বিমানের টিকেট পাওয়া যায় না কেন?
পলাশ রহমান
পত্রিকায় দেখলাম, ঢাকা থেকে ২‘শ যাত্রী নিয়ে রোমে এসেছে বাংলাদেশ বিমান। প্রশ্ন হলো- এ ২‘শ যাত্রী কারা? এতগুলো যাত্রী কোথায় পেলো বিমান? রোম বা ইতালি থেকে যারা দেশে যান তাদের শতভাগ যাত্রীই রিটার্ন টিকেট করে যান। সুতরাং রোম থেকে অন্য কোনো এয়ারে দেশে গিয়ে- ফিরেছেন বিমানে, তা যেমন হবে না, একইভাবে ওই ২‘শ জন নতুন যাত্রী হওয়ারও সুযোগ কম। কারণ একদিনে ২‘শ নতুন যাত্রী ঢাকা থেকে রোম সফর করার কথা নয়। যারা ঢাকা থেকে রোমে এসেছেন প্রথম ফ্লাইটে তাদের প্রায় ১‘শ জন ভেনিসে এসেছিলেন শনিবার। তারা একটা রেস্টুরেন্ট ভাড়া করে ইফতারের আয়োজন করেন। ব্যানারে লেখেন-‘মিট দ্য প্রেস।’ কিন্তু স্থানীয় সাংবাদিকদের অভিযোগ বিমানের কর্মকর্তারা তাদের সঙ্গে বা কমিউনিটির সঙ্গে কোনো কথা বলেননি। সাংবাদিকদের প্রশ্ন করার সুযোগ রাখেননি। রাজনৈতিক ঢঙ্গে কিছু বক্তৃতা শুনিয়ে তারা শেষ টেনেছেন। এমনকি প্রবাসীদের সঙ্গে বসে ইফতারিও করেননি, করেছেন আলাদা জায়গায়।
২০১৫ সালে ঢাকা-রোম রুটের বিমান সার্ভিস বন্ধ হয়ে যায়। কারণ লোকসান হচ্ছিলো। ৯ বছর পরে তা ফের চালু হয়েছে। এবার লোকসান না হওয়ার নিশ্চয়তা কী? ব্যবসায়িক ডিজাইন কী? আগে কেনো লোকসান হয়েছিলো, তা কী চিহ্নিত করা হয়েছে? সেগুলোর সমাধানে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে? কেনো বিমানের টিকেট কিনতে গেলে পাওয়া যায় না, অথচ সিট ফাকা থাকে? ভেনিসসহ বাংলাদেশিবহুল শহরগুলোর সঙ্গে কি কোনোভাবে বিমানকে কানেক্ট করা হবে? যেমন, এক টিকেটে ভেনিস থেকে একজন যাত্রী কি রোম হয়ে ঢাকা যেতে পারবেন? কথিত ২‘শ যাত্রীর আড়ালে কি কোনো আদম ব্যবসা হয়েছে? বিমানের অনুষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ কেন প্রবাসী আওয়ামী লীগ নেতাদের হাতে ছিলো? অন্যান্য সামাজিক, রাজনৈতিক দলের নেতাদের দেখা যায়নি কেন? সরকারি দল করে না, এমন যাত্রী কি বিমানের দরকার নেই? বিমান কি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, নাকি দলীয় প্রতিষ্ঠান? এমন একগাদা প্রশ্ন পেটে নিয়ে দম আটকে বসে ছিলেন সাংবাদিকরা। প্রশ্ন করার কোনো সুযোগ তাদের দেওয়া হয়নি। কেউ কেউ বলে ফেলেছেন, প্রশ্ন করা না গেলে এ আবার কেমন তরো ‘মিট দ্য প্রেস?’ একটা প্রেস রিলিজ পাঠিয়ে দিলেই তো হতো। এত টাকা খরচ করার কী দরকার ছিলো? বিমানের বিরুদ্ধে যাত্রীদের মোটা দাগে অভিযোগ তিনটি। টিকেট না পাওয়া, সময় মতো ফ্লাইট না ছাড়া এবং সার্ভিস খারাপ। আমরা সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখেছি বিমানের মধ্যে কারেন্টের ব্যাড দিয়ে মশা মারতে। আমার এক বন্ধু জানিয়েছেন, ডায়াবেটিকের শরীর নিয়ে বিমানের সারপোকার কামড় খেয়ে তাকে দীর্ঘ দিন চিকিৎসা নিতে হয়েছে।
