আমাদের যৌথতার ‘ভালোবাসা-মমতায়’ ভরা সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে সবাই কেন পশ্চিমের ‘আবেগহীন’ ব্যক্তিস্বার্থকেন্দ্রিক সমাজে চলে যেতে চায়?
গালিব ইবনে আনোয়ারুল আজিম
আমজনতা বাংলাদেশিদের মনে শক্তিশালী ধারণা রয়েছে যে, বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ সমাজই বেশ যৌথতার বা কালেক্টিভ চেতনা ধারণ ও লালন করে। সে তুলনায় পাশ্চাত্যের পশ্চিম ইউরোপীয় ও নর্থ আমেরিকান সমাজ একেবারে বিপরীত প্রান্তে। তারা খুবই ব্যক্তিকেন্দ্রিক, নিজ নিজ স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত, সমাজে অপর মানুষের দিকে মনোযোগ নেই ইত্যাদি এসব ধারণাকে যাচাই-বাছাই করতে গেলে আগে স্থির করে নিতে হবে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা বনাম যৌথতার সংজ্ঞা ও প্রকরণ কোন ক্ষেত্রে কীভাবে সংজ্ঞায়িত ও চিহ্নিত করছেন। এক্ষেত্রে বাংলাদেশিদের গড় আলাপে যেসব উদাহরণ সচরাচর পাবেন। পশ্চিমারা পাশের বাড়ির প্রতিবেশীদের সঙ্গে মেলামেশা করে না [মূলত ভাবি আজকে কি রাঁধছেন ও জানেন অমুক বাসায় কী হয়েছে?], এলাকার মোড়ে চায়ের টং দোকানে আড্ডা ইত্যাদি করে না। ১৮ বছরের পর ছেলেমেয়ে নিজের রাস্তা দেখে, বছরে একবার ক্রিসমাসে বাপ-মাকে কার্ড পাঠায়, নিজের মতো স্বাধীন জীবন খুঁজে নেয়। আত্মীয়-স্বজনের নিয়মিত মোলাকাত নেই, সামাজিক মেলামেশা নেই ইত্যাদি।
তারা কেবল কাজ আর উপভোগের পেছনে ছোটে, অতিমাত্রায় ব্যস্ত জীবন, ফলে তারা ডিপ্রেসড, আত্মহত্যা বাড়ছে, নেশায় আসক্ত হচ্ছে ইত্যাদি। আমাদের সমাজেও তাদের অনুসরণ করতে গিয়ে আমরা ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছি ইত্যাদি। এসব আলাপের অধিকাংশই নিম্নমানের যুক্তি, এর প্রচুর বিপরীত আর্গুমেন্ট ও উদাহরণ পশ্চিমের সমাজগুলোতে আছে। ইউরোপ ও আমেরিকার বিশাল অঞ্চলজুড়ে বহুবৈচিত্র্যের সমাজ ও মানুষের একমুখী সরলীকরণ তারাই করে যারা এসব সমাজকে কাছে থেকে মনোযোগ দিয়ে দেখেনি [অনেক প্রবাসী সারা জীবন পশ্চিমে কাটিয়েও যে সমাজে বাস করেন তাকে বুঝতে পারেন না]।
তবে এসব আলাপের খন্ডন আমার আজকের প্রসঙ্গ নয়। আমার মনে উদিত প্রশ্ন [যার মীমাংসা আমার কাছে নেই]Ñ এত ব্যক্তিস্বার্থ কেন্দ্রিক পশ্চিমের সমাজে গণতন্ত্র [যা অনেক ক্ষেত্রেই মূলত কালেক্টিভ ইন্টারেস্ট এর চর্চা] কীভাবে সুন্দরভাবে ফাংশন করে? আর দক্ষিণ এশিয়ায় আমরা কেন এতো যৌথতার দাবিদার হয়েও ‘কালেক্টিভ ইন্সটিটিউশন’ কোনোটাই কেন ঠিকমতো চালাতে পারি না? সম্পূরক প্রশ্ন- এতো ব্যক্তিস্বার্থ কেন্দ্রিক পশ্চিমের