হবে। তাহলেই লক্ষ্য পূরণের জন্য আমরা সঠিক পথে অগ্রসর হবো। এবার আমরা একটা রাষ্ট্রের কথা চিন্তা করি। একটা রাষ্ট্রে পরিচালনার জন্য প্রতি বছর আয় ও ব্যয়ের সম্ভাব্য পরিকল্পনা প্রয়োজন। সে জন্য কিন্তু একটা বাজেট প্রনয়ণ কমিটি গঠন করে সম্ভাব্য আয় ও ব্যয়ের পরিকল্পনা করা হয়। মূলত প্রকল্পের মাধ্যমে এই পরিকল্পনা গঠন করা হয়। নতুন কারিকুলাম চালু করার পূর্বে অনেক পরিকল্পনা করা হয়েছিল, কীভাবে বই লেখা হবে, কীভাবে কোন বিষয় অন্তর্ভুক্ত হবে ইত্যাদি বহু বিষয়ে প্রকল্প গঠন করেই পরবর্তীতে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে নতুন কারিকুলাম চালু করা হলো। এই প্রকল্প গঠন শুধু এখন থেকে নয় এটা হাজার হাজার বছরের পরোনো একটা তত্ত্ব। এবার আমরা আমেরিকার কথা যদি বলি তাহলে জানতে পারি যে আগামী পঞ্চাশ বছর পর তারা কী করবে তার আগাম পরিকল্পনা এখনই করে রেখেছে তারা। সময় ও পরিস্থিতি বিবেচনা করে তারা প্রকল্পের অপরিবর্তন অথবা আংশিক পরিবর্তন করে তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছে।
প্রকল্প সম্পর্কে আমাদের অনেকের ধারণা নেই কিন্তু এটা ব্যবহার করেনা এমন মানুষ খুবই কম। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিজ্ঞানী, ইতিহাসবিদ, গোয়েন্দা সংস্থা, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, চিকিৎসা বিজ্ঞান ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রকল্পের গুরুত্ব অপরিসীম। কোনভাবেই প্রকল্পকে অস্বীকার করা যায়না। তবে মনে রাখতে হবে, একমাত্র বৈধ প্রকল্প আমাদের সঠিক পথে ধাবিত করবে। যেহেতু আমরা সকলেই এই প্রকল্পের ব্যবহার করি সেহেতু প্রকল্প সম্পর্কে আমাদের পঠনপাঠন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
এবার আলোচনা করবো ব্যাখ্যা সম্পর্কে। ব্যাখ্যার ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো ঊীঢ়ষধহধঃরড়হ। ব্যাখ্যা নিয়ে আলোচনা করা প্রকৃত কারণ আমি আমার আলোচনায় তুলে ধরবো। এই জগতে অনেক ঘটনা রয়েছে যা আমাদের কাছে রহস্যময়, অস্পষ্ট ও জটিল মনে হয়। সেই জন্য সেগুলো আমরা এড়িয়ে চলি। কিন্তু ব্যাখ্যার মাধ্যমে আমাদের কাছে রহস্যময়, অস্পষ্ট ও জটিল বিষয়গুলো খুবই স্পষ্ট ও সহজ হয়ে যায়। যখনই কোন ঘটনা বা বিষয় আমাদের মনে প্রশ্ন তৈরি করে তখনই কিন্তু সেই বিষয়ের ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয়। ব্যাখ্যা আমাদের কাছে ঘটনাগুলো সহজবোধ্যভাবে তুলে ধরে। যেমন বাংলাদেশ সংবিধানে আমাদের রাষ্ট্র পরিচালনা বিষয়গুলো লিপিবদ্ধ আছে। সেখানে যদি ব্যাখ্যা প্রদান করা না হতো তাহলে একেকজন একেকভাবে ব্যাখ্যা করতো। এর ফলস্বরূপ বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হতো। আমরা যেকোনো পাঠ্যবইয়ের বিষয়গুলো লক্ষ্য করলে দেখতে পাবো সেখনে বিভিন্ন বিষয়ের শিরোনামের পরেই কিন্তু সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা প্রদান করা আছে। অর্থাৎ কোন বিষয়ের সঠিক ব্যাখ্যা না দিতে পারলে আমরা ভুল পথে পরিচালিত হবো । ব্যাখ্যার দুইটা দিক আছে। একটিকে বলা যায় যৌক্তিক বা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা অন্যটিকে বলা যায় লৌকিক ব্যাখ্যা। লৌকিক ব্যাখ্যা মূলত সাধারণ মানুষের সাধারণ ব্যাখ্যা।
পৃষ্ঠা-২
