যাকাত দরিদ্র ও ধনীদের মধ্যে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার বন্ধন তৈরি করে
আসজাদুল কিবরিয়া : মুসলমানদের জীবনে যাকাত অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি বিষয়। ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের একটি হওয়ায় যাকাতকে যথাযথভাবে সংগঠিত করা গুরুত্বপূর্ণ। এর উদ্দেশ্য হলো সম্পদের সুষম বণ্টনের মাধ্যমে সমাজে দারিদ্র্যতা হ্রাস করা। ইসলাম একটি সমতাবাদী সমাজের নীতিকে সমর্থন করে। একদিকে, এটি আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধির একটি উপায়। অন্যদিকে, সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে ভারসাম্য পুনরুদ্ধারের একটি উপায়। যাকাত ইসলামের সামাজিক-আর্থিক ব্যবস্থার একটি অংশ। এটিকে একটি প্রধান ইসলামী আর্থিক হাতিয়ার হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। যা ধনী, বিত্তশালী মুসলমানদের থেকে দরিদ্র ও প্রয়োজনের মুসলমানদের কাছে সম্পদ স্থানান্তর করতে ব্যবহৃত হয়।
এই প্রক্রিয়ায় যাকাত দরিদ্র ও ধনীকে ভালবাসা, শ্রদ্ধার বন্ধনের মাধ্যমে একত্রিত করে। এর কারণ হলো, সাবেক কেমব্রিজ অনুষদের সদস্য, সৈয়দ আলী আশরাফ ব্যাখ্যা করেছেন, ‘যাকাত প্রদানকারীরা দরিদ্রদের প্রতি কোনো উপকার করছে না; বিপরীতে, যাকাত গ্রহণের মাধ্যমে, দরিদ্র ও অভাবীরা ধনীদের প্রতি অনুগ্রহ করছে’। যে কোনো মুসলমান যার কাছে এক ইসলামি চান্দ্র বছরের নিসাবের সমপরিমাণ সম্পদ রয়েছে সে যাকাত দেওয়ার যোগ্য নিসাব হয় ৮৭.৫ গ্রাম সোনা বা ৬১৩ গ্রাম রূপা। এছাড়াও, আর্থিক সম্পদের নিসাব যাকাতের অধীন। কিছু ইসলামী পন্ডিত ৮৫ গ্রাম সোনা বা ৫৯৫ গ্রাম রূপা নিসাব হিসাবে পছন্দ করেন। আর্থিক সম্পদের নিসাব সম্পর্কেও মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ যুক্তি দেন যে এটি সিলভার স্ট্যান্ডার্ড হওয়া উচিত, অন্যরা স্বর্ণের স্ট্যান্ডার্ডের পক্ষে যুক্তি দেয়। মুসলমানদের নিসাব পরিমাণের কমপক্ষে ২.৫ শতাংশ বা তার বেশি সম্পদ বার্ষিক যাকাত হিসাবে দিতে হবে। কুরআনের আদেশের উপর ভিত্তি করে, নবী মুহাম্মদ (সা.) এর অনুশীলন ও নির্দেশের সঙ্গে মিলিত, ইসলামী পন্ডিতরা যাকাত সংগ্রহ ও বিতরণের জন্য কিছু ব্যাপক নির্দেশিকা তৈরি করেছেন। এই নির্দেশিকাগুলো একচেটিয়া নয়, যার অর্থ যাকাতের বিভিন্ন মাত্রা সম্পর্কে আলেমদের মধ্যে কিছু মতভেদ রয়েছে।
যাকাতের সর্বোত্তম বণ্টনের ক্ষেত্রে এগুলো একই রকম, এটি সামগ্রিক যাকাত ব্যবস্থাপনার সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং অংশ। অন্য কথায়, যাকাত গ্রহীতাদের স্বচ্ছ ও সুবিধাজনকভাবে শনাক্ত করতে ও যাচাই করতে না পারা যাকাতের বণ্টনকে সর্বোত্তম করার জন্য একটি বড় বাধা। যাকাতের নীতিটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার মাধ্যমে যাকাতের সমষ্টিগত সংগঠনের উপর জোর দেয়, যদিও যাকাত পৃথকভাবে বণ্টনে কোনো বাধা নেই। কারণ এটি প্রাথমিকভাবে ব্যক্তির জন্য একটি বাধ্যতামূলক দান। সুতরাং, একজন যাকাত প্রদানকারী হয় প্রাপকদের শনাক্ত করতে পারেন ও তারপরে তা ব্যক্তিগতভাবে তাদের মধ্যে বিতরণ করতে পারেন বা তাদের পক্ষে এটি বিতরণ করার জন্য একজন এজেন্ট নিয়োগ করতে পারেন। যোগ্য প্রাপকদের মধ্যে বিতরণ করার জন্য