রীতি-নীতির ভাঙার বিষয়ে নিজ দেশের মানুষকে বোঝাতে পারলেন কি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান?
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
প্রথমবারের মতো বৈশ্বিক সুন্দরী প্রতিযোগিতা মিস ইউনিভার্সে অংশগ্রহণ করছে সৌদি আরবের এক নারী। ২৭ বছর বয়সী এ তরুণীর নাম রুমি আল কাহতানি। নিজের অফিসিয়াল ইন্সটাগ্রামে নিজেই এ খবরটি জানান মডেল। মিস ইউনিভার্সের ৭৩ বছরে এবারই প্রথম সৌদি আরবের নাম যুক্ত হতে যাচ্ছে। এবারই প্রথম রক্ষণশীল সৌদি আরবের নারী হয়ে মিস ইউনিভার্সে নাম লিখিয়ে ইতিহাস গড়লেন রুমি আল কাহতানি।
নিজের ইন্সটাগ্রামে আরবি ভাষায় তিনি পোস্ট করেছেন, ২০২৪ সালের মিস ইউনিভার্সে সৌদি আরবের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পেয়ে আমি সম্মানিত বোধ করছি। এর মধ্য দিয়ে সম্মানজনক সুন্দরী প্রতিযোগিতায় নাম লেখাতে যাচ্ছে সৌদি আরব। এ বিষয়ে আমার ফেসবুকে একটি পোস্ট দেওয়ার পর নানা রকম মন্তব্য আসে। অনেকেই গোঁড়া মানসিকতার তাদের মন্তব্য নিয়ে আমি কিছু বলতে চাই না। কিন্তু যারা মন্তব্য করেছেন তাদের বেশির ভাগই শিক্ষিত পশ্চিমা দেশে লেখাপড়া করেছেন। তাদের পারিবারিক ছবিতে স্ত্রী-সন্তান বেশ খোলামেলা। কিন্তু তারাই সৌদি মডেল রুমি আল কাহতানিকে উলঙ্গ বলছেন। আমাকে তারা ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করছেন, জাহান্নামী বলছেন। এমনকি তারা এটাও বলেছেন যে, সৌদি আরব জাহান্নামের পথে চলে যাচ্ছে। কেউ বা বলছেন, এ মডেল কি ব্যক্তি উদ্যোগে এ কাজ করছে কিনা, এমন প্রশ্ন তুলেছেন। কারণ তাদের মতে, সৌদির মতো দেশের নারীর এমন কাজ করার কথা নয়। অনেকেই জানে না যে, সৌদি আরবের কোনো নারী বা নাগরিক রাষ্ট্রের অনুমতি ছাড়া এমন কাজ করতে পারে না। অথবা তারা জেনেও এতো মন্তব্য করছেন।
আমি বলেছি, আলোর পথে আসছে এটা বলায় মানুষের আপত্তি। কিন্তু একটা মেয়ে কালো বোরকা-আবায়া ছেড়ে যখন ঝলমলে পোশাক পরে আলোকিত ঝকমকে পরিবেশে নিজের মেধা যোগ্যতার প্রমাণ দেয়, সেটা কি আলোর পথ নয়? বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতায় নাম লেখানো মানেই যে শুধু শারীরিক সৌন্দর্য, এটা তাদেরই বুঝ যারা আসলে সর্বক্ষণ মেয়েদের নগ্ন দেহ খুঁজে। পশ্চিমা বিশ্ব বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি এবং ইসরায়েলের সঙ্গে যৌথ সর্ম্পকে ভর করে চলে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান দেশকে মধ্যবর্তী দেশে পরিণত করতে চান এবং ব্যবসা-বাণিজ্য করতে চান। এজন্য তিনি বেশকিছু অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সংস্কারের সূচনা করেছেন। যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান তেলের ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর লক্ষ্যে ২০৩০ সাল পর্যন্ত একটি সংস্কার কর্মসূচি হাতে নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বে আলোচিত হচ্ছেন। তেমনি দরিদ্র পীড়িত মুসলিম বিশ্বে সমালোচিত হচ্ছেন। সংস্কারের অংশ হিসেবে বিনোদন এবং পর্যটনকে গুরুত্ব দিচ্ছেন তিনি। এমনকি সৌদি নারীরা এখন গাড়ি চালাচ্ছেন, স্টেডিয়ামে বসে খেলা দেখছেন, হাজারো পুরুষের ভিড়ে কনসার্টে সামিল হচ্ছেন। এমনকি পুরুষ অভিভাবক ছাড়া পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশে যেতে পারছেন। এ সাহসিকতার কাজগুলো যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান খুব সাহসিকতার সঙ্গেই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
যারা সৌদি আরবের সংস্কার কেন পরিবর্তন হচ্ছে তা নিয়ে বাজে মন্তব্য করছেন তারা হয়তো জানে না যে, সারাজীবন তেলের ওপর নির্ভরশীলতায় থাকলে সৌদি আরবের অর্থনীতি ধসে পরবে। কারণ বিশ্ববাজারে তেলের পরিস্থিতি ক্রমেই অস্থির হয়ে যাচ্ছে। বিকল্প জ্বালানিসহ নানান কিছুর কারণে বিশ্বে তেলের বাজারে অস্থিরতা বেড়েছে দাম বাড়ার আশঙ্কা আছে। শুধু তেলের উপর নির্ভর করে সৌদি আরবের অর্থনৈতিক দিককে টিকিয়ে রাখা যাবে না সেটা যুবরাজ মোদাম্মদ বিন সালমান ভালো করেই জানেন। প্রায় ৬ বছর ধরে সৌদি আরবে সিনেমা প্রদর্শনী চলছে এবং প্রদর্শনী শুরু হওয়ার পর থেকে এ বাজার বিশাল আকার ধারণ করছে। বাংলাদেশে যেখানে সিনেমা হল কমছে সেখানে সৌদি আরবে প্রায় ২০০টির মতো সিনেমা হল গড়ে উঠেছে। এমনকি প্রায় ৫০০ স্ক্রিনে নিয়মিত প্রদর্শনী চলছে ও দর্শক সিনেমা দেখছে। বড় বিষয় হলো এসব সিনেমা হলের মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা থেকেই সৌদি আরব মিলিয়ন মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করছে এমনকি নিজেরাও বিশ্ব চলচ্চিত্র প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছে।
গবেষণা সংস্থা বলেছে, যদি এভাবেই সৌদি আরবের বাজার সম্প্রসারিত হতে থাকে তাহলে ২০২৫ সাল নাগাদ বিশ্বের দশম চলচ্চিত্র বাজারে পরিণত হবে সৌদি। ভাবা যায় সৌদি আরব আসলে কোন পথে হাঁটছে। অনেকেরই খারাপ লাগতে পারে যে, এরকম সৌদি আরব আমরা দেখিনি। কিন্তু এটা করার কারণ হলো, যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান দায়িত্ব নেওয়ার পর ভালো করেই বুঝতে পেরেছিলেন যে তেলের পরিস্থিতি সবসময় এক রকম থাকবে না, তাই তিনি সংস্কারের পথে হেঁটেছেন। তিনি খুব ভালো করেই জানেন যে, তাকে পৃথিবীর সঙ্গে চলতে হবে আধুনিকতার পথে হাঁটতে হবে এবং ধর্মের খোলস থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। শুধু ধর্মের কঠোরতা দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করা যায় না সংস্কার পরিবর্তন করতে হয়। এতে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে অনেক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে। সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যার পর তাকে পশ্চিমা বিশ্ব থেকে নানাভাবে কোণঠাসা করা হয়, সেখান থেকেও তিনি বেরিয়ে এসেছেন।
সৌদি আরবে নারীদের জন্য বীচ তৈরি হয়েছে, এ নিয়েও আমাদের দেশের মানুষেরা নানা আপত্তি করেছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো কাজটা অনেক ভাবনা চিন্তা করে করা হয়েছে। যারা ধনী শ্রেণির তারা বছরে বিলিয়ন ডলার খরচ করে বিদেশের মাটিতে গিয়ে ফূর্তি করতো উন্মাদ জীবন যাপন করে। নারী ও মদের পেছনেই টাকা খরচ করে বেশি বিলাসি জীবন যাপন করে। তাই শহরের থেকে ২০০ কিলোমিটার দূরত্বের অঞ্চলে বীচ রিসোর্ট গড়ে তুলেছেন মোহাম্মদ বিন সালমান। এ রিসোর্টে বিদেশি পর্যটক আসছে, মেয়েরা বিকিনি পরতে পারছে যে যার মতো করে উপভোগ করছে উদযাপন করতে পারছে। এ রিসোর্টটি তৈরি করার পর থেকে সৌদি আরবের অর্থ সাশ্রয় হচ্ছে। এছাড়াও যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান পরিকল্পনা করছেন যেন তার দেশকে তেল ছাড়াও তার প্রভাব ও প্রতিপত্তি নিয়ে টিকে থাকার যোগ্য হয়, তাই তার প্রয়োজন নারীদের জীবনে পরিবর্তন আনা। অন্ধকার থেকে আলোর পথে তাদের আনার চেষ্টা করছে। এ পরিবর্তনটা একেবারে রূপকথার গল্পের মতো মনে হয় আমরা সৌদি আরবরে নারীদের যে জীবন যাপন, পর্দা ও রক্ষণশীলতা দেখেছি সেখানে মোহাম্মদ বিন সালমানের হাত ধরে নারী জাগরণ হচ্ছে। নানা চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করে তিনি এগিয়ে যাচ্ছেন। নীতি-রীতি ভাঙ্গার কারণ ও পরিবর্তনের বিষয়টি সকলকে বুঝিয়ে দেশকে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ফেসবুক পেইজের ভিডিও কনন্টেন্ট থেকে