বাজার-জ¦ালানি-ব্যাংক : আসলেই কি চাপের মুখে আমাদের অর্থনীতি?
[১] ড. জামালউদ্দিন আহমেদ, অর্থনীতিবিদ ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি :
লোকাল প্রোডাকশনে লবিস্ট, ইকোনোমিস্ট যারা, সেখানে লোকাল প্রোডাকশনগুলোতে প্রাইজ হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়া উচিত নয়। রেগুলেটরি প্রতিষ্ঠানগুলোর যে ব্যর্থতা তা মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে জোড়ালোভাবে দায়ী। ব্যাংকিং সেক্টরের কথা বলতে গেলে আমি বলবো যে, একটি ভালো উদ্দেশ্য হলে অন্যটি খারাপ উদ্দেশ্য হয়। যদি খারাপ হয় তাহলে তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। দায়িত্ব নেওয়ার পর যে অ্যাসেট ম্যানেজম্যান্ট কোম্পানি করলো, সেখানে বেড অ্যাসেটগুলো নেবে এবং সেগুলো নেওয়ার পর তিনিও সেখান থেকে কিছু রোজগার করবেন। আর এক্ষেত্রে ডিপোজিটররা ডিপোজিটরস মানি পাবে না।
[২] অধ্যাপক আবু আহমেদ, অর্থনীতিবিদ : যখন জ¦ালানির দাম হঠাৎ করে বৃদ্ধি করা হলো, আমি বা আমার মতো অনেকে বলেছিলেন যে, সরকারের পলিসিই মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে দেবে। কারণ এগুলোর সঙ্গে অনেকগুলো বিষয় সম্পর্কিত। তখন সরকার যা ঠিক মনে করেছিলো তা করেছে, কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে সেটি সঠিক সিদ্ধান্ত ছিলো না। আর যদি একান্তই বাড়ানো দরকার হতো তাহলে এতোটা বাড়ানো উচিত ছিলো না। অর্থনীতিতে আমরা যা শিখেছি বা শিখিয়েছি তাহলো মার্কেট ৩-৪ ধরনের। একটি হলো আদর্শিক মার্কেট। যেখানে ক্রেতা-বিক্রেতা অগণিত থাকে। তারপরে আসে এমন একধরনের মার্কেট যেখানে ক্রেতা অনেক, কিন্তু সাপ্লাইয়ার কম। এগুলোতে সমস্যা হয়। এক্ষেত্রে ইকোনোমিক সায়েন্স একটি সমাধান দিয়েছে যে এগুলো খুব ভালোভাবে রেগুলেট করতে হবে।
[৩] মো. সিদ্দিকুর রহমান, সাবেক সভাপতি, বিজিএমইএ : আমরা ভেবেছিলাম যে করোনার সময় বা এরপরে মানুষ হয়তো একটু বদলাবে, কিন্তু তা হয়নি। করোনার আগে আমাদের একটি কন্টেইনার ভরা ছিলো তিন হাজার ডলারের নিচে, কিন্তু করোনার পর তা হয়ে গেলো বিশ হাজার ডলারের উপরে এবং তার সঙ্গে কিন্তু আমদের দেশের লোকজন জড়িত নয়। সাপ্লাই ডিমান্ডের বেলায় যদি সাপ্লাই বেশি থাকে আর ডিমান্ড কম থাকে তাহলে সেই জিনিসতো পড়ে থাকলেও কেউ নেবে না। মোরালিটি খুব কম লোকের আছে। যদি মোরালিটির দিক থেকে বিচার করতে চাই তাহলে শেষ পর্যন্ত কোনো কিছুই ঠিক হবে না। আমরা নীতি-নৈতিকতা, মোরালিটি এরকম অনেক কিছু বলতে পারবো। কিন্তু তাতে আমাদের চরিত্র বদলাবে না। চরিত্র