ঋণ চক্র থেকে রক্ষা পেতে হলে রাজস্ব আয় বাড়ানোর বিকল্প নেই
এবি সিদ্দিক
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত বিদেশি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল ৯৯ বিলিয়ন ডলার যা ইতোমধ্যে ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়ালো। ২০০৯ সালের পর থেকে গত ১৪ বছরে বৈদেশিক ঋণ ৩২২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। আর গত তিন বছরে বৃদ্ধি পায় ৩৩.৬ শতাংশ। অপরদিকে সরকারি তথ্য অনুযায়ী, লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে রাজস্ব আয় না হওয়ার কারণে সরকারের আয় কমে গেছে। আর অর্থ সংকটের কারণে সবশেষ সার ও বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকির অর্থ পরিশোধের জন্য বিশেষ ধরনের বন্ড ছাড়ার মতো পদক্ষেপ নিতে হয়েছে, এটিও এক ধরনের অভ্যন্তরীণ ঋণ। চলতি অর্থবছর অর্থাৎ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পাঁচ লাখ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে সরকার। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সংগ্রহ করবে চার লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। আর বাকি অর্থ অন্য উৎস থেকে সংগ্রহ করার কথা রয়েছে। কিন্তু‘ রাজস্ব ঘাটতি বড় হয়েই দেখা দিচ্ছে। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রার মাত্র সাড়ে ৩৮ শতাংশ রাজস্ব আদায় হয়েছে। অন্যদিকে অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে ‘এনবিআর’ রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্য দেওয়া হয়েছে, তার চেয়ে ২৩ হাজার ২২৭ কোটি টাকা কম আদায় করতে পেরেছে এনবিআর।
প্রতিবছরের মতো এবারও অর্থবছরের শুরু থেকেই লক্ষ্য অর্জনে পিছিয়ে পড়েছে এনবিআর। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ‘আইএমএফ’ দেওয়া ঋণের শর্ত হিসেবে এবার বাড়তি রাজস্ব আদায়ের শর্তও পূরণ করতে হবে এনবিআরকে। আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী, রাজস্ব খাতে সংস্কারের পাশাপাশি প্রতিবছর মোট দেশজ উৎপাদনের ‘জিডিপি’ দশমিক ৫ শতাংশ হারে বেশি রাজস্ব আদায় করতে হবে। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে তিন লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু‘ এ অর্থবছরে সব মিলিয়ে তিন লাখ ২৫ হাজার ২৭২ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করা হয়। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা কম রাজস্ব আদায় হয়েছিল। রাজস্ব প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৮.১২ শতাংশ। যাকে গত এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন প্রবৃদ্ধি বলে ধরা হচ্ছে। সে অর্থবছরে ভ্যাট খাতে এক লাখ ৩৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকা আয় করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু আয় হয়েছিল এক লাখ ২০ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকার মতো ঘাটতি ছিল। ২০২১-২২ অর্থবছরে রাজস্ব আয় হয়েছিল সব মিলিয়ে তিন লাখ ২ হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশ সরকার দেশি-বিদেশি ঋণ গ্রহণ করেই চলছে। বাংলাদেশ সাধারণত বিশ্ব ব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এবং বিদেশি বাণিজ্য ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে ঋণ নিয়ে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড এক্সটারনাল ডেট জানুয়ারি-জুন ২০২৩ নামে প্রকাশিত সবশেষ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৮.৯৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এরমধ্যে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের পরিমাণ ৮২.৯০ বিলিয়ন ডলার। আর স্বল্পমেয়াদী ঋণ ১৬.০৩ বিলিয়ন ডলার। ২০২২ সালের জুনের তুলনায় ২০২৩ সালের জুনে মোট বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ৩.৬৫ শতাংশ বেড়েছে। গত বছরের জুন পর্যন্ত সরকারি খাতে ঋণের পরিমাণ ছিল মোট ঋণের ৭৬.৬৮ শতাংশ। এ খাতে সবচেয়ে বেশি ঋণ নিয়েছে সরকার [৬৪.৫৭ বিলিয়ন ডলার]। এর পরেই আছে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান [৭ বিলিয়ন ডলার], কেন্দ্রীয় ব্যাংক [৪.৪৬ বিলিয়ন ডলার] এবং এনসিবি ব্যাংক [০.৬৫ বিলিয়ন ডলার]। আর বেসরকারি খাতে ঋণের পরিমাণ ২২.২৬ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের এ সময়ের তুলনায় এ খাতে ঋণের পরিমাণ ১৪.২৩ শতাংশ বেড়েছে। বেসরকারি খাতে বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকগুলো স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে ঋণ নিয়েছে। ২০২৩ সালের জুন মাস পর্যন্ত মাথাপিছু বৈদেশিক ঋণ ছিল ৫৭৯.৩১ মার্কিন ডলার। গত বছরের অক্টোবরের শেষ দিনে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জানিয়েছিলেন, ২০২৩ সালের জুন মাস পর্যন্ত বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ৬২ হাজার ৩১২ দশমিক ৭১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। শুধু বৈদেশিক ঋণ নয়। অভ্যন্তরীণ নানা উৎসেও ঋণ রয়েছে বাংলাদেশ সরকারের। আন্তর্জাতিক মুদ্রা সংস্থা আইএমএফ এর তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছর শেষে বাংলাদেশে সরকারের ঋণের পরিমাণ ছিল ১৪৭.৮ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২৩ এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি ২০২৩ শেষে মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৭ লাখ ৮৭ হাজার ১৫৮ দশমিক ৬ কোটি টাকা।
এ ঋণ কি করে পরিশোধ করবে সরকার? ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে দুটি পথ আছে। রিজার্ভের অবস্থাও ভালো নয়। এছাড়া অভ্যন্তীণ সংকটতো আছেই। তবে ঋণের চাপ কমানোর উপায় আছে। সেটি হলো। আর সেটি হলো সরকারি আয় বাড়ানো। এ আয়ের মধ্যে রয়েছে কর থেকে আয় এবং কর বহির্ভূত আয়। এ আয় বাড়িয়ে ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে, নতুন ঋণ দিয়ে পুরনো ঋণকে পরিশোধ করা। একে ‘রিফাইনান্সিং’ বলা হয়। যেমন ১০০ টাকার একটি ঋণ যা আগামী বছর পরিশোধ করার কথা রয়েছে। তো আগামী বছর আবার আরেকটি ১০০ টাকার ঋণ নিয়ে আগেরটি পরিশোধ করা হলো। এতে নতুন ঋণটি পরের বছর পরিশোধ করতে হবে বিধায় কিছুটা অতিরিক্ত সময় পাওয়া গেলো। এ দুটি উপায় ছাড়া বাংলাদেশ সরকারের হাতে অন্যকোনো খোলা আছে বলে মনে হয় না।
