আমানতের খেয়ানত ও কতিপয়ের পাপ কাজকে বৈধ করার তরিকা!
ড. খোন্দকার মেহেদী আকরাম
সেই ২০০৭ সালের ঘটনা। তখন আমি এক বছর হলো লন্ডনে এসেছি। মাস্টার্স শেষ। রেজাল্টের জন্য অপেক্ষা করছি। ভাবলাম, বসে না থেকে কাজ করে কিছু ইনকাম করি। একটা ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে ওয়েটার হিসেবে কাজ শুরু করলাম। ২-৩ মাস কাজ করলাম ওখানে। সবাই বাঙ্গালী। জীবনের একটা নতুন অভিজ্ঞতা হলো। ওই রেস্টুরেন্টের মালিকসহ যারা কাজ করে সবাই বেশ ধর্মভীরু। মূল শেফ মালিকেরই ছোট ভাই। বয়সে তরুন। উনি প্রতিদিন কাজে আসে পাবলিক বাসে করে কিন্তু টিকেট করে নগদ টাকা দিয়ে। সাধারণত লন্ডনে যারা নিয়মিত পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করে তারা ওয়েস্টার কার্ড ব্যবহার করে। এতে পরিবহন খরচ বেশ কিছুটা সাশ্রয় হয়। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি ওয়েস্টার কার্ড ব্যবহার করেন না কেন? মুচকি হেসে উনি বললো, ওয়েস্টার কার্ড ব্যবহার করলে সরকার বুঝে ফেলবে যে উনি একই জায়গায় একই সময়ে প্রতিদিন যাতায়াত করে। অর্থাৎ উনি নিশ্চয়ই কোনো জব করে। আমি বললাম, তাতে সমস্যা কী? উনি বললো, ভাগ্নে, এটা বুঝতে হলে তোমাকে আরো কয়েক বছর লন্ডন থাকতে হবে। আমি আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলাম আসল ঘটনা। উনি তখন বললো, যে সরকারের রেকর্ডে উনি একজন জব সিকার। মানে, বেকার কিন্তু জব খুঁজছেন। আর যেহেতু উনি বেকার সেহেতু সরকারের কাছ থেকে বেকার ভাতা পাচ্ছেন। এক দিকে বেকার ভাতা নিচ্ছেন, অন্যদিকে ফুল-টাইম শেফের কাজ করে ভালোই কামাচ্ছেন। আমি বললাম, এটা তো সরকারের সঙ্গে ফ্রড করা হলো। উনি বললেন, ইহুদি-নাসারা সরকারের সঙ্গে ফ্রড করলে কোনো গুনাহ হবে না। উনার এই আইডিয়াটা ইউকের বাঙালী কমিউনিটিতে কিছু কিছু মানুষের ভেতরে প্রচলিত আছে। এরা বিভিন্ন ধরনের ফ্রড করে কিন্তু ভাবে এটা অন্যায় নয়। কারণ এ দেশের নিয়ম ইসলামিক নিয়ম না।
আরেকটা ঘটনা বলি। এটা শুনেছি লন্ডনের বেশ কয়েকজনের কাছে। ইউকেতে একটা বাঙালী কমিউনিটির অনেকেই বাস্তবে বিবাহিত কিন্তু সরকারি রেকর্ডে তারা সেপারেটেড বা ডিভোর্সড। ফলে স্ত্রী যেহেতু কোনো কাজ করেনা এবং ৩/৪ সন্তানের মা, তাই সরকার সেই মার জন্য কাউন্সিল থেকে ফ্রি একটা বাসা দেয় বসবাস করার জন্য, সঙ্গে আরো অন্যান্য ভাতা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, ওই দম্পতি একই বাসায় একই সঙ্গে বসবাস করে। মাঝখান থেকে তারা একটি বড়ি বাড়তি পায় যা তারা ভাড়া দিয়ে বেশ কিছু বাড়তি আয় করে। যার কাছ থেকে আমি এটা শুনছিলাম, তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ডিভোর্সের পরে স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে বসবাস করা তো হারাম। উনি বললেন, ইহুদি-নাসারাদের আইন অনুযায়ী ডিভোর্স হলেও ইসলামি রীতিতে তো আর তালাক দেয় নেই। নিকাহ নামা তো এখনও বলবৎ আছে। তাই এটা হারাম না। এই ধরনের মুসলমানদের মূল বক্তব্য হচ্ছে ইউকে যেহেতু ইসলামি রাষ্ট্র না তাই এই দেশের সরকারি নিয়ম লঙ্ঘন করে অপরাধ করলে তা কোনো পাপ না। আমি অবশ্য এই ধারণার সঙ্গে সম্পূর্ন ভিন্নমত পোষণ করি। কিছুদিন আগে কোরান পড়তে গিয়ে একটা আয়াত চোখে পড়লো। সূরা আল-ইমরানের ৭৫ নম্বর আয়াত। আয়াতটি মূলত বনি ইসরাইলদের উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে। বিষয়টি এমন যে কিছু কিছু ইহুদি মানুষের কাছ থেকে অর্থ, স্বর্ণ নিয়ে তা আর ফেরত দিতে চাইতো না। অর্থাৎ তারা আমানতের খেয়ানত করতো, যা একটি গুরুতর পাপ। এই পাপ কাজকে বৈধ করার জন্য তারা বলতো, ডব ধৎব হড়ঃ ধপপড়ঁহঃধনষব ভড়ৎ বীঢ়ষড়রঃরহম ঃযব এবহঃরষবং. অর্থাৎ যারা ইহুদি না তাদের সঙ্গে এই রকম আমানতের খেয়ানত করলে আল্লাহর কাছে তারা দায়ী হবে না। এখানে এবহঃরষবং-রা হলো ইহুদি ব্যতিত অন্য ধর্মের মানুষ। তবে পরের লাইনেই এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ বলছেন, অহফ ংড় ঃযবু ধঃঃৎরনঁঃব ষরবং ঃড় অষষধয শহড়রিহমষু. অর্থাৎ তারা জেনে শুনে আল্লাহর সম্পর্কে মিথ্যে বলে।
অর্থাৎ এ থেকে বলা যায় ওপরের গল্পের শেফ এবং ডিভোর্সি দম্পতিরা যা করছে তা পাপ। নিচে আমি কোরানের পুরো আয়াতটি দিয়ে দিলাম। [There are some among the People of the Book who, if entrusted with a stack of gold, will readily return it. Yet there are others who, if entrusted with a single coin, will not repay it unless you constantly demand it. This is because they say, We are not accountable for exploiting the Gentiles. And so they attribute lies to Allah knowingly. Verse- 3:75]