সমাজে সোশ্যাল ওয়েলফেয়ারের নানা পলিসি ও স্কিম কীভাবে মোটামুটি সফল হয়েছে? বিপরীতে পশ্চিমের কাছেই এসব সোশ্যাল ওয়েলফেয়ারের প্রচেষ্টা থেকে শিখে আমাদের ‘যৌথতার কল্যাণকামী’ সমাজে আমরা কেন একই ধরনের স্কিমগুলো ঠিকঠাক চালাতে পারি না? সেখান থেকে পুকুরচুরি করি? আরেকটা সম্পূরক প্রশ্ন, আমাদের যৌথতার ‘ভালোবাসা মমতায়’ ভরা সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে সবাই কেন পশ্চিমের ‘আবেগহীন’ ব্যক্তিস্বার্থকেন্দ্রিক’ সমাজে চলে যেতে চায়? যে চলে যাওয়ার দৌড়ে এগিয়ে থাকি আমরা দেশের শিক্ষিত, প্রিভিলেজড, ক্ষমতাবান শ্রেণি। দেশের সবচেয়ে সফল পেশাজীবী, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদদের ছেলে-মেয়েদের অধিকাংশই কেন দেশে থাকতে ও ফিরতে চায় না? এসব প্রশ্নের বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ ও উত্তর হতে পারে।
তা নিয়ে আপনারা ভাবুন। আমি শুধু পশ্চিমের দুটি দেশে [ইংল্যন্ড ও কানাডায়] আমার বসবাসের অভিজ্ঞতার এনেকডোটাল কিছু উদাহরণ বলবো। এ দুই রাষ্ট্রে বসবাসের অভিজ্ঞতায় আমার পর্যবেক্ষণ- ওখানে মানুষ ব্যক্তিগত জীবনে নাক গলানো [আপনি কী পরছেন আর কার সঙ্গে শুয়ে আছেন] সংক্রান্ত বিষয়ে পাশ ফিরেও তাকায় না, প্রাইভেসির এইটুকু পরিমিতিবোধ তারা অর্জন করেছে। কিন্ত যা পাবলিক গুড, যা কিছু কালেক্টিভ- তার নিজ এলাকায়, পাড়ায়-মহল্লায়, সমাজে, রাষ্ট্রে, সেসব বিষয়ে সে সদা সতর্ক। তারা নিজেদের সমাজ ও রাষ্ট্রকে ওউন করে। কারণ তারা জানে যে তাদের পালিয়ে আর অন্য কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই তেমন [বাংলাদেশিরা যেমন দেশে ঘুষ খেয়ে কানাডা চলে যেতে পারবে পশ্চিমের বাসিন্দারা তো আর তেমন করে ঢাকায় চলে আসতে পারবে না]।
সাসেক্সে পড়ার সময় একটা এসাইনমেন্ট করতে ব্রাইটনের একটা লোকাল কমিউনিটি প্রজেক্ট দেখতে গিয়েছিলেম কয়েকদিন। শহরের বাইরের দিকে একটা পার্কের পাশে কিছু পাবলিক ল্যান্ড, কিছু স্থানীয় ভলান্টিয়ার গ্রুপকে দেওয়া হয়েছে। তাদের সদস্যরা বার্ষিক ফি দিয়ে ওখানে সবজি-ফল এসব চাষ করে। লাভজনক কিছু না তেমন, শখের বশে সামারে তাদের সদস্যরা ছেলে-মেয়ে নিয়ে আসে, সারাদিন কাজ করে। যা ফলে তা সবাইকে সপ্তাহ শেষে সমান ভাগ করে দেওয়া হয়। শিশুরা আনন্দ পায়, মাঠে কাজ করার অভিজ্ঞতা হয়, অনেকটা ফার্মিং পিকনিক। কিছু বছর আগে মিউনিসিপালিটি চিন্তা করছিলো যে রেভিনিউ বাড়ানোর জন্য এসব জায়গা অন্য কাজে ভাড়া দেওয়া যায় কিনা। কমিউনিটি এমন শোরগোল তুলেছিল যে নেতারা ভয়ে পিছু হটেছে। ব্রাইটনে