রাজস্ব আয় যদি বাড়ানো সম্ভব না হয় তাহলে এর বিকল্প হতে পারে সরকারের ব্যয় কমানো। রেভিনিউ যদি না বাড়াতে পারে, তার খরচ যদি সে কমাতে পারে, তাহলে একই রেভিনিউ দিয়ে ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব। তবে এসব পদ্ধতির মধ্যে সবচেয়ে ভালো বিকল্প হিসেবে সরকারের আয় বাড়ানোর দিকেই নজর দেওয়া উচিত। নতুন ঋণ নিয়ে রিফাইনান্সিং তো বার বার করতে পারবেন না। আর রিফাইনান্সিং করে তো আপনি প্রবলেমটাকে পোস্টপোন করছেন, সলভ করছেন না। সরকারের ব্যয়কে যৌক্তিকীকরণ বা অপচয় কমানোর ওপরও জোর দিতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারের মেগা প্রকল্পসহ সব ধরনের উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় যাতে যৌক্তিক হয় তা পর্যবেক্ষণের করা সয়ম এসেছে। ঋণ নিয়ে অনুন্নয় খাতে ব্যয় করা এখন আর ঠিক হবে না। সরকার বিভিন্ন প্রকল্পে কেনাকাটার ক্ষেত্রে যে মূল্যে পণ্য ও সেবা কিনে থাকে তা বাজারমূল্যের সঙ্গে মেলালে সাদৃশ্য পাওয়া যায় না। দুর্নীতির কারণে সরকার অনেক অতিরিক্ত ব্যয় হয়। উন্নয়ন প্রকল্পে কস্ট ওভাররানের [ব্যয়ের মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়া] ইতিহাস তো নতুন কোনো ইতিহাস না। একটা ১০০ টাকার প্রজেক্ট বাস্তবায়ন শেষে দেখা যায় যে ৩০০, ৪০০ টাকা হয়ে গেছে। এখানে মিস প্রাইসিং ও ওভারপ্রাইসিং বড় বিষয়। এছাড়া সরকারি যেসব ব্যয় না করলে তেমন কোনো অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে না এমন ব্যয় কমানো যেতে পারে। সব কথার শেষ কথা হচ্ছে যে, সরকারের আয় অর্থাৎ রাজস্ব বাড়ানোর মাধ্যমেই ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। বিকল্প একটাই। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে হলে রাজস্ব বাড়াতে হবে। ধার করে বেশি দিন ঘি খাওয়া যায় না। বাংলাদেশের রাজস্ব না বাড়ার পেছনে দুর্নীতি, প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং প্রক্রিয়াগত জটিলতা রয়েছে। তাই রাজস্ব খাতে মৌলিক সংস্কার আনা না হলে রাজস্ব আয় বাড়ানো সম্ভব হবে না। আর এটা যত দ্রুত সম্ভব করতে হবে। আর সেটা এখন করলে তিন থেকে পাঁচ বছর পরে ফল পাওয়া যাবে। সময়ও লাগবে। রাজস্ব আদায়ের পুরো বিষয়টিকেই ঢেলে সাজাতে হবে। রাজস্ব জমা দেওয়ার প্রক্রিয়ায় যাতে কোনোভাবেই সরকারি কোনো কর্মকর্তার সঙ্গে রাজস্ব পরিশোধকারীর যোগাযোগ হওয়ার সম্ভাবনা না থাকে এমন ব্যবস্থা করতে হবে। এর মাধ্যমে দুর্নীতি কমবে এবং সরকার লাভবান হবে বলে।
২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকারি খাতে বৈদেশিক ঋণ-জিডিপির হার ২১.৪৮ শতাংশ। সরকার অবশ্য বলছে যে, যেহেতু ঋণ-জিডিপির হার ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত নিরাপদ মনে করা হয়, তাই ঋণ নেয়ার আরও সুযোগ রয়েছে এবং বাংলাদেশে নিরাপদ অবস্থানেই রয়েছে। ঋণ-জিডিপির হার আসলে কোনো গুরুত্বপূর্ণ জিনিস নয়। এটি দিয়ে তেমন কোনো কিছু বোঝায় না। জিডিপির একশ টাকার মধ্যে সরকারের ভাগ হচ্ছে ৭-৮ টাকা। ঋণ-জিডিপি দিয়ে কী হবে? আয়ের তুলনায় সরকারের ঋণের হার কত সেটা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আয় বা রাজস্ব দিয়েই ঋণ পরিশোধ করা হয়ে থাকে। জিডিপি দিয়ে নয়। কারণ জিডিপির অর্থ সরকারের নয়। সেটা জনগণের। আর এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থা ভালো নয়। কারণ আয়ের তুলনায় ঋণের হার অনেক বেশি হয়ে গেছে। বাংলাদেশের রাজস্ব হার কম হওয়ার কারণে অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা করে সঠিক চিত্র পাওয়া যাবে না। সবশেষ কথা হচ্ছে যে, সরকার দেশি-বিদেশি ঋণের চাপ কমাতে অবশ্যই রাজস্ব বাড়াতে হবে। লেখক: সাংবাদিক