বুয়েট অনেকটা ভারতের আইআইটির মতো
কামরুল হাসান মামুন
ভারতে বর্তমানে ২৩টি আইআইটি আছে যেগুলো ভারতের উচ্চ শিক্ষাকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। বাংলাদেশের বুয়েটকে কিছুটা আইআইটির সাথে তুলনা করা যায়। আইআইটিগুলো থেকে পাশ করে পৃথিবীর নানা দেশের বিশ্বসেরা প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে যেমন ঝঁহফধৎ চরপযধর যাকে সবাই চিনে, আছে অঃরংয উধনযড়ষশধৎ যিনি প্রফেসর আব্দুস সালামের হাতে তৈরী ওঈঞচ ইতালির ডিরেক্টর এইরকম আরো অসংখ্য আছে। এদের অনেকেই আমেরিকা বা ইউরোপের বড় বড় প্রতিষ্ঠানে কাজ করে একেকজন ভারতের অ্যাম্বাসেডরের মত ভারতের ইমেজ বিশ্বে উন্নত করছে। আমাদের বুয়েটও কম করছে না। বুয়েট থেকে পাশ করে যারা আমেরিকায় পিএইচডি করতে গিয়েছিল তাদের অনেকেই আমেরিকার বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় যেমন ক্যালটেক, ভার্জিনিয়া টেক, টেক্সাস টেকসহ আরো অনেক প্রতিষ্ঠানের খ্যাতিমান প্রফেসর হয়েছে। ভার্জিনিয়া টেকের প্রফেসর বাংলাদেশের অধ্যাপক সাইফুর রহমান ওঊঊঊ-র প্রেসিডেন্ট ছিলেন গত টার্মে। বুয়েট এলামনাই অনেকেই ওঊঊঊ-র ফেলো। বুয়েট গ্রাজুয়েট ঝধুববভ ঝধষধযঁফফরহ এখন টঈ ইবৎশবষবু বিখ্যাত অধ্যাপক। প্রফেসর ফজলে হোসেন বিশ্বে ফ্লুইড ডাইনামিক্স এর সেরা ৫ জনের একজন। এই বুয়েট থেকেই ফজলুর রহমান খান আমেরিকায় লেখাপড়া করতে গিয়ে স্থাপত্যের আইনস্টাইন হয়েছিলেন। এইরকম অসংখ্য নাম বলা যাবে। এখন আমরা কি চাই? এত ভালো ভালো না ভেবে তাকে থামিয়ে দিতে হবে?
বলা হচ্ছে বুয়েটে জঙ্গি ও ধর্মীয় উগ্রবাদী মানুষ তৈরী হচ্ছে। সাথে এইটাও বইলেন বুয়েট ওয়ার্ল্ড ক্লাস স্কলারও তৈরী করছে। গতকাল জানলাম ওদের ১৪তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা ২০১৯ অক্টোবর থেকে বুয়েটের শিক্ষক হতে শুরু করে এবং ২০ জন শিক্ষক হয়। সেই ২০ জনের মধ্যে ৪ জন এখন এমআইটিতে পিএইচডি করতে যাচ্ছে, ১। ২ জন যাচ্ছে ক্যালটেকে। বাংলাদেশের আর কোন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম বলেনতো যে সেখান থেকে সর্বমোট এত জন ছাত্র এত ভালো ভালো জায়গায় লেখাপড়া করতে গেছে? বুয়েট ব্যতীত বাংলাদেশের প্রায় অন্যসব উচ্চশিক্ষার পাবলিক প্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতি আছে। ছাত্র রাজনীতি কি সেইসব জায়গায় জঙ্গি ও ধর্মীয় উগ্রবাদী মানুষ তৈরী আটকাতে পেরেছে? ছাত্রলীগ ছাত্রদল কিভাবে এইসব থামাবে? তারা কি আদর্শভিত্তিক রাজনীতি করে? এদের দল যখন ক্ষমতায় থাকে এই সংগঠনগুলোর একেকজন ছাত্রনেতা একেকজন মনস্টার হয়ে উঠে। গেস্ট রুম টর্চার, জোর করে মিছিলে নেওয়া, ফাও খাওয়া ইত্যাদির কোন অপকর্ম কম করে? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এইসব জারি রাখার লাইসেন্স দেওয়ার নামই ছাত্র রাজনীতি। জঙ্গি ও ধর্মীয় উগ্রবাদী মানুষ তৈরী থামাতে হলে দরকার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের প্রসার। আমাদের ক্ষমতাকেন্দ্রিক হাতের রাজনীতি যারা করে তারা কি এইসবে তোয়াক্কা করে?
ভারতে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সাইন্স বা ওওঝপ আছে যাকে বলা যায় ভারতের হার্ভার্ড বা অক্সফোর্ড অথবা কেমব্রিজ তার ওয়ার্ল্ড রেঙ্কিং হলো ২০০ থেকে ২৫০ এর মধ্যে। এটিই ভারতের সেরা বিশ্ববিদ্যালয় এবং এর কোন কোন বিভাগ যেমন পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ হার্ভার্ড বা ক্যামব্রিজের চেয়েও ভালো। ২৩টি আইআইটি কিংবা ওওঝপ-তে ছাত্র রাজনীতি আছে? ভারতের রাজনৈতিক দলগুলোতো বলে না এইটা সংবিধান পরিপন্থী। তাদের কেউ কোর্টেও যাচ্ছে না। এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভারতের রাজনৈতিক দলগুলো এবং জনগণ মিলে আগলে রেখেছে। সেখানে দলীয় লেজুড়বৃত্তিক ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক বা আদর্শভিত্তিক কোন প্রকার রাজনীতি নেই। কেউ সেইসব প্রতিষ্ঠানে রাজনীতি খোলার জন্য চাপও দিচ্ছে না। আবার পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় যাদবপুর ইউনিভার্সিটি আছে। সেটি আমাদের বুয়েটের মত একটি ইঞ্জিনীরিং ইউনিভার্সিটি। সেখানে রাজনীতি আছে বলে আইআইটিগুলোর ধারে কাছে নাই। বরং রাজনীতি আছে বলে আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েটের মতোই।
আমাদের ক্ষমতাসীন দল কেন ছাত্র রাজনীতি চায়? তারা ছাত্রদের দিয়ে কেমন রাজনীতি করায়? এইগুলো বুঝতে হবে। এরা রাজনীতি চায় কারণ কোন প্রকার অর্থ ব্যয় না করে বিনা পুঁজিতে লক্ষ লক্ষ কর্মী পায় যারা তাদের গদি ঠিক রাখতে জীবন দিবে। কতটা স্বার্থপর আমাদের রাজনীতিবিদরা কল্পনা করা যায়? কেবল এদের নিজের হীন স্বার্থে ছাত্র রাজনীতির প্রসার চায়। একই কারণে এরা জেলায় জেলায় পারলে থানায় থানায় বিশ্ববিদ্যালয় খুলতে চায়। যত বেশি বিশ্ববিদ্যালয় ততবেশি ছাত্র তাদের দল করবে। অন্যদের রাজনীতি থামিয়ে দিবে। মারামারি আর দখদারিত্ব করে সবকিছু নিয়ন্ত্রণে রাখবে। কেউ সরকারের বিরুদ্ধে কোন বিষয়ে প্রতিবাদ করতে গেলে মেরেমুরে থামিয়ে দিবে। এমন স্বার্থপর রাজনৈতিক দল পৃথিবীর কোন সভ্য দেশে আছে?
গতবছর সরকার বাজেটে শিক্ষায় বরাদ্দ কমিয়ে জিডিপির মাত্র আবার বলি মাত্র ১.৭৬% বরাদ্দ দিয়েছিল। আমি তারপরদিন সংবাদপত্রে পড়েছি যে ওই বাজেট দেওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ আনন্দ মিছিল করেছে। এইটা কি কল্পনা করা যায়? আমরা দেখি এবং জানি আমাদের ছাত্ররা আবাসিক হলগুলোতে কত অমানবিকভাবে থাকে। কোথায় ছাত্রনেতাদের আন্দোলন করা উচিত জিডিপির অন্তত ৫.৫% শিক্ষায় বরাদ্দ দেওয়ার দাবিতে। আর এরা বরাদ্দ কমানোর পরেও আনন্দ মিছিল করে। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা লেখাপড়ার জন্য একটা টেবিল পায় না, একটা ঘুমানোর বিছানা পায় না, পুষ্টিকর খাবার পায় না এইসব নিয়ে কোন দাবি নেই। তাহলে কিসের ছাত্র রাজনীতি?
একটি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ছাত্র রাজনীতি চাচ্ছে না। গতকালকের একটি ওপেন অনলাইন পোল দেখলাম সেখানে ৪০৪২ ভোটের মধ্যে ৯৯%ই ছাত্র রাজনীতি চায় না। বুয়েটে যদি তাদের সকল ছাত্রের মতামত নেওয়া হয় আমি নিশ্চিত সেখানকার কম করে হলেও ৯০% এর বেশি ছাত্রছাত্রী বলবে তারা ছাত্র রাজনীতি চায় না। আমি বর্তমান বুয়েটের অনেক ছাত্র শিক্ষকের সাথে কথা বলেছি। তাদের সবাই বলেছে গত কয়েকটা বছর দারুন কেটেছে। কোন সন্ত্রাস নাই, কোন প্রকার ঝামেলা নাই সব কিছু অসাধারণ সুন্দর পরিবেশে চলছে। আমরা কি অন্ধ? আমরা কি খারাপ যে নিজের স্বার্থের কারণে সমষ্টির ভালো হতে দিব না? বুয়েট আমাদের আইআইটি। বরং আমাদের অন্যান্য যেই সাইন্স ্ টেকনোলজি বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা কুয়েট, রুয়েট, চুয়েটকেও কিভাবে প্রথমে বুয়েট পরে আইআইটির মত করা যায় সেইদিকে দৃষ্টি দেওয়া উচিত।
গতকাল দেখলাম ক্ষমতাসীন দলের বড় বড় নেতা থেকে শুরু করে অনেকেই বুয়েটকে গালমন্দ করছেন। বলছেন এরা বিদেশে চলে যায়, দেশের সার্ভিস দেয় না। দেশকে কি সেইভাবে গড়ে তুলেছেন? আমাদের মেধাবীরা উচ্চ শিক্ষা শেষে যদি ফিরে আসে তাদের চাকুরীর ব্যবস্থা করতে পারবেন? ভারততো বলে না সুন্দর পিছাই কেন আমেরিকায় চলে গেল? অতীশ ধাবলকর কেন বিদেশে চলে গেল? বিদেশে গিয়ে এরা আরও বড় আকারে দেশকে সার্ভ করছে। ইন্টেলের বড় পদে কয়েকজন বাংলাদেশী হওয়ায় এখন ইন্টেলে অনেক বাংলাদেশী চাকুরী পাচ্ছে। পৃথিবীর যেকোন বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলে প্রচুর চাইনিজ পাওয়া যায়। কারণ চাইনিজরা বড় পদে গেলে চাইনিজ নিয়োগ দেয়। বেশি বেশি রেমিটেন্স আসে। দেশের সুনাম বাড়ে। দেশের সুনাম একটি বিশাল জিনিস। এইটা কেবল একটি দেশের স্কলাররাই বাড়াতে পারে। তাই এখনো সময় আছে। বুয়েটকে বাঁচান। ছাত্র বা শিক্ষক রাজনীতি আমাদের কোন সমস্যার সমাধান না। বরং এই দুই রাজনীতি আমাদের শিক্ষাকে ধ্বংস করেছে, অনেকের মৃত্যুর কারণ হয়েছে, অনেককে টর্চারের কারণ হয়েছে। এইসবের মাধ্যমে আমরা কত মেধাবীর মেধা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছি কে জানে? তাই থামান প্লিজ। আপনারা যাকে ছাত্র রাজনীতি বলছেন সেটা আসলে ছাত্র রাজনীতি না। বুইড়াদের পিছে থেকে তোষামোদি শেখা। এতে বরং ছাত্রদের মেরুদন্ড ভেঙে যাচ্ছে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে ভুলে যাচ্ছে। লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক