ইউরিন ইনফেকশন সঠিক চিকিৎসা ও নিয়ম মেনে চললে নিরাময় সম্ভব : অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ
শাহীন খন্দকার : [১] বর্তমান সময়ে ইউরিন ইনফেকশন খুবই পরিচিত একটি রোগ। নারী বা পুরুষ উভয়ই এই রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। তবে সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা নিলে ও কিছু নিয়মকানুন মেনে চললে এই রোগ থেকে সহজেই নিরাময় পাওয়া সম্ভব। [২] ইউরিন ইনফেকশনের কারণ, লক্ষণ, প্রতিরোধ ও চিকিৎসা সম্পর্কে একুশে পদকপ্রাপ্ত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, আমাদের শরীরে থেকে বর্জ্য ও অতিরিক্ত পানি প্রস্রাব হিসেবে বেরিয়ে যায়। [৩] প্রস্রাব বেরিয়ে যাওয়ার এই ব্যবস্থা সঙ্গে সম্পর্কিত অঙ্গগুলো নিয়ে আমাদের মূত্রতন্ত্র গঠিত। মূত্রতন্ত্রের মধ্যে থাকে ২টি কিডনি, ২টি ইউরেটার, একটি মূত্রথলি বা ব্লাডার ও একটি মূত্রনালি। ডা. আব্দুল্লাহ বলেন, মূত্রতন্ত্রের কোনো অংশে জীবাণুর সংক্রমণ হলে সেটিকে ইউরিন ইনফেকশন বা প্রস্রাবের সংক্রমণ বলে।
[৪] ডাক্তারি ভাষায় একে ইউরিনারি ট্র?্যাক ইনফেকশন বা ইউটিআই বলা হয়। ইউরিন ইনফেকশনের অনেকগুলো লক্ষণের মধ্যে পরিচিত কিছু লক্ষণ আছে। সেগুলো হলো- প্রস্রাবের সময় ব্যথা বা জ্বালাপোড়া হওয়া, স্বাভাবিকের চেয়ে ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া এবং রাতে বার বার প্রস্রাবের বেগ হওয়াসহ অস্বাভাবিক গন্ধযুক্ত বা ঘোলাটে প্রস্রাব হওয়া।
[৫] তিনি বলেন, হঠাৎ প্রস্রাবের বেগ হওয়া বা বেগ ধরে রাখতে কষ্ট হওয়া, তলপেটে ব্যাথা হওয়া এমনকি প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত যাওয়া। সেইসঙ্গে কোমরের পেছনে পাঁজরের ঠিক নিচের অংশে ব্যাথা হওয়া, জ্বর আসা কিংবা গরম লাগা বা শরীরে কাঁপুনি লাগা, শরীরে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে কমে যাওয়া, ক্লান্তি ও বমি বমি লাগা অন্যতম।
[৬] ইউরিন ইনফেকশনের কারণ, সাধারণত পায়খানায় থাকা বিভিন্ন জীবাণু মূত্রতন্ত্রে প্রবেশ করে ইউরিন ইনফেকশন ঘটায়। প্রস্রাবের রাস্তা বা মূত্রনালী দিয়ে এসব জীবাণু মূত্রতন্ত্রে প্রবেশ করে। নারী-পুরুষভেদে সবারই প্রস্রাবের ইনফেকশন হতে পারে। তবে নারীদের মধ্যে এই রোগের সংক্রমণের হওয়ার প্রবণতা বেশি। এর কারণ হলো, নারীদের মূত্রনালী আর পুরুষদের মূত্রনালীর তুলনায় দৈর্ঘ্যে অনেক ছোট। [৭] এ ছাড়া নারীদের মূত্রনালী পায়ুপথের খুব কাছাকাছি অবস্থিত। ফলে ব্যাকটেরিয়া পায়ুপথ থেকে মূত্রনালীতে প্রবেশ করে প্রস্রাবের সংক্রমন ঘটানোর আশঙ্কা বেশী। পর্যাপ্ত পানি পান না করলে মূত্রতন্ত্রের স্বাভাবিক প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে এমন রোগ হলে। যেমন- কিডনিতে পাথর হওয়া, যৌনাঙ্গ পরিষ্কার ও শুকনো না রাখলে। যেকোনো কারণে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে। [৮] ইউরিন ইনফেকশন প্রতিরোধে করণীয় সর্ম্পকে তিনি আরও বলেন, প্রস্রাবের ইনফেকশন সবসময় প্রতিরোধ করা সম্ভব না হলেও কিছু নিয়ম মেনে চললে ইনফেকশন হওয়ার প্রবণতা কমিয়ে আনা যায়। যা করবেন, টয়লেটে টিস্যু ব্যবহারের সময়ে সামনে থেকে পেছনে পরিষ্কার করুন। যৌনাঙ্গ শুকনো ও পরিষ্কার রাখুন।
[৯] প্রচুর পানি পান করুন। দৈনিক কমপক্ষে ৬ থেকে ৮ গ্লাস পানি পান করা উচিত। বাথটাব বা পুকুরে গোসল করার পরিবর্তে শাওয়ার কিংবা বালতির সাহায্যে গোসল করুন। প্রস্রাব করার সময়ে মূত্রথলি সম্পূর্ণ খালি করার চেষ্টা করুন। সহবাসের আগে ও পরে যৌনাঙ্গ পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন এবং সহবাসের পরে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রস্রাব করুন। সুতি কাপড়ের ঢিলেঢালা অন্তর্বাস ব্যবহার করুন।
[১০] শিশুদেরে ক্ষেত্রে ১ থেকে ৩ বছর বয়সী বাচ্চার ডায়পার বা কাপড়ের ন্যাপি নিয়মিত পরিবর্তন করুন। যৌনাঙ্গে সুগন্ধি সাবান অথবা ট্যালকম পাউডার ব্যবহার করবেন না। আঁটসাঁট পায়জামা পরবেন না। ইউরিন ইনফেকশনের চিকিৎসা সর্ম্পকে বলেন, ইউরিন ইনফেকশনের লক্ষণ দেখা দিলে সেগুলো উপেক্ষা না করে একজন ডাক্তারের পরামর্শ নিন। ডাক্তার প্রস্রাব পরীক্ষা করানোর পাশাপাশি প্রয়োজনবোধে উপযুক্ত অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের পরামর্শ দিতে পারেন। অ্যান্টিবায়োটিকের সম্পূর্ণ কোর্স শেষ করা গুরুত্বপূর্ণ।
[১১] লক্ষণগুলো কমে আসতে শুরু করলেও প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ওষুধের কোর্স সম্পন্ন করতে হবে। সাধারণত ওষুধ খাওয়া শুরু করার ২-৩ দিনের মধ্যে লক্ষণগুলো কমতে শুরু করে। যদি ওষুধের কোর্স সম্পন্ন করার পরেও লক্ষণের উন্নতি না হয় তাহলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
[১২] ডা. আব্দুল্লাহ বলেন, একজন সুস্থ পূর্ণবয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রে মুত্রাশয় দুইশত মিলিলিটার পরিমাণ মুত্র জমা হলেই মুত্র বা প্রস্রাব ত্যাগের প্রয়োজন অনুভূত হয়। সুস্থ অবস্থায় মূত্রাশয় তিনশত ৫০ থেকে ৫শত ৫০ মিলিমিটার মূত্র ধরে রাখতে সক্ষম। তবে দীর্ঘ সময় ধরে প্রস্রাব ধরে রাখা শরীরের পক্ষে মোটেই ভালো নয়। দীর্ঘদিন এ ভাবে প্রস্রাব ধরে রাখলে দেখা দিতে পারে একাধিক সমস্যা।
[১৩] দীর্ঘ সময় ধরে প্রস্রাব আটকে রাখলে মুত্রনালীর সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যায়। মূত্রনালীতে উপস্থিত কিছু ব্যাক্টেরিয়া প্রস্রাবের মাধ্যমে দেহের বাইরে বেরিয়ে যায়। কিন্তু যখন দীর্ঘ সময় মুত্রথলিতে প্রস্রাব আটকে থাকে তখন ব্যাক্টেরিয়ার দ্রুত বংশবৃদ্ধি ঘটতে পারে। কাজেই কিডনি ভালো রাখতে যেমন পর্যাপ্ত পানি পান করা জরুরি তেমনই প্রয়োজন সময় মতো প্রস্রাব বা মূত্র ত্যাগ করা উচিত।