ব্যাংক একীভূতকরণের বাস্তবতা ও ঋণ খেলাপি
ড. আহমদ আল কবির
বাংলাদেশের ১১টি ব্যাংক একীভূতকরণের বিষয়ে কথা হচ্ছে এবং সংশ্লিষ্ট আইনেও পরিবর্তন এসেছে। একীভূতকরণের কর্তৃত্ব কাদের কাছে আছে সে বিষয়েও বেশ পরিবর্তন এসেছে। আমরা ইতোমধ্যে দেখেছি যে, পদ্মা ব্যাংক এবং এক্সিম ব্যাংক একীভূতকরণ ঘোষিত হয়েছে। কিন্তু আমাদের প্রেক্ষাপট বুঝতে হবে যে, আমাদের ব্যাংকগুলোর নন-পারফর্মিং লোন ধীরে ধীরে বেশি পরিমাণে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং দেখা যাচ্ছে যে ১১টি ব্যাংকে ২৪ হাজার কোটি টাকার লোন মোটামুটি ৯৩ শতাংশ ডিফল্ট লোনের পরিমাণ থাকে। তাহলে এসব ব্যাংকের পুঁজি কমে যাবে এবং আর্থিক দিক থেকে ব্যাংককে সবল করার মতো যে, সামর্থ্য থাকা দরকার সেটাও তারা হারিয়ে ফেলবে। এ প্রেক্ষাপটেই ৬১টি কর্মাশিয়াল ব্যাংকে এবং ৩৪টি নন-ব্যাংকিং ফাইন্যান্সিয়াল ইন্সটিটিউটের অপারেশন নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা করে তারা ঘোষণা করেন যে, ২০২৩ ব্যাংক আইন অনুযায়ী তারা ব্যাংকের সমস্ত কার্যক্রম পরিচালনা করবেন এবং সেই অনুযায়ী কাজ শুরু করেছে। এটা একটা শুভ লক্ষণ।
কিন্তু যারা অর্থনীতি ও ব্যাংকিং নিয়ে চর্চা করেন তাদের ধারণা এ প্রক্রিয়াটি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হবে কিনা এ নিয়ে অনেক সন্দেহ আছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ ব্যাংক বলে দিবেন যে, কোন ব্যাংকের সঙ্গে কোন ব্যাংক একীভূত হবে এবং অনেকেই আলোচনা শুরু করে দিয়েছেন যে এ প্রক্রিয়াটি আদৌ স্বচ্ছতার সঙ্গে পরিচালিত হবে কিনা? হলেও তা কতোটুকু বাস্তবমুখী হবে? এ আলোচনার কারণ হলো, ব্যবসায়ীরা যারা ব্যাংক চালান বিশেষ করে যারা প্রাইভেট ব্যাংক চালান তারা যার যার স্বার্থ দেখবে এবং যে দুটো ব্যাংককে একীভূত করা হবে তাদের স্বার্থ কী মিলবে? তাদের স্বার্থ যদি ব্যাংকের উন্নতি করা হয় তবুও তাদের মাঝে স্ট্র্যাটেজিক অ্যালয়েন্স মিউচুয়ালি হলে সুষ্ঠুভাবে কাজ পরিচালনা করা যাবে আর যদি না হয়, রেগুলেটর গিভেন হয় তাহলে তারাই সিদ্ধান্ত দিয়ে দেবেন যেকোনো ব্যাংক কার সঙ্গে একীভূত হবে, কীভাবে কার্যক্রম পরিচালিত করবে। আমার ব্যক্তিগত মত ছিলো যে, একীভূতকরণের প্রক্রিয়াকে এতো স্বল্প সময়ে ও দ্রুত পরিচালনার সিদ্ধান্ত না নিয়ে প্রথমে দুর্বল ব্যাংকগুলোর দুর্বলতা, অর্থাৎ কোন ব্যাংকের এপিএল বেশি, ম্যানেজমেন্ট দুর্বল, ঋণের পরিমাণ বেশি এ দিকগুলোকে শনাক্ত করা। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন করা। এটা সম্ভব হবে যদি দুর্বল ও সবল ব্যাংকের মাঝে মিউচুয়্যালি রেগুলেটরি ব্যবস্থাপনা হয় তবেই তা সম্ভব হবে। দুর্বল ব্যাংককে সবল করার জন্য একটি নির্দিষ্ট রোডম্যাপ থাকা দরকার এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা থাকা জরুরি সে অনুযায়ী ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করলে দুর্বল ব্যাংককে সবল করা সম্ভব। অন্যথায়, যদি অনিয়ম চলতে থাকে তাহলে সবল ব্যাংকেরও দুর্বল হবার সম্ভাবনা তৈরি হবে।
মুখে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা খুব সহজ কিন্তু দক্ষতা ও ধারণা ছাড়া কোনো পদক্ষেপ নেওয়াটা খুবই রিস্ক কারণ এর ফলে আর্থিক খাতে চাপ সৃষ্টি হতে পারে। আরেকটি বিষয় বলতে চাই সরকার যে বারবার বলছে নতুন ব্যবস্থাপনায় মানুষের কোনো ক্ষতি হবে না কিন্তু একীভূত করার পর যদি দেখা যায় যে উন্নতি হচ্ছে না সেটার দায় কি সরকার নিবে? তখন কিন্তু যারা ব্যাংক স্থাপন করেছে তাদেরকে দায়ী করা যাবে না। এসব বিষয়কে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিবেচনায় এনে তবেই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। আমি সুপারিশ করবো প্রথমে দুর্বল, সবল ও মধ্য র্যাঙ্কানুযায়ী প্রতিটি ব্যাংকের একটি তালিকা তৈরি করে সময় দিয়ে দুর্বল ব্যাংককে চিহ্নিত করে সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করা। এক্ষেত্রে কারো উপর চাপিয়ে দেয় যাবে না বরং ব্যাংক ব্যবস্থাপনার জন্য দুর্বল ও সবল ব্যাংকের আর্থিক দিক বিবেচনা করে ও ব্যাংকের স্বার্থে লাভজনক করার জন্য দক্ষ কাউন্সেলিং ও টেকনিক্যাল অ্যাসিস্টেন্টের মাধ্যমে যেন একীভূত করা হয়। তৃতীয় প্রক্রিয়ায় যাদেরকে কেউ দিতে চাইবে না তাদেরকে অন্য পন্থা নিতে হবে অর্থাৎ, বিক্রি করতে হবে। যারা একীভূতকরণে এগিয়ে আসবে তাদেরকে উৎসাহিত ও সাহায্য করা উচিত তারা যেন উদাহরণ হয়ে থাকে। যারা কাউন্সেলিং এর মাধ্যমে আসবেন তাদেরকে রেগুলেটর কোর্স করে নিতে তবে এটা খুব একটা মানসম্মত হবে না। আর কিছু সংখ্যক ব্যাংক আছে যাদের কেউ নিতে চাইবে না তাদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা নিতে হবে। আমার মনে হয় আমাদের এসব চিন্তা-ভাবনার প্রতিফলন যদি বাস্তবায়ন করতে পারি তাহলে আর্থিক খাতের অনেক উন্নতি হবে এমনকি ব্যাংকের ম্যানেজমেন্ট উন্নয়নের দিকে যাবে।
আমাদের দেশে জিএম হওয়ার পর যারা উচ্চপদাসনে বসেন তাদেরকে প্রশিক্ষণ দেযা হয় না কিন্তু অন্য সকল পদের জন্য প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা হয়। কাউকে প্রশিক্ষণ ছাড়া জিএম পদে বসতে হলে অবশ্যই দক্ষতা ও পড়াশোনার পরিমাণ উচ্চ পর্যায়ের হতে হবে। আধুনিক ব্যাংকিং ও আর্থিক স্বচ্ছলতা ধরে রাখার যে কৌশল সে বিষয়ে জ্ঞান থাকতে হবে নইলে এভাবেই আর্থিক খাতে ধ্বস নেমে আসেবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১০-২০১৩ সালে বেশ ভালো মানসম্মত আর্থিক উন্নয়ন প্রকল্প করেছিলো কিন্তু তা ধরে রাখতে পারেনি দক্ষতা ও অব্যবস্থাপনার জন্য। সুতরাং গুণগত মান ও উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড এগিয়ে নিতে আরো দক্ষতা, ট্রেইনিং ও নৈতিক শিক্ষার প্রয়োজন। বোর্ডের উপর আমরা নির্বরশীল কিন্তু তাদেরও কোনো প্রশিক্ষণ নেই। ব্যাংক সম্পর্কে তাদের ধারণা অতি সামান্য। আমি মনে করি একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হতে হলে যেমন প্রশিক্ষণ ও দক্ষতার প্রয়োজন তেমনি বোর্ড মেম্বারদের প্রশিক্ষণ, ট্রেইনিং ও ব্যাকিং ব্যবস্থাপনা নিয়ে কোর্স করা উচিত। পাশাপাশি বোর্ড মেম্বারদের ফরমাল ওরিয়েন্টশন ফরমাল টেকওভার করার পরামর্শ দিচ্ছি। দেশের বিভিন্ন জায়গায় ব্যাংকের প্রতিটি পদের জন্য ট্রেইনিং, প্রশিক্ষণ ও ব্যাংকিং এর কোর্স করানো হয় কিন্তু বাংলাদেশেই জিএম ও বোর্ড মেম্বারের বেলায় করানো হয়না। আমি চাই যোগ্যতা মানসম্মত ও গুণগত করার জন্য আলাদা করে ব্যবস্থা করা হোক। আমরা যাদের ভালো ব্যাংক বলছি তাদেরকে উৎসাহ করে পাশে থেকে কাজটাকে আরো এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। আমার মতে বাংলাদেশ ব্যাংককে এসকল কাজের জন্য তেমন উদ্যোগ নিতে দেখছি না এ দিকেও আমাদের জোর দিতে হবে।
আমি খুবই আশাবাদী ব্যাংক একীভূতকরণের যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তা নিয়ে। এটি ভালোভাবে বিচার বিবেচনা করে সমন্বিত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে পারলে আমরা অনেকটা উন্নতি করতে পারবো। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো অবশ্যই ঋণ খেলাপিদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার আওতায় আনতে হবে। ঋণ আদায়ের জন্য সরাসরি বৈঠক ও আলোচনা করা যেতে পারে, কীভাবে টাকা আদায় করা হবে তা নিয়ে আলাপ আলোচনা করতে হবে। আর তা যদি না হয় তাহলে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। আমাদের দেশের আইন ব্যবস্থা নিয়ে খুব দুর্বল ব্যাংকের উকিলরাও তেমন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নয়। ব্যাংকের আইন আছে কিন্তু মামলা তৈরি করার মতো দক্ষ উকিল নেই। ব্যাংকের এনপিএল উদ্ধার করার জন্য আমাদের ব্যাংকের উকিলদেরেও মামলা তৈরি করার মতো প্রশিক্ষণ নিতে হবে, আইন জানতে হবে। তবেই আমাদের ব্যাংক একীভূতকরণ প্রক্রিয়া সফল হবে।
পরিচিতি : সাবেক চেয়ারম্যান, রূপালি ব্যাংক। মতামত গ্রহণ করেছেন রুদ্রাক্ষী আকরাম