বদলাতে হলে রেগুলেটরি বা আইন দিয়েই বদলাতে হবে। এছাড়া অন্য রাস্তা আছে বলে আমি মনে করি না। আমি মনে করি যে, ডলারের দাম যদি ব্যাংকার এসোসিয়েশন ঠিক করে দিতে পারে এবং যে কয়েকজনের সিন্ডিকেট আছে যারা প্রোডাক্ট ইম্পোর্ট করে, তাদের কাছে যদি দায়িত্ব দেওয়া হয় তাহলে সুফল পাওয়া যাবে। কারণ তখন যদি কোনো সমস্যা হয়, তাহলে সরাসরি সেই সিন্ডিকেটকে ধরা যাবে।
[৪] ফারুক মঈনুদ্দিন, অর্থনীতি বিশ্লেষক ও ব্যাংকার : ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ভেতর দিয়ে চলার সময় যে ড্রাইভার গাড়ি চালায়, তখন কিন্তু সে পৃথিবীর সবচেয়ে ভদ্র ড্রাইভার। কিন্তু ক্যান্টনমেন্ট এলাকার বাইরে আসার সঙ্গে সঙ্গে কী কারণে সবচেয়ে অভদ্র চালক হয়ে যায়? আইন-কানুুন। আমি বলতে চাচ্ছি যে আইন-কানুুনের প্রয়োগ কোথাও নেই। আমাদের দেশে অতীতে যারা লুটপাট করেছে তাদের কখনো শাস্তি হয়নি। মার্জার কিন্তু আসলে একটি স্ট্র্যাটেজিক ডিসিশন। উভয় কোম্পানি যদি মনে করে যে তারা মার্জারে যাবে তাহলে তারা যেতে পারে। মার্জার স্ট্র্যাটেজিক ডিসিশন অনুযায়ী হওয়ার কথা, কিন্তু আসলে যারা মার্জারে যাচ্ছে তারা কোন স্ট্র্যাটেজিক ডিসিশনে মার্জারে যাচ্ছে তা বলার সময় এখনো আসেনি। এক্ষেত্রে একটি বিষয় বলা যেতে পারে যে তুলনামূলক দুর্বল ব্যাংকের গ্রাহকরা একরকম মানসিক স্বস্তি পেতে পারে যে তাদের ডিপোজিটকৃত ব্যাংক ভালো একটি ব্যাংকের সঙ্গে জুড়েছে।
[৫] আবু হেনা মোহাম্মদ রাজী হাসান, সাবেক ডেপুটি গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক : ব্যাংকিং ব্যবসা একটি আত্মবিশ^াসের বিষয়। যারা এটি করছেন তাদের মূলধন কতোটুকু আর মানুষের কাছ থেকে যে ডিপোজিট আসছে সেটি তার তুলনায় কতোগুণ বেশি, এটি দেখার বিষয়। কাজেই ব্যাংকিং সেক্টরে যতো পলিসি দরকার, অন্য কোনো ব্যবসার ক্ষেত্রে কিন্তু এতো পলিসি দরকার হয় না। আমাদের দেশের ব্যাংকিং ইতিহাসের দিকে যদি আমরা তাকাই তাহলে দেখা যাবে যে, বিভিন্ন অবস্থার ভিত্তিতে বা বিভিন্ন সময়ে পলিটিক্যাল ইকোনোমি চলে আসে। আমরা দেখেছি যে গ্রামীণ আর্থিকীকরণের ক্ষেত্রে একসময় প্রচুর পরিমাণে গ্রামীণ ব্রাঞ্চ করা হলো। সেগুলোর মাধ্যমে তারা এগ্রি ফাইন্যান্স করেছে। একসময় দেখা গেলো যে, ব্রাঞ্চগুলো আর ভায়াবল না। তখন সেগুলোকে অন্য কোনো ব্রাঞ্চের সঙ্গে মার্জার করতে হয়েছে। এখন প্রশ্ন আসে যে, আমরা এতো ব্যাংক দিলামই বা কেন, আর এখন আবার মার্জারই বা করছি কেন? ব্যাংকগুলো দেওয়ার সময় যতোটুকু হিসাব করা দরকার ছিলো তা সম্পূর্ণভাবে করা হয়নি আমাদের এখানে। কারণ প্রতিটি দেশেই পলিটিক্যাল ইকোনোমি থাকে, আমরাও তার ব্যতিক্রম নই।
