ট্রাফিক জ্যামে দিনে ১৪০ কোটি টাকার কর্মঘন্টা নষ্ট : ডিসিসিআই
এস.ইসলাম জয় : [১] ঢাকা চেম্বার সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেন, রাজধানীর ঢাকার যানজটের কারণে দেশের সামগ্রিক জিডিপি প্রায় ২.৯ শতাংশ হ্রাস পায় এবং প্রতিদিন ট্রাফিক জ্যামের কারণে নষ্ট হয়ে যাওয়া কর্মঘন্টার আর্থিক মূল্য প্রায় ১৪০ কোটি টাকা।
[২] গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর ডিসিসিআই অডিটোরিয়ামে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি আয়োজিত পুরোনো ঢাকার ব্যবসা-বাণিজ্যে যানজটের প্রভাব ও উত্তরণের উপায় চিহ্নিতকরণ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় এ তথ্য প্রকাশ করা হয়।
[৩] তিনি বলেন, দেশের জিডিপিতে পুরোনো ঢাকার অবদান প্রায় ২০ শতাংশ হলে, অপর্যাপ্ত অবকাঠমো, যানজট ও অপ্রতুল পরিসেবার জন্য এ এলাকার ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনায় নানাবিধ চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে হচ্ছে। সড়কের খোড়াখুড়ি, অবৈধ ফুটপাত দখল, অপরিকল্পিত গাড়ি পার্কিং, অপ্রতুল সড়ক অবকাঠামো ও অকার্যকর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার কারণে বিশেষকরে পুরোনো ঢাকায় সৃষ্ট সহনীয় যানজট লেগে থাকে। ব্যবসা পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এ হতে উত্তরণে স্মার্ট ট্রাফিক সিস্টেম চালুকরণ, নদীপথের ব্যবহার বাড়ানো এবং পুরোনো ঢাকার প্রধান সরু ও ব্যস্ত সড়কে একমুখী ট্রাফিক ব্যবস্থা চালুকরণের প্রস্তাব করেন ডিসিসিআই সভাপতি। [৪] যানজটের কারণে পুরোনো ঢাকার অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক গুরুত্ব প্রতিনিয়ত হ্রাস পাচ্ছে বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন ডিসিসিআই সভাপতি আশরাফ আহমেদ। বিদ্যমান অবস্থা উত্তরণে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার কার্যকর ব্যবহার, পার্কিং সুবিধানিশ্চিতকরণ, ফুটপাত অবৈধ দখলদার মুক্ত করা, ওয়ান-ওয়ের পাশাপাশি আধুনিক গণপরিবহন ব্যবস্থা চালুকরা, সুনিদিষ্ট সময়ের মধ্যে পণ্যপরিবহন নিশ্চিতকরণ এবং সর্বোপরি গৃহীত উদ্যোগ বাস্তবায়নে রাজনৈতিক স্বদিচ্ছা একান্ত অপরিহার্য বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।
[৫] ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, ঢাকার অপরিকল্পিত নগারয়নের জন্য আমরা নিজেরাই দায়ী, আমরাই এটা সৃষ্টি করেছি। নগরের অভিবাবক হিসেবে সিটি কর্পোরেশন নগরের পরিকল্পনা গ্রহণ করবে। সেমতে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন ইতোমধ্যে নানাবিধ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে বলে তিনি অভহিত করেন।
[৬] তিনি জানান, কোন ধরনের কর বৃদ্ধি ছাড়াই সুশাসন নিশ্চিতকরার মাধ্যমে ২০২৩ সালে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন ১ হাজার ৩১ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করেছিল, ২০২০ সালে যার পরিমাণ ছিল ৫১২ কোটি টাকা। নগরের জলব্ধতার বিষয়টিকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি বেশকিছু খাল দখলমুক্ত করা হয়েছে, যার মাধ্যমে সামনের দিনগুলোতে এ সমস্যা কিছুটা হলেও লাঘব হবে। [৭] মেয়র জানান, বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত কেরানীগঞ্জে নতুন বাণিজ্যিক নগরী গড়ে তোলা হবে। সেইসঙ্গে চকবাজার ও মতিঝিলকে পুনরুজ্জীবিতকরণে উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। সায়াদাবাদ বাস টার্মিনালকে আধুনিক সুবিধায় রপ্তান্তরিত করা হয়েছে। এটার উদ্বোধনের পর আর কেউ টার্মিনালের বাইরে বাস কাউন্টার স্থাপন করতে পারবে না। দোকানের সামনের হকারদের বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে না দেওয়ার জন্য ব্যবসায়ীদের প্রতি আহ্বান জানান দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র।
[৮] তিনি আরো বলেন, রাজধানীতে যানজট নিরসন ও ট্রাফিক আইন অমান্যকারীদের সনাক্তকরণে ৬৪টি ইন্টারসেকশনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (আইওটি) প্রযুক্তি স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ঢাকার ফুটপাত ও রাস্তা হতে হকারদের উচ্ছেদের বিষয়ট এত সহজ নয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন ৮টি স্থানকে হলুদ ও সবুজ জোন হিসেবে চিহ্নিত করেছে, যেখানে হকাররা তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য চালাতে পারবে। তবে সিটি কর্পোরেশনের চিহ্নিত লাল জোনে কেউ দোকান বসাতে পারবে না।