কোন ঘটনার মনগড়া কিংবা অতি প্রাকৃতিক শক্তিতে বিশ^াস করে খেয়াল খুশি মত ব্যাখ্যা করা হলো লৌকিক ব্যাখ্যা। লৌকিক ব্যাখ্যার অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোন বাস্তব ভিত্তি নেই। যেমন চন্দ্র গ্রহণ, সূর্য গ্রহণ ভূমিকম্প সম্পর্কে সাধারণ মানুষ যে মন গড়া ব্যাখ্যা প্রদান করে তাতে ঘটনার প্রকৃত কারণ আমাদের কাছে অধরাই রয়ে যায়। সেই জন্য কোন ঘটনার প্রকৃত কারণ ব্যাখ্যা করতে হলে আমাদের সেই ঘটনার সঠিক ব্যাখ্যা প্রয়োজন। কিন্তু লৌকিক ব্যখ্যার মাধ্যমে সেটা কখনোই সম্ভব নয়। আমরা যদি কোন বিষয় সম্পর্কে সঠিক ধারণা পেতে চাই, কোন ঘটনার সঠিক কারণ জানতে চাই, তাহলে অবশ্যই বৈজ্ঞানিক বা যৌক্তিক ব্যাখ্যার জ্ঞান থাকা খুবই প্রয়োজন। কোনো ঘটনার ব্যাখ্যা প্রদানের ক্ষেত্রে যখন প্রকৃিতর নিয়মানুবর্তিতা নীতি ও কার্যকারণ নীতি অনুসরণ করে ব্যাখ্যা প্রদান করা হয় তখন তাকে আমরা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বা যৌক্তিক ব্যাখ্যা বলতে পারি। কোন মন গড়া ব্যাখ্যার পরিবর্তে যখন সঠিক নীতিমালা অনুসরণ করে কোন বিষয়ের ব্যাখ্যা প্রদান করা হয় তখন তাকে যৌক্তিক বা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বলা যায়। এমন একটা ঘটনা যা আমাদের কাছে খুবই অস্পষ্ট ও জটিল সেই বিষয়কে সহজ সরল ও প্রাঞ্জল ভাষায় প্রকাশ করলে তা আমাদের কাছে বোধগম্য হয়। এতে করে আমাদের জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধি পায় এবং অস্পষ্টতা ও দুর্বোধ্যতা দূরীভূত হয়। যখন কোন ব্যাক্তি তার নিজের মত মনগড়া ব্যাখ্যা করে তখন তা সবার কাছে গ্রহনযোগ্য নাও হতে পারে কিন্তু যৌক্তিকভাবে ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে কোন ঘটনার ব্যাখ্যা প্রদান করলে তা সকলের কাছে গ্রহনযোগ্য মনে হবে। এখন একটা উদাহারণ নেয়া যাক। যেমন: চন্দ্রগ্রহণ সম্পর্কে নানা মিথ প্রচলিত আছে। কেউ কেউ মনে করে চন্দ্রকে যখন রাহু গ্রাস করে তখন চন্দ্রের খুব কষ্ট হয় তখন চন্দ্রগ্রহণ হয়। কিন্তু এই ঘটনার প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান করে যখন ব্যাখ্যা দাঁড় করানো হয় যে পৃথিবী যখন সূর্য ও চাঁদের মাঝখানে একই সরলরেখায় অবস্থান করে তখন চন্দ্রগহণ হয়। আমরা আরেকটা উদাহারণ নিতে পারি যেমন: ভূমিকম্প সম্পর্কে নানান মিথ্যা চালু ছিলো এক সময় কিন্তু এখন সঠিক ব্যখ্যা প্রদানের কারণে সেই মিথ্যাগুলো বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ব্যাখ্যার মাধ্যমে আমরা কোন ঘটনার কার্যকারণ সম্পর্ক ও প্রকৃত কারণ জানতে পারি। যৌক্তিক ব্যাখ্যার কারণেই অনেক প্রচলিত কুসংস্কার, অন্ধবিশ^াস, হীনমন্যতা দূর হয়েছে। যৌক্তিক ব্যাখ্যার মাধ্যমে আমরা কোন ঘটনার বিশ্লেষণ, শৃঙ্খলাযোজন ও অন্তর্ভুক্তি করতে পারি। সুতরাং আমরা আমাদের বাস্তব জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই কিন্তু ব্যাখ্যা ও প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা লক্ষ্য করতে পারছি। দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই যদি আমরা প্রকল্প ও ব্যাখ্যার সঠিক প্রয়োগ করতে পারি তাহলে আমরা আমাদের অধিকাংশ সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে সফল হবো।
লেখক : বি.এ(সম্মান), এম.এ, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় প্রভাষক, বান্দুরা হলি ক্রস স্কুল অ্যান্ড কলেজ