বায়ুদূষণ থেকে বাঁচার উপায় কি?
মিজানুর রহমান
ঢাকার বায়ু দিন দিন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ভোরের স্নিগ্ধতায় নির্মল বায়ু যেন হারিয়ে যাচ্ছে। অপরিকল্পিত নগরায়ন, ঢাকামুখী মানুষের স্রোত কিছুতেই ঠেকানো যাচ্ছে না। ঢাকা নগরীর আবহাওয়া দূষিত হলে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য নিরাপদ নগরী রেখে যাওয়াটা দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। ইদানীং বায়ুদূষণের আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের কাছে আমাদের এ সমস্যাটি দৃশ্যমান হচ্ছে। গত ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকে বায়ুদূষণ খারাপের দিকেই যাচ্ছে। এখন প্রতিনিয়ত বায়ুদূষণে বিশ্বের শীর্ষে থাকা ঢাকা। গত ২২ মার্চ বায়ুদূষণে ঢাকার অবস্থান ছিল শীর্ষে। ঐ দিন ১৯৩ স্কোর নিয়ে বিশ্বের ১২০ দেশের মধ্যে ঢাকার অবস্থান প্রথম স্থান ছিল। ২০২৩ সালে বিশ্বে বায়ুদূষণ পরিস্থিতি নিয়ে সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন দিয়েছে আই-কিউ এয়ার। এতে উঠে এসেছে বায়ুদূষণে গত বছর শীর্ষে ছিল বাংলাদেশ। রাজধানী শহর হিসেবে ঢাকার স্থান ছিল বিশ্বে দ্বিতীয়।
সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক আই-কিউ এয়ার এর ওয়েবসাইট থেকে এ তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে। ওদের মানদণ্ড অনুযায়ী স্কোর ১৫১ থেকে ২০০থাকলে তা অস্বাস্থ্যকর বায়ু।
গত সপ্তাহ থেকে রাতের বেলায় ঢাকায় কয়েক দফা বৃষ্টি ও হয়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী গত ২৪ ঘন্টায় ঢাকায় বৃষ্টি পাতের পরিমাণ ছিল ১৬ মিলিমিটার। বৃষ্টি হলে বায়ুদূষণের মাত্রা কমতে থাকে। ৯০ স্কোরে চলে আসে। আই-কিউএয়ার তথ্য মতে স্কোর ৫১ থেকে ১০০ হলে গ্রহণযোগ্য বায়ু হিসেবে গন্য করা হয়। আই-কিউএয়ার’র তথ্য অনুযায়ী ঢাকার বাতাসে অতিক্ষুদ্র বস্তুকনা (পিএম ২.৫) দূষণের প্রধান উৎস। গত কয়েকদিনে ঢাকার বাতাসে যতটা এ বস্তুকণা ছিল তা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মানদণ্ডের চেয়ে ১৮ থেকে ১৯ গুনের বেশি।
অমনটি হওয়ার বহুবিধ কারণ ও আছে। দিন দিন জনবসতি বাড়ছে। দেড় কোটির বেশি মানুষের আবাসস্থল ঢাকা। পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতি পূর্ণ শহরগুলোর মধ্যে ঢাকার অবস্থান ও প্রথম দিকেই। পরিবেশবিদরা বলেছেন যেখানে অন্য দেশগুলো তাদের বড় শহরগুলোর বায়ুদূষণ রোধে পদক্ষেপ নিয়ে চলছে সেখানে ঢাকা সম্পূর্ন ব্যর্থ হবে কেন? বায়ুদূষণের শহরগুলোর তালিকায় ঘুরেফিরে প্রায়ই প্রথম স্থান দখল করছে রাজধানী ঢাকা। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলেছেন চার কারণে এ পরিস্থিতির মুখামুখি হচ্ছেন রাজধানীবাসী।
প্রথমত পুরাতন গাড়ীর আধিক্য, লক্কড় ঝক্কর বাস রাজধানীর সড়কে হরহামেশাই দেখা মিলে এগুলো নির্গত বিষাক্ত ধোঁয়া পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছে। ভালো খবর হচ্ছে গত রোববার পরিবেশমন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী জানিয়েছেন, রাজধানী ঢাকার বায়ুদূষণ রোধে ২০ বছরের পুরনো বাসের তালিকা তৈরির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ৮ এপ্রিলের মধ্যে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন র্কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) তালিকা তৈরি করে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে পাঠাবে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ ৮ এপ্রিলের মধ্যে ঢাকা শহরে চলাচলকারী ওই বয়সী বাসের তালিকা পাঠাবে। পরিবহন মালিক সমিতি ২০ এপ্রিলের মধ্যে ২০ বছরের বেশি বয়সী বাস প্রত্যাহারের পরিকল্পনা দেবে। এটা বাস্তবায়ন হলে ঢাকা শহরের বায়ুর মান কিছুটা ভালো হতে পারে।
