চেরাগ বা প্রদীপ নয়, জনগণের অর্থ লুটের কাহিনি!
আলী রীয়াজ
বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক এবং র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ এবং তার পরিবারের অঢেল সম্পদের যে হিসাব একটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু কমবেশি সকলেই শেষ পর্যন্ত বলছেন যে, এটা খুব বিস্ময়কর বিষয় নয়। এরকম ঘটনা যে এখন স্বাভাবিক বলে বিবেচিত হয়, সেটাই আসল খবর। এই বিশাল বিত্ত-সম্পদ অকস্মাৎ হয়েছে তা নয়। সরকারি চাকরিতে থাকাকালেই তা হয়েছিলো এটা তখন কানাঘুষা হিসেবে প্রচলিত ছিলো, যেসব সম্পদের কথা বলা হচ্ছে তার অধিকাংশ দৃশ্যমানও ছিলো। কিন্তু তা নিয়ে কোনও রকমের প্রতিবেদন ছাপা হয়নি, সেটাও লক্ষ্য করার মতো। ক্ষমতার আচ্ছাদনের নিচে না থেকে যে এই সম্পদ অর্জন সম্ভব না সেটা জানেন না বাংলাদেশে এমন মানুষ নেই। কিন্তু এই ক্ষমতার আচ্ছাদন নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনও লক্ষণ দেখা যায়না। আগেও আমরা দেখেছি যে ক্ষমতায় থাকার সময় কার কোথায় কতো বিত্ত সেটা জানা যায় না। সাবেক ভূমি প্রতিমন্ত্রীর লন্ডনে কতো সম্পদ আছে তা জানা গেছে মন্ত্রিসভায় তার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে। এই নিয়ে তার কিছু ব্যাখ্যা আছে। তিনি দাবি করেছেন, যে তিনি দুর্নীতি করেননি, দেশ থেকে এক টাকাও নেননি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই যে এতো প্রতিবেদন তারপরে হচ্ছে কী? ক্ষমতার আচ্ছাদনের বিষয়টি যে গুরুত্বপূর্ণ সেটা উপলব্ধি করার জন্যে আরেকটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে।
বাংলাদেশের একজন ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে একটি সংবাদপত্রে অর্থ পাচারের অভিযোগ করে প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল। এই নিয়ে সারা দেশে হৈচৈ হলো। শেষ পর্যন্ত আদালত বলে দিয়েছে যে, এই নিয়ে আর কথা বলা যাবেনা। এখন আদালতের আদেশ শিরোধার্য। এগুলো তো সামান্য উদাহরণ। এমন ঘটনা অহরহ-ই ঘটে। আপনাদের নিশ্চয় মনে থাকবে যে টেকনাফ থানায় একজন ওসি ছিলেন প্রদীপ কুমার দাশ। তিনি ক্ষমতায় থাকার সময় তার দিকে আঙ্গুল ওঠানোর সাহস কারো ছিলো না। তিনি একাধিকবার বিপিএম, পিপিএম পদকে ভূষিত হয়েছিলেন। সামরিক বাহিনীর সাবেক একজন কর্মকর্তাকে বিচার বহির্ভূত হত্যার দায়ে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তার এবং তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলায়ও তারা দোষী সাব্যস্ত হন, প্রদীপ দাশ ২০ বছরের কারাদণ্ডে দন্ডিত হয়েছেন। এসব কি আসলেই কারো জানা ছিলো না? কিন্তু ক্ষমতার আচ্ছাদনের শক্তি কেবল তাকে টিকিয়ে রেখেছিল তা নয়, তাকে পদকের পর পদকে ভূষিত করেছে, যেমন দেখা গেছে বেনজীর আহমদের ক্ষেত্রেও। এসব ঘটনাকে স্বাভাবিক বলে মেনে নেওয়ার যে পরিবেশ-পরিস্থিতি এটাই হচ্ছে বিরাজমান ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় সাফল্য। যে ব্যবস্থার কথা বলছি সেটা কী ব্যবস্থা? সেটা হচ্ছে জবাবদিহিহীন শাসন ব্যবস্থা, যেখানে নাগরিকের প্রশ্নের কোনও অধিকার নেই। যারা ক্ষমতায় আছেন তারা জনগণের ম্যান্ডেট নিয়া ক্ষমতায় আসেনি, তারা এমন ব্যবস্থা করেছেন যে, আগামীতে তাদের কারো কাছেই ম্যান্ডেটের জন্যে যেতে হবে না।
এই রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে যে অর্থনীতি চালু আছে, থাকে সেখানে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে যারা আছেন তারা লুটপাট করবেন। প্রতিদিনের ব্যবহার্য জিনিসের নামে আপনার পকেট থেকে শুরু করে ব্যাংক পর্যন্ত কিছুই বাদ যাবে না। রাজনৈতিক বিবেচনায় যেসব ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়া হয়েছিলো সেগুলোর দিকে তাকালেই বোঝা যায়। লুণ্ঠনের এই অবারিত উৎসবের অর্থের জোগান দিচ্ছেন এবং দেবেন নাগরিকরা ক্রমাগতভাবে মূল্য বৃদ্ধির মাধ্যমে দেবেন, জ্বালানি খাতে লুটের কারণে বেশি দামে জ্বালানি কিনে দেবেন। নাগরিকদের নামে বিদেশ থেকে ঋণ করা হবে, তার সুদ গুণতে হবে আপনাকে। এসব অর্থই হচ্ছে ক্ষমতার ছাতার নীচে থাকা মানুষদের ফুলে ফেপে ওঠার, সম্পদের পাহার গড়ার উপায়। এগুলোকে চেরাগ বা প্রদীপ বললে শুনতে ভালো শোনায়, কিন্তু আসল কথা হচ্ছে এগুলো হচ্ছে জনগণের অর্থ লুটের কাহিনি। দুই একজনের এই কাহিনি প্রকাশিত হচ্ছে, কিন্তু যে ব্যবস্থা তা সম্ভব করছে তা নিয়ে প্রশ্ন না করলে, তাকে মোকাবেলা না করলে যা হওয়ার তা চারপাশেই ঘটছে। ১-৪-২০২৪। ফেসবুক থেকে