আমার বাসার পাশেই ছিলো লন্ডন রোড স্টেশন। উনিশ শতকের ছোট্ট স্টেশন, এখন কেবল ট্রেন থামে, টিকেট ঘরও বন্ধ মেশিন চালুর পর থেকে। কোনো স্টাফ সারাদিন থাকে না। স্টেশনের দুই পাশে ছোট্ট কিছু জায়গা, তা ওই মহল্লার লোকজনরা নিয়ে রেখেছে, ওখানে সামারে গার্ডেন করে। সরকার খরচ কমাতে যেখানে স্টাফ রাখা বন্ধ করে দিয়েছে এমন একটি ছোট্ট স্টেশনের বাইরের আঙ্গিনার বাগানটির ওউনারশিপ নিয়েছে স্থানীয় বাসিন্দারা। এটা একটা উদাহরণ কালেক্টিভ কমিউনিটি ওউনারশিপের। কানাডাতে মাঝেমধ্যেই দেখি নদীতীর এর উন্নয়ন প্রকল্প, কিংবা এলাকার পার্ক নতুন করে সাজানোর জন্য সিটি কাউন্সিলের লিফলেট বাসায় আসে। আলোচনা হবে স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে। তারা চায় কি না।
এডমন্টনে এমন অনেক পরিকল্পনা থেকে মিউনিসিপ্যালিটিকে পিছু হটতে হয়েছে কারণ বাসিন্দারা ভেটো দিয়েছে। এমন কমিউনিটি সভায় নেতারা জনবিরোধী প্রস্তাব নিয়ে আসলে তাদের এমন তীব্র আক্রমণ ও লজ্জার মুখে পড়তে হয় যে যেকোন প্রস্তাব আনার আগে তারা বুঝেশুনে নেয় পাবলিক পালস কেমন। এই সেন্স অব ওউনারশিপ অন পাবলিক গুড পশ্চিমের সমাজে প্রবল। তারা প্রতিদিন এর চর্চা করে। পাবলিক গুডের পাবলিক ম্যানেজমেন্টই গণতন্ত্রের দৈনন্দিন রুটিন কাজ। একে প্রতিদিন নজরদারিতে রাখতে হয়, সরকারকে চাপের মুখে রাখতে হয়। বিপরীতে বাংলাদেশের সমাজে প্রবল ‘সেন্স অব কালেক্টিভ ওউনারশিপ অন প্রাইভেট লাইফস্টাইল’।
আর এর সমান্তরালে প্রবল ‘পাবলিক গুড’কে ‘প্রাইভেট এসেট’ এ রূপান্তরের চেষ্টা। স্যাম্পল হিসেবে ভেবে দেখেন ফেসবুকেই মেয়েদের কাপড় পরা আর অমুকের বিয়ে তমুকের ডিভোর্স নিয়ে যে পরিমাণ বিতর্ক হয়েছে গত এক বছরে, তার কতটা হয়েছে আপনার এলাকার নদী-খাল-বিল নিয়ে, পার্ক নিয়ে, ফুটপাত নিয়ে। তাহলেই স্পষ্ট ধারণা পাবেন- বাংলাদেশের মানুষের ‘সেন্স অব কালেক্টিভ ওউনারশিপ অব পাবলিক গুড’ এর ব্যাপারে। নিরাপত্তা- সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, পথে চলতে চলতে ম্যানহোলে পড়ে না যাওয়ার কিংবা মাথায় ইট পড়ে মরে না যাওয়ার বা ফায়ার সেইফটির- সবই পাবলিক গুড। পাবলিক গুড সোচ্চার হয়ে চাইতে হয়, কালেক্টিভ ওউনারশিপ নিয়ে একে প্রতিদিন নজরদারিতে রাখতে হয়, যারা এর লংঘন করে তাদের সামাজিক লজ্জায় ফেলতে হয়, যাতে অন্য কেউ এমন সাহস না করে। ‘যৌথতার’ দাবিদার বাংলাদেশের সমাজ ‘পাবলিক গুড’ এর ওউনারশিপ ক্লেইম করতে, রক্ষা করতে, নজরদারিতে রাখতে ব্যর্থ। তাই আমার, আপনার পরিবার এখানে অনিরাপদ। এখন ভেবে দেখেন কী করবেন। ফেসবুক থেকে