এ অভিযোগগুলো যে সত্যি তার বড় প্রমাণ হলো বিমানের মধ্যে যাত্রীদের ছবি তোলা, ভিডিও করা নিষেধ করেছে কর্তৃপক্ষ। যাত্রীরা কেনো ছবি তুলতে পারবে না? কী লুকাতে চায় কর্তৃপক্ষ, তা বুঝতে বেশি বুদ্ধির দরকার হয় না। সবাই পারলে বিমান কেনো সময় মতো ফ্লাইট ছাড়তে পারে না? ঘাপলা কোথায়? বিমানের টিকেট পাওয়া যায় না কেন? যাত্রীরা বলেন, কিনতে গেলে টিকেট নেই, বিমানে চড়লে দেখা যায় শতশত সিট খালি? ঘটনা কী? অন্যান্য দুর্নীতির বাইরে সম্ভবত এখানেই লুকিয়ে আছে বিমানের লোকসান গোনার অন্যতম কারণ। বিমান হয়তো এখনো লটম্যান বিক্রি করে। এজেন্টদের কাছে বড় সংখ্যার সিট দিয়ে রাখে এবং তারা ওগুলো আটকে রাখে। শেষ পর্যন্ত সব সিট তারা বিক্রি করতে পারে না। লোকসান গুনতে হয় বিমানকে। এ পদ্ধতিতে এয়ারলাইনগুলো ব্যবসা করতো অনেক আগে। এখন আর কেউ করে না। প্রযুক্তি এখন অনেক এডভান্স। টিকেট বুকিং দিয়ে বেশি সময় রাখা যায় না। পেমেন্ট না দিলে সফটওয়্যার অটোমেটিক বুকিং ক্যানসেল করে দেয়। এমনকি বেনামেও টিকেট কিনে রাখা যায় না। যাত্রীর নামের বানান দুই অক্ষরের বেশি সংশোধন করা যায় না। অর্থাৎ বুকিং দিয়ে সিট আটকে রাখার দিন অনেক আগে ফুরিয়ে গেছে। হয়তো বিমানের বেলায় ফুরায়নি এখনো। ফলে টিকেট নিকতে গেলে নেই, অথচ সিট ফাকা থাকে। বিমান কর্র্তৃপক্ষ বলেন, নন পিক সিজনে সিট খালি যায় বা যেতে পারে। কিন্তু টিকেট কিনতে চাইলে কেনো পাওয়া যায় না, সে ব্যাখ্যা তারা দেন না। এতেই বোঝা যায়- বিমানের বোয়িং নতুন বা আধুনিক হলেও সফটওয়্যার মানুষগুলো আগের মতোই আছে। এখানে একটা বিষয় পরিষ্কার বুঝতে হবে, বিমান কোনো আবেগ বা আলগা দেশপ্রেমের জায়গা নয়। এটা একটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
এর কোটি কোটি টাকার লোকসান দেশের মানুষকেই গুনতে হয়। দেশের মানুষের মাথায় উচ্চ সুদে ঋণের বোঝা চাপিয়ে বোয়িং কিনতে হয়। বিমান কোনো লিল্লাহ বোডিং নয়। আশা করি লোকসানের বোঝা মাথায় নিয়ে বিমানকে ঢাকা-রোম রুটের ফ্লাইট ফের বন্ধ করতে হবে না। তবে তাদের বিজনেস ডিজাইন খুব বেশি চিন্তা করে করা হয়েছে বলে মনে হয় না। বিমান সপ্তাহে ৩টা ফ্লাইট পরিচালনা করবে ঢাকা-রোম রুটে। অর্থাৎ বিমানে যেতে চাইলে যাত্রীদের ওই তিন দিনের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে। মাসে ১২টা ফ্লাইটের জন্য রোমে একগাদা কর্মকর্তা/কর্মচারি, অফিস-টফিস পালতে হবে। তাছাড়া ফ্লাই এবং ল্যান্ডের সময়ও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কে চাইবে বিকল্প থাকার পরেও রাত একটা/দেড়টায় ঢাকায় নামতে? এত রাতে ঢাকায় নেমে যে বিপদে পড়বে একজন যাত্রী, সে দায় কে