
চালের দাম বেঁধে দেওয়া উচিত নয়

অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান
কোনো অবস্থাতেই চালের দাম বেঁধে দেওয়া উচিত নয়। লাখ লাখ কৃষক চাল উৎপাদন করার পরেও চালের বিভিন্ন ধরনের মান অনুযায়ী গ্রামে, শহরে, চালের মিলে, কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানÑপ্রত্যেকের জন্য এক দাম নির্ধারণ করা খুব কঠিন কাজ। আমি বলবো, এটি না করলেও হবে। কারণ এটি মানবে না কেউ। কখনো কখনো দেখা যাবে বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে অনেক কম দামে বিক্রি হচ্ছে, আবার অনেক সময় বেশি দামেও বিক্রি হবে। চালের অনেক মান আছে, যা নির্দিষ্ট করে ঠিক করা অনেক কঠিন কাজ। কোনটি কোন মানের সেগুলো বাজারে বসে বসে কে ঠিক করবে? যদি ডিমান্ড অনুযায়ী পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকে তাহলে সেই ডিমান্ড এবং সাপ্লাইয়ের ইন্টারেকশনে দাম নির্ধারিত হয়।
সরকারের কাছে কৃষি অধিদপ্তর গোডাউনের যে হিসাব দেয় সে হিসাবের মধ্যে গড়মিল থাকলে ব্যবসায়ীরা তা টের পেয়ে যায় এবং তারা এই সুযোগে দাম বাড়াতে থাকে। কৃষি দপ্তর বাহবা নেওয়ার জন্য সেঁচ দেওয়া বা পানি দেওয়া নিয়ে সরকারকে বিভিন্ন সময়ে নানা রকম তথ্য দেয়। কিন্তু শেষে দেখা যায় যে সেই পরিমাণ উৎপাদন হয় না। অন্যদিকে খাদ্য মন্ত্রণালয় যে পরিমাণ খাদ্য মুজুত দেখায়, আসলে সে পরিমাণ থাকে না। এটি ব্যবসায়ীরা খুব ভালোভাবেই জানেন। প্রকৃত ঘটনাগুলো যদি এমন হয়, যে পরিমাণ ডিমান্ড আছে সেই পরিমাণ সাপ্লাই নেই, তাহলে অবিলম্বে ইম্পোর্ট করতে হবে। ইম্পোর্ট করে এলসি খুলে বসে থাকলে হবে না, আদৌ আনা হয়েছে তা মনিটরিং করতে হবে। আমাদের মোট রিকোয়ার্মেন্ট কত, ডিমান্ড কতো, সাপ্লাই কত, পাইপলাইনে কতো আছে, গোডাউনে কতো আছে এগুলো তদারকি করাকে আসলে মনিটরিং বলে। বাজারে ঘুরাঘুরি করাকে নয়। রিয়েল ইস্টিমেটের মধ্যে গোলমাল আছে এজন্য হয়তো দাম বাড়ছে। অতএব একমাত্র বুদ্ধি হচ্ছে যদি সত্যিই শর্টেজ থাকে তাহলে দ্রুত ইম্পোর্টের ব্যবস্থা করা।
সরকার কখনোই পণ্যের দাম বেঁধে দেয়নি। মিডিয়া এটি বুঝতেই পারেনি। সরকার পণ্যের যৌক্তিক দাম নির্ধারণ করেছে। অর্থাৎ পণ্য উৎপাদন করতে যে খরচ হয় তার সাথে সাথে ন্যায্য একটি লাভ ধরে যত দাম হওয়া উচিত সেই হিসাব। সরকার বলেছে যৌক্তিক দাম, আর মিডিয়া বলেছে সরকার নির্ধারিত দাম। যৌক্তিক দাম কোনো নির্ধারিত দাম না। এটি মিডিয়া তৈরি করেছে। বাজারে কোনো সিন্ডিকেট নেই। চালের কোনো সিন্ডিকেট হয় না। সিন্ডিকেট বানিয়েছে মিডিয়ার লোকেরা। নিশ্চয় সরবরাহ শর্ট আছে যার জন্যে দাম বেড়েছে। লাখ লাখ লোক চাল উৎপাদন করে, হাজার হাজার লোক চাল কলের মালিক। তারা সবাই মিলে মিটিং করে চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে এটি মনে করার কোনো কারণ নেই। সরবরাহের মধ্যে কোনো ঘাটতি আছে, আর সেটি ব্যবসায়ীরা কোনোভাবে জেনে গেছে, যার ফলে চালের দাম বাড়ছে।
সরকারের আসলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টাই করা উচিত নয়। ডিমান্ড এবং সাপ্লাই নিয়ে যদি ক্রেতাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হয় তাহলে দাম বেড়ে যাবে। আর যদি বিক্রেতাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হয় তাহলে দাম কমবে। এখানে সরকারের নিয়ন্ত্রণ করার কিছু নেই। সরকারের শুধু দেখা উচিত যে সাপ্লাই চেইনের মধ্যে যেন কোনো চাঁদাবাজি, গোডাউনে যেন বেশি সময় ধরে পণ্য রেখে না দেওয়া, পরিবহন সংকট সংক্রান্ত সমস্যাগুলো না হয়। আমার মতে, বাজার ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণই করা উচিত নয়। বাজারকে বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত। যে জিনিস উৎপাদন কম হবে বা পাওয়া যাবে না সেটি বেশি দাম দিয়ে কিনবে ক্রেতারা। যেটি না পাওয়া যাবে তার বিকল্প জিনিস ক্রেতা ব্যবহার করবে, যা সম্পূর্ণ বাজারের উপর নির্ভর করবে। পরিচিতি: অধ্যাপক, মার্কেটিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। মুঠোফোনে মতামত গ্রহণ করেছেন সঞ্জয় চন্দ্র দাস
