৫৩-৫৮ বছর বয়স, যেকোনো সময় হৃদরোগে মৃত্যুর শঙ্কা থাকে, যদি না সতর্ক থাকেন
কাজী এম. মুর্শেদ
জন্মালে মরতে হবে। আমরা যা কিছু করি, বেঁচে থাকতেই করি। যেহেতু আমরা জানি না ঠিক কখন মারা যাবো, আমাদের ভালো কাজের শেষ নেই, খারাপ কাজেরও নেই। যতো সম্পদ আহরণ, কেউ সঙ্গে নিয়ে যায় না। তারপরও আরো কতো দরকার তার সীমা নিজেরাই জানি না। আবার টপিকে আসি মৃত্যু। আপনারা কেউ কি প্রায় মৃত অবস্থা থেকে ফিরে আসছেন? মনে করেন আমার বয়স নয়, পানিতে ডুবে গেছিলাম, সাত/আট ঘণ্টা পর জ্ঞান ফেরে। নাকমুখ দিয়ে পানি যখন নিঃশ্বাসের সাথে যাচ্ছিলো, কষ্টটা তেমন বেশি না। মৃত্যুকে খুব ভয় পাবার কিছু নেই। আপনারা এস্ট্রাল প্রজেকশন সম্মন্ধে ধারণা রাখেন? নিজের শরীর থেকে বের হবার একটা ধারণা এটা। আমি নিজেও কিছু জানি, ফেরত আসাটাই দরকারি। অনেকে হ্যাল্যুসিনেশন মনে করেন, আমার মনে হয় না। সম্ভবত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র স্বেচ্ছামৃত্যুবরণ করে, সেও একই অবস্থায় গিয়েছিলো, পরে ফেসবুকে পোস্ট দেয় ও মৃত্যু বেছে নেয়।
মৃত্যু তেমন কষ্টের ব্যাপার নয়। আমরা কোনো না কোনো সময় দেখে এসেছি, বিশেষ করে প্রিয়জনের বা অপরিচিত মানুষের। একটা দুর্ঘটনায় মৃত্যু খুবই সহজ ব্যাপার। ঘুমের মধ্যে মৃত্যু আরো সহজ। তবে কষ্টের মৃত্যুও আছে, বছরের পর বছর বিছানায় পরে থাকা বা এক্সিড্ন্টে বেচে থেকে পঙ্গুত্ব বরণ করা। আমি গুম হয়ে বন্দিত্ব বরণ নিয়ে অত্যাচারে মৃত্যুতে মৃত্যু হিসাবে ধরি না, এটা হত্যাকাণ্ড। না হলে মৃত্যু খুবই সহজ একটা প্রক্রিয়া, যেকোনো সময় আসতে পারে। এতোক্ষণ খুব সহজভাবে মৃত্যু নিয়ে বললেও আমি সব ধরনের মৃত্যু নিয়ে বলার যোগ্য নই। তবে যেহেতু নীতিগতভাবে দুই ধরনের মৃত্যু নিয়ে আপত্তি আছে, সেটাও বলবো।
প্রথমত স্বেচ্ছামৃত্যু, যা সাদি মহম্মদ বেছে নেন। ধর্মসূত্রে হলেও এইটা মানি জীবন যিনি দিয়েছেন, শুধু তিনিই নিতে পারেন। এখানে নিজে সিদ্ধান্ত নেওয়ায় কোনো সমর্থন নেই। দ্বিতীয় হলো বিচারবিভাগীয় ব্যবহারে যে মৃত্যুদণ্ড হয়, একজন মানুষ যতো বড় অন্যায় করুক, বিচার করে ফাঁসিতে মৃত্যু দেওয়া আমার লিস্টে হত্যাকাণ্ড। সব বিচারে শাস্তি কারাদণ্ড হওয়া উচিত। একজন বিচারক কিছু সাক্ষীর বক্তব্য শুনে ফাঁসিতে ঝোলানো এটা কখনো সমর্থন করতে পারি না। এই বিচারকদেরও বিচার হবে, যেকোনো সময়ে বা অবস্থায়। আবারো বলি, মৃত্যু তেমন কষ্টের নয়, যিনি মারা যান তাদের চেহারা দেখবেন, কোনো বিদঘুটে হয় না, আমার দেখা সবই মনে হয়েছে