[৬] অধ্যাপক ড. হোসেন মনসুর, সাবেক চেয়ারম্যান, পেট্রোবাংলা : পেট্রোবাংলা খুব ভালো। ওখানকার কর্মকর্তারা খুবই ভালো তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু পেট্রোবাংলা ‘বি’ ক্যাটাগরির কর্পোরেশন। আমি থাকা অবস্থায় সরকার সিদ্ধান্ত নিলো যে কতোগুলো ‘এ’ এবং কতোগুলো ‘বি’ ক্যাটাগরির কর্পোরেশন হবে। তখন আমি বলেছিলাম যে, পেট্রোবাংলার মতো প্রতিষ্ঠান ‘বি’ ক্যাটাগরির করা ঠিক হলো না। সেখানে এডিশনাল সেক্রেটারি যায়, প্রমোশন নেয়, সচিব হয় এবং চলে যায়। এটি একটি গেটওয়ের মতো কাজ করেছে। কেউ সেখানে স্থায়ী ভাবে থাকে না। আমি মনে করি যে সরকারের উচিত এখনই এটিকে ‘এ’ ক্যাটাগরিতে নিয়ে আসা। আমার এটিও মনে হয় যে সেখানে কিছু প্রসাশনিক সমস্যা আছে।
[৭] জিয়াউর রহমান, সম্পাদক, দৈনিক অর্থসূচক : আমরা যদি স্বল্পমেয়াদী চিন্তা করি তাহলে দুটি জিনিসের দিকে নজর দেওয়া উচিত। দ্রব্যমূল্য এবং রিজার্ভ। দ্রব্যমূল্যের ক্ষেত্রটিতে এই মুহূর্তে যেভাবে ম্যানেজ করার চেষ্টা করা হচ্ছে বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে, এটি দিয়ে আসলে সমাধান সম্ভব না। হয়তো আপাতত যে ক্ষোভ-বিক্ষোভ আছে ক্রেতাদের মধ্যে তা প্রশমিত করা যাবে। কিন্তু আমরা যদি এটির সত্যিকারের সমাধান চাই তাহলে আমাদের কিছু কাজ হাতে নিতে হবে। সমন্বয়ের যে দিকগুলো আছে সেগুলোর উপর জোড় দিতে হবে এবং যতোটুকু সম্ভব ঘাটতি কমিয়ে আনতে হবে। রেগুলেটরি বডিগুলো শক্ত করতে হবে। তবেই ঠিকঠাকভাবে তারা কার্য হাসিল করতে পারবে। নীতি-নৈতিকতার কথা বললে কিছ্ইু সম্ভব হবে না।
[৮] ড. শামসুল আলম, অর্থনীতিবিদ, সাবেক প্রতিমন্ত্রী, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়: আমার মতে বাজার ঘিরেই সব রকম সমস্যা হয়ে থাকে। এখানে আমি মোটা দাগে বলতে চাই বাজারকে কাজ করতে দেওয়া উচিত। যদিও সিন্ডিকেট হয়, কিন্তু সব ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট কাজ করে না কৃষি পণ্যে তো আরো করে না। বলা হতে পারে যে কেন লেবুর দাম হঠাৎ করেই বেড়ে যায়? আমি বলবো যে নীতি-নৈতিকতার ব্যাপারটি এর সঙ্গে জড়িত। যখন আমরা বাজার না বুঝে কৃষি পণ্যের দাম ঠিক করি, তখন সেটি কাজ করবেই না। সিন্ডিকেট যেখানে হয় তা অবশ্যই সরকারের নিয়ন্ত্রণে। সিন্ডিকেশন তখনই বন্ধ করা যাবে যখন সাপ্লাই এবং ডিমান্ডের মধ্যে সমতা থাকবে।
সূত্র: একাত্তর টিভির ‘এডিটরস গিল্ড’ অনুষ্ঠানের ভিডিও কনটেন্ট থেকে শ্রুতিলিখন করেছেন সঞ্জয় চন্দ্র দাস