দ্বিতীয়ত অপরিকল্পিত ভাবে শহরের যেখানে সেখানে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও উন্নয়ন কাজ শুরু হলে যেন সহসা শেষ হবার নয় যার ফলে পরিবেশ কর্দমাক্ত ধুলোবালিতে একাকার হয়ে যাচ্ছে। তৃতীয়ত শহরের আশেপাশে ইটভাটা ও শিল্প কারখানার দূষণত আছেই। চতুর্থত শহরের ভিতরে যে আবর্জনা জমে তা পোড়ানো ধোঁয়া।দূষণের সবচেয়ে বড় উৎস ঢাকার বর্জ্য ও কম কিসের। আর বর্জ্য ব্যবস্থাপনাই আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা। ভয়াবহ খবর হলো বায়ু দূষণের কারণে মানুষ দিন দিন অসুস্থ হচ্ছে। হাঁপানি, ব্রংকাইটিস, এমন কি ফুসফুস ক্যান্সারসহ নানারকম মরনব্যধিতে আক্রান্ত রোগির সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। এছাড়া নিঃশ্বাসের সংগে ক্ষতিকর ধাতব পদার্থ শরীরে প্রবেশ করায় স্নায়ুজনিত অসুখে মস্তিষ্কের রোগ এবং হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ও বাড়ছে আশংকাজনকভাবে। বেশি উদ্বিগ্নের কারণ হলো শিশুরাই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এরা আক্রান্ত হচ্ছে রোগব্যাধিতে। এটা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলছে। যা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আতংকের খবর। অভিভাবক হিসেবে ও উদ্বেগের খবরটি অশনিসংকেত হিসেবে মনে করি।
সরকারকে এখনই ভাবতে হবে জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভর পরিবহন কমিয়ে পরিবেশ বান্ধব বৈদ্যুতিক যানকে উৎসাহিত করতে হবে। সরকার তা শুরু করেছে। আগামী ৫ বছরের মধ্যে পরিবর্তন আসবে। তাছাড়া নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিশ্চিত করতে হবে। ব্যক্তিগতভাবে বসতবাড়ি ও কর্মস্থলের বর্জ্য নির্ধারিত স্থানে এবং সঠিকভাবে নিষ্কাশন করতে হবে।
ঢাকার আশপাশের এলাকাগুলোতে রয়েছে এক হাজারের বেশি দূষণকারী ইটভাটা। এতে ঢাকা ও এর আশপাশের পরিবেশ মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে। ঢাকার বায়ুদূষণের জন্য ইটভাটা প্রায় ৫৮ শতাংশ দায়ী। ইটভাটার ধোঁয়ায় গত ১৫ বছরে ঢাকার বাতাসে দূষণ মাত্রা বেড়েছে ৯০ শতাংশ। রাজধানী বায়ুদূষণ বন্ধে দুই দফায় বিশ্বব্যাংক প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। মাঝে মাঝে রাস্তায় গাড়ি দিয়ে পানি ছিটানো ছাড়া কোন কাজ দেখা যাচ্ছে না। এ জন্য রাজধানী বায়ুদূষণ বন্ধ করা যায়নি।
আশার বানী হলো বর্তমানে বন ও পরিবেশ মন্ত্রী দায়িত্ব নেওয়ার পর ১০০ দিনের কর্মসূচী গ্রহণ করেছেন। কর্মসূচীর আওতাধীন পরিকল্পনায় আছে, বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে ঢাকার চারপাশের সব ইট ভাটা বন্ধের উদ্যেগ নেয়া হচ্ছে। আগামী তিন মাসের মধ্যে কার্যকর হবে। এতে প্রায় অবৈধ ৫০০ ইটভাটা গুড়িয়ে দেয়া হবে। এছাড়া খোলা ট্রাকে করে নির্মাণ সামগ্রী (বালু, সিমেন্ট ও অন্যান্য) বহনে ও জরিমানা বাড়ছে। মন্ত্রী মহোদয় আরেকটি বিষয় কর্মসূচীতে উল্লেখ করেছেন বায়ুদূষণ যখন খারাপ পর্যায় চলে যায় তখন একটি অ্যালাট ইস্যু করা হবে জনসাধারণকে জানানে হবে আজকে আমাদের বায়ুদূষণের যে মান আছে তা স্বাস্থ্যের জন্য প্রচন্ড ঝুঁকি। সুতারাং তাদের যদি জরুরি কাজ না থাকে তাহলে যেন ঘরের বাহিরে না যায় মার্ক্স ব্যবহার করতে হবে। কিন্ত উক্ত বিষয়টি কার্যকর হতে এখন ও দেখা যাচ্ছে না। গাড়ির ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব বিআরটিএর। যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পরিবেশ মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে। কিন্ত পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বের বাহিরে জনসাধারণের সচেতনবোধের প্রয়োজন আছে। ব্যক্তি উদ্যেগে প্রত্যেকে বাসার আশেপাশে ময়লা আবর্জনা না ফেলি। নিজস্বার্থে আমাদের চারপাশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখি তাহলেই ঢাকা পরিচ্ছন্ন নগরীতে রূপান্তরিত হবে। তাছাড়া মন্ত্রণালয়ের ১০০ দিনের কর্মসূচীর অপেক্ষায় থেকে মূল্যায়ন করা যাবে, বাস্তবে বায়ুদূষণ বন্ধে কতটুকু কার্যকর পদক্ষেপ হলো। কিন্তু বিষয়টি জনস্বার্থ বিবেচনা এনে সরকারের সহযোগিতা ছাড়া এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। ঢাকা নগরবাসীকে বায়ুদূষণ মুক্ত নগরী সৃষ্টির লক্ষ্যে সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। লেখক : কলামিস্ট ও সাবেক ব্যাংকার