স্বাভাবিকভাবে নিয়েছে। একটা অভিজ্ঞতা বলি। কয়েক বছর আগে হাসপাতালে ছিলাম। মোট দুইদিন। প্রথম দিনের ২৪ ঘণ্টায় আমার পাশের বেডে বা সামনের উপর ৬ জন মারা গেলেন। হয়তো বেশি, আমি যতোক্ষণ জেগে ছিলাম তার কথা বললাম। খুব কষ্ট হতে দেখিনি। আবার পরের যেদিন ছিলাম দিন দশেক পর, সামনেই জনা ছয়েক মারা গেলেন। ডাক্তার নার্স সবাই চেষ্টা করেছেন, বাঁচাতে পারেননি। সামনের উপর অথবা পাশের বেডে মারা যাচ্ছেন, দেখছি, কখনো মনে হয় নেই মৃত্যু কোন কষ্টের ব্যাপার। বরং বাঁচানোর যে চেষ্টা আমাদের ডাক্তার, নার্সরা করেন, সেটা দেখলে মনে হয় বাঁচাতে না পারলে তাদের বেশি কষ্ট হয়।
এবার মূল কথায় আসি, এতো কিছু নিয়ে বলার পর অবশেষে মূল কথা। কাজের সূত্রে মানুষের জীবন মরণের কিছু ব্যাপার আমার কাজের অংশ। কাগজপত্র সই করতে হয়, কিছু লেখা পড়তে হয়। আমার একটা ব্যাপার নিয়ে কথা আছে, আমাদের গড় আয়ু আসলে কতো বছর? ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে ১১ কোটি ভোটার মানে ৬ কোটি মানুষ ১৮ বছরের নীচে। বাকি যারা আছেন তাদের সহ আপনার কি মনে হয় গড় আয়ু কি ৭২ বছর হওয়া সম্ভব? আমার মনে হয় না। কারণ বলছি। আমার যেসব কাগজ পড়তে ও সই করতে হয়, তাতে ১৮/২০ বছরে হৃদরোগে মৃত্যু দেখতে হয়, ৩০ বছরেরও দেখি। তবে যদি বলেন সবচেয়ে রিস্কি কোন বয়সটা, আমার দেখা মতে ৫৩ থেকে ৫৮। এই বয়সের ব্রাকেটটা যারা পার করেন তারা হয়তো আরো বয়স পর্যন্ত বাঁচেন, কেন যেন এই ৫৩ থেকে ৫৮ বছরে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যান, অন্তত আমার কাছে যেসব কাগজ আসে সই করাতে। সবগুলোর কারণ একই, হৃদরোগে মৃত্যু। কারো হাসপাতাল পর্যন্ত পৌঁছানো হয়, কারো পৌঁছানোর পর পাওয়া যায় মারা গেছেন। সুরতহাল রিপোর্ট দেখি, অন্য কোনো সমস্যা ছিলো না। ময়নাতদন্তের রিপোর্টেও অন্য কোনো সমস্যা নেই। অপমৃত্যুর সংখ্যা খুবই কম। কিন্তু গত কিছুদিন ধরে পুরানো কিছু ফাইল বের করে হিসাব করতে বসেছিলাম, পরিসংখ্যানের সেই মিন, মিডিয়ন, মোডের হিসাব। আমার কাছে যা অবাক লাগলো তাহলো স্বাভাবিক মৃত্যুর বয়স সব এই একটা রেন্জের মধ্যে, ৫৩ থেকে ৫৮। এই বয়সটা পার হলে ৬৫ পর্যন্ত সবই বেশ ভালো থাকে। কিন্তু সবচেয়ে কষ্টের বা কমপ্লিকেটেড বয়স হলো ৬৫ থেকে ৭০। এই বয়স রেঞ্জটায় সকল বড় ও কষ্টকর অসুখগুলোতে মানুষ ভোগে। দ্বিতীয় রেঞ্জ হলো ৭০ থেকে ৭৫। এই বয়সটায় অসম্ভব কষ্টের সময়, প্রতিটা রোগ জটিল, বিছানায় পরে যায়, সাহায্যকারী ছাড়া নড়াচড়ার অবস্থা থাকে না।
আমি যা বলছি সবই আমার হাতে আসা ডেটার উপর ভিত্তি করে। এর বাইরে আরো ডেটা হয়তো আছে, যা আমার হাতে নেই। আমার কনক্লুশন হলো, ৫৩-৫৮ বছর এই সময়টায় আপনার যেকোনো সময় হৃদরোগে কষ্টহীন মৃত্যুর সম্ভাবনা আছে যদি না সতর্ক থাকেন। দ্বিতীয়ত ৬৫-৭০ আপনার কোনো বড় ভোগান্তির অসুখ হতে পারে, মৃত্যুহার কম হলেও ডাক্তার হাসপাতাল দৌড়াদৌড়ি চলবে, কিন্তু ভোগান্তির শুরু। আর ৭০-৭৫ হলো সবচেয়ে ভোগান্তির বয়স, হাসপাতাল পর্যন্ত যাবারও সময় হয় না। একটা পুরনো কথা মনে করাই। জাপানে একটা সময় ছিলো মানুষ খুবই কায়িক পরিশ্রম করলেও বয়স তিন কুড়ি বা ষাট হয়ে গেলে তাদের মাউন্ট ফুজির অন্যপারে পাঠিয়ে দেওয়া হতো। ধরে নেয়া হতো এই বয়সের পর তারা কায়িক কাজ করতে পারবে না, বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াতে হবে, সেজন্য মাউন্ট ফুজির অন্যপারে বয়সী লোকদের আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেওয়া হতো যেখানে তিন কুড়ির উপরের মানুষের একসঙ্গে থাকতো। তারা ওপারে কী করতো, কী খেতো, কেউ জানে না, কিন্তু মাউন্ট ফুজি পার হয়ে যেতে হবে। একটা সময় পরে পাওয়া গেলো, মাউন্ট ফুজির ওই পারে কেউ নেই বা কিছু নেই। তিন কুড়ি হলে তারা যেহেতু বোঝা হয়ে যায়, সেজন্য শীতকালে পাঠিয়ে দেওয়া হতো, পাহাড়ের উপরেই ঠাণ্ডায় মারা যেতো। লাশ সেখানে পঁচে হাড় হয়ে থাকতো। তিন কুড়ির পরে মানুষের কথা শুনবেন, খুব বেশি কাজের জিনিস নেই। শুনবেন ছোটবেলার কথা, নিজের বীরত্বের কথা, অনেক অসত্য কথা, নিজেকে হিরো বানাতে অন্যকে ছোট করার কথা। তবে এর উল্টোটাও পাবেন।
যারা লেখাপড়া ও রিসার্চে জড়িত, নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তদের গড় বয়স ৬৩ বছর। কখনো ৬১ তেও নামে, কিন্তু সবসময় তিন কুড়ির উপর। মৃত্যু নিয়ে ভয়ের কিছু নেই, এটা স্বাভাবিক ব্যাপার। গত কয়দিন দুইজন দেখলাম এই বয়সে স্ট্রোক করেছে যাঁদের খাবার অত্যন্ত নিয়মিত এবং বাছাই করা, নিয়মিত ব্যয়াম বা হাঁটা চলা করে, কোনো টেনশনেও ভোগে না, তারপরও স্ট্রোক করেছে। আমি আমার এনালাইসিস দিলাম, আপনাদের অন্য কোনো ডেটা থাকলে বলতে পারেন। তবে বিছানায় পরে মাল্টিপল অর্গান ফেইলিওরের শিকার সবাই হয় না, অনেকেই শারীরিকভাবে সুস্থ থাকলেও কথা বার্তায় অসংলগ্ন হয়ে পরে। এইটা সম্ভবত মেনে নেওয়াটা উচিত, এটা মানুষের সমস্যা নয়, একটা বয়সের পর মাথার নিউরণগুলো ক্ষয়ে আসে। এখানে ধর্ম টানলাম না, পুরা বিজ্ঞানের কথা বললাম।
লেখক: অর্থনৈতিক বিশ্লেষক