[৯] ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)’র অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মুনিবুর রহমান বলেন, ঢাকা শহরে ব্যবহার যোগ্য রাস্তার পরিমাণ মাত্র ৫ শতাংশ, ফলে আমাদের রাস্তার উপর গণমানুষ ও পরিবহনের চাপ অত্যাধিক। চকবাজার, মৌলভীবাজার, ছোট কাটরা ও বড়কাটরা, পাটুয়াটুলিসহ অন্যান্য এলাকায় যানজট নিরসনে ট্রাফিক পুলিশ নিয়োগে দ্রুত উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।
[১০] তিনি বলেন, তাছাড়া উক্ত এলাকায় পাইকারীবাজার সমূহে পার্কিং সুবিধা না থাকার যানজট লেগে থাকে এবং গুলিস্তানে আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল সরিয়ে নেওয়া গেলে যানজট আরো কমবে তিনি মত প্রকাশ করেন। সেইসঙ্গে হকারদের জন্য সুনির্দিষ্ট সময় দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে যানজট হ্রাস পাবে। তিনি পুরোনো ঢাকার বিভিন্ন স্থানে স্কাইওয়াক স্থাপন ও স্মার্ট পার্কিং চালুকরনের প্রস্তাব করেন। ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার সাথে ১৮টি স্টেকহোল্ডার রয়েছে। সকলের মধ্যকার সমন্বয় বাড়ানো গেলে যানজট আরো কমনো সম্ভব হবে।
[১১] ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের নির্বাহী পরিচালক নীলিমা আখতার বলেন, পুরোনো ঢাকার যানজটের নিরসনে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থার অংশগ্রহণে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করতে হবে। এছাড়াও এলাকায় গাড়ি পার্কিং, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, গণপরিবহন ও পণ্যপরিবহন ব্যবস্থার বিদ্যমান অবস্থা উত্তরণে বিশেষায়িত ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন।
[১২] নির্ধারিত আলোচনায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের সিইও মো. মিজানুর রহমান, যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ড. এসএম সালেহ উদ্দিন, ঢাক ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানী লিমিটেডর পরিচালক মো. আব্দুল বাকী মিয়া প্রমুখ অংশগ্রহণ করেন।
[১৩] অনুষ্ঠানের মুক্ত আলোচনায় ডিসিসিআই সাবেক ঊর্ধ্বতন সহ-সভাপতি আলহাজ্ব আব্দুস সালাম, বাংলাদেশ চিনি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আবুল হাসেম, বাংলাদেশ ইলেকট্রিক্যাল এসোসিয়েশনের সভাপতি আলীমুজ্জামান আলম, বাংলাদেশ গ্লাস মার্চেন্ট এসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ হোসেন আলমগীর, বাংলাদেশ পাইকারী ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ গোলাম মওলা, এফবিসিসিআই’র পরিচালক হাফেজ হারুন, ডিসিসিআই’র প্রাক্তন পরিচালক আলহাজ্ব মোহাম্মদ শরফুদ্দিন এবং বাংলাদেশ ব্রেড বিস্কুট কনফেকশনারী প্রস্তুতকারক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন অংশগ্রহণ করেন।
[১৪] আলোচকরা চকবাজারের যানজট নিরসনে কমিউনিটি পুলিশের পাশাপাশি ট্রাফিক পুলিশ নিয়োগ, অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে সরকারের রাজস্ব আহরণ বাড়ানো, পুরোনো জেলখানায় গাড়ি পার্কিং ব্যবস্থা চালুকরণ, পুরোনো ঢাকা হতে অন্যান্য স্থানে যাওয়ার জন্য মেট্রোরেল সেবা চালু, ব্যস্ততম সড়কসমূহে ওয়ান-ওয়ে ব্যবস্থা চালু, দিনের বেলায় পুরোনো ঢাকায় কাভার্ড ভ্যানগুলোর চলাচল বন্ধ, বিশেষ করে লক্ষীবাজার ও নবাবপুর সহ অন্যান্য এলাকার ফুটপাত হতে দোকান উচ্ছেদ। ধোলাইখালের ট্রাক স্ট্যান্ড অন্যত্র স্থানান্তরের উপর জোরারোপ করেন।
[১৫] ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। এছাড়াও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)-এর অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মুনিবুর রহমান এবং ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের নির্বাহী পরিচালক মিসেস নীলিমা আখতার-এ মতবিনিময় সভায় সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
[১৬] ডিসিসিআই ঊর্ধ্বতন সহ-সভাপতি মালিক তালহা ইসমাইল বারী এবং পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরাসহ পুরোনো ঢাকার বিশেষায়িত সমিতির প্রতিনিধিরা প্রমুখ এ সময় উপস্থিত ছিলেন।