নেবে? বিমান কি পারবে অন্যান্য এয়ারলাইনের তুলনায় কম দামে অন্তত বেশি না টিকেট বিক্রি করতে? বিমান কি পারবে যাত্রীদের লাগেজ ওয়েট নিয়ন্ত্রণ করতে? সত্যিকারার্থে বিমানে বাংলাদেশিরা কেন যায় জানেন? অন্য এয়ারে লাগেজের ওজন এক কেজি বেশি হলেও বাড়তি টাকা দিতে হয়। কিন্তু বিমানে দলের পরিচয়, মামা, চাচার পরিচয়, হাম্বিতাম্বি বা হাতের মুঠে হালকা কিছু গুজে দিয়ে পার পাওয়া যায়। অতীতে এমন হয়েছে এগুলো বন্ধ করতে না পারলে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হিসাবে বিমান চলবে না। পত্রিকায় দেখেছি, ইরানের উপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা থাকায় বিমান ইরানের আকাশ পথ ব্যবহার করতে পারছে না। অন্য পথে যেতে হলে সময় এবং খরচ দুইটাই বেড়ে যায়।
এ সমস্যার সমাধান কী হয়েছে? কীভাবে হয়েছে, তা জানা যায়নি। যদি খরচ বাড়িয়ে বিমান চালাতে হয়, তবে শুরুতেই তো লোকসানের মধ্যে পড়লো বিমান, লাভ করবে কীভাবে? ব্যানারে মিট দ্য প্রেস লিখলেও বিমান কর্তৃপক্ষ ভেনিসে মূলত ইফতার পার্টি করেছেন, আর সরকারের কিছু গুণকীর্তন শুনিয়েছেন কম্যুনিটিকে। এর বাবারে কেন তারা এ আয়োজন করেছেন তা পরিষ্কার নয়। অনেকে বলাবলি করেছেন, রাষ্ট্রীয় খরচে তাদের বিশাল বহরের ভেনিস সফর হালাল করতে এ আয়োজন করা হয়েছে। কারণ বিমানের যদি প্রচার প্রচারণা করতেই হয়, রোমসহ আশপাশের বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকায় করবে, ভেনিসে কী? এত মানুষ নিয়ে কীসের প্রচার? রোম থেকে ভেনিসের দূরত্ব ৫‘শ কিলোমিটারের বেশি। ভেনিস এয়ারপোর্ট থেকে প্রতিদিন কমপক্ষে ৩টা ফ্লাইট ‘আমরিাত, তুর্কি’ ছাড়ে ঢাকার উদ্দেশে। কে যাবে রোমে বিমানের যাত্রী হতে? শেখ হাসিনা দেশে ইফতার মাহফিলে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন কৃচ্ছ্রসাধনের জন্য। বিদেশে এসে তার নেতা-আমলারা কী করলেন? কতো কী কৃচ্ছ্রসাধন করলেন? এর জবাবদিহিতা কি তিনি জনগণকে দেবেন? ভেনিসে বিমানের অনুষ্ঠানে সবেচেয়ে বেশি অস্থির ছিলেন রোম আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। ঢাকার এমপি, সচিবদের আদর-যত্ন দিতে তার মাত্রাতিরিক্ত অস্থিরতা সবার চোখে পড়েছে। সাংবাদিকদের সঙ্গেও খারাপ ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। এমনকি ভেনিস বাংলাদেশ প্রেস ক্লাবের সভাপতি কথা বলতে চাইলে, সেখানেও তিনি বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। স্বাগতিক কমিউনিটির প্রতিনিধি হিসেবে ভেনিস আওয়ামী লীগের সভাপতিকেও দু’মিনিট কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয়নি। যা অনেকের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। ৩২-৩-২৪। ফেসবুক থেকে