স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বা অনুমোদিত সংস্থাকে যাকাত দেওয়াও সম্ভব। যাকাতকে আরও ভালোভাবে হস্তান্তর করার জন্য সমষ্টিগত সংহতি প্রয়োজন যাতে দীর্ঘমেয়াদে আরও বেশি মানুষ উপকৃত হতে পারে। একটি মুসলিম রাষ্ট্র বা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে যাকাত সঠিকভাবে সংগ্রহ ও বিতরণ করার জন্য সরকারের একটি যাকাত ব্যবস্থাপনা সংস্থা বা ইউনিট রয়েছে। গত বছর, জাতীয় সংসদ যাকাত তহবিল ব্যবস্থাপনা আইন-২০২৩ পাস করেছে, যা যাকাত তহবিল অধ্যাদেশ, ১৯৮২ প্রতিস্থাপন করেছে। যা সরকারি ব্যবস্থাপনায় যাকাত সংগ্রহ ও বিতরণকে সুবিন্যস্ত করতে পারে।
আইন অনুসারে, কাজটি করার জন্য একটি নতুন যাকাত বোর্ড গঠন করা হয়েছে, যদিও সামগ্রিক অগ্রগতি এখনও গতি পায়নি। সরকারি তহবিল ছাড়াও বেশ কয়েকটি বেসরকারি দাতব্য সংস্থা দেশে যাকাত সংগ্রহের জন্য কাজ করছে। যাকাত সংগ্রহ ও বিতরণের জন্য কাজ করে এমন আরও কিছু নেতৃস্থানীয় সংস্থার মধ্যে রয়েছে ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন, যাকাত ব্যবস্থাপনা কেন্দ্র, আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন ও কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন। এটা দৃশ্যমান যে বেসরকারি দাতব্য সংস্থাগুলো মূলত উন্নত ব্যবস্থাপনার কারণে সরকারি বডিজের চেয়ে অনেক বেশি যাকাত সংগ্রহ করছে। এই সংস্থাগুলো সংগৃহীত যাকাতকে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করে। যেমন চাকরি সৃষ্টি, ক্ষুধা হ্রাস, শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিষেবা ও পুনর্বাসন। যাকাতের মূল নীতিগুলোর মধ্যে একটি হলো বাধ্যতামূলক দান করা; যাতে যাকাত প্রাপকদের কয়েক বছরের মধ্যে পুনরায় তা গ্রহণ করতে না হয়। এর অর্থ যাকাতের অর্থ প্রাপকদের চাকরি প্রদান করে, অন্যান্য আয়ের উৎস তৈরি করে ও দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পেতে সহায়তা করে, ভয়ানক পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে সহায়তা করবে।
প্রাতিষ্ঠানিক প্রচেষ্টা ছাড়া যাকাতের অর্থ এতো কার্যকরভাবে ব্যবহার করা সহজ নয়। বছরের পর বছর ধরে, যাকাতের প্রাতিষ্ঠানিক গতিশীলতা বেড়েছে। অনেক যাকাতদাতা তাদের প্রাপ্য যাকাত প্রদানের জন্য এই দাতব্য সংস্থাগুলোর উপর বেশি নির্ভর করছে। যাকাতের নামে গরীবদের মধ্যে কিছু বস্ত্র ও খাবার বিতরণের পুরানো প্রথা এখনও বিদ্যমান থাকলেও অনেকে ত্রুটিপূর্ণ প্রথা থেকে বেরিয়ে এসেছেন। যেহেতু যাকাতের সর্বোত্তম ব্যবহার করার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক প্রচেষ্টা ত্বরান্বিত হয়েছে, তাই সচেতনতা বৃদ্ধি ও নীতি সহায়তার মাধ্যমে প্রচেষ্টাকে উৎসাহিত করা প্রয়োজন। যাকাত প্রদান শুধুমাত্র কয়েকটি সংস্থার জন্য কর-মুক্ত। যাকাত আদায়ের কার্যকারিতা ও স্বচ্ছতার উপর ভিত্তি করে সুবিধাটি আরও প্রতিষ্ঠানের কাছে প্রসারিত করা যেতে পারে। এতে আরো বেশি মানুষ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যাকাত দিতে উৎসাহিত হবে। যাকাত বণ্টনকে আরও কার্যকর করার জন্য সংস্থাগুলোকে আরও ভালো কাজ করতে উৎসাহিত করা হবে।
ধংলধফঁষশ@মসধরষ.পড়স অনুবাদ : জান্নাতুল ফেরদৌস। সূত্র : দি ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস