টাকাপয়সা ধার দেওয়া, পরিশোধ নিয়ে তর্ক- বিতর্ক, মান-অভিমান ও সম্পর্ক নষ্টের ঝুঁকি!
কাজী এম. মুর্শেদ
টাকাপয়সা ধার দেওয়া আর ধার শোধ নিয়ে কয়টা কথা বলি। এটা বাঙালির এক অনন্য গুণ। সেটা ব্যাংকের সাঙ্গে বা ব্যক্তির সঙ্গে, যেভাবেই হোক। টাকা ধার দিয়ে ফেরৎ চাইবার জন্য মানুষ খুন হওয়ার খবর দেখেছেন, নিকটআত্মীয় খুনের খবরও দেখেছেন। বন্ধু-বান্ধবের মধ্যে ক্যাচালের মূল কারণও একই। ধার নেওয়ার সময় পেছনে ছায়ার মতো ঘুরবে, শোধ দেওয়ার আগে আপনার ছায়া মাড়াবে না, বরং আপনার ফোন ধরবে না, দেখা করবে না, কথা বলা দূরের কথা, অন্যদের এমন গল্প বলবে, যা শুনে আপনার মনে হবে, এ মাÑ এতো ছ্যাচড়া? আমরা শুধু টাকা ধার নিয়ে এ কাজ করি না, কেউ কেউ যে টাকা প্রাপ্য সেটা নিয়েও এমন কাজ করে। এখানে যে টাকা নিয়েছে, সে কোনো গরিব মানুষ না, টাকা ফেরত দেওয়ার ইচ্ছাটা জন্মগতভাবেই আমাদের নেই।
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, টাকা চাইতে গেলে আপনাকে কারণ দর্শাতে হবে যেকেনো আপনার টাকার দরকার। আপনার টাকা নেওয়ার সময় বিড়ালের মতো ঘুরবে, ফেরৎ চাইলে বাঘের রূপ নেবে। কেউ কেউ আবার একটা এক্সকিউজ খোঁজে। কী কারণে তিনি অফেন্ডেড হয়েছেন যে আপনি টাকা চাইছেন, সেজন্যই টাকা দেবেন না। উদাহরণ দিই বুঝতে সুবিধা হবে। এক সামান্য পরিচিত ব্যক্তি দেখা করে বেশ খানিকক্ষণ কান্নাকাটি করলো। কিছু টাকা আজকেই লাগবে, না হলে বিশাল ক্ষতি হয়ে যাবে। বিনিময়ে দুইখানা চেক দিলেন তাতে তারিখ নেই। তার দেখা এখনো পাইনি। বেঁচে আছে কি না তাও জানা নেই।
একটা কাজ করে দিয়েছিলাম, কয়েক মাসের পাওনা জমে গেছে। তিনি অবশ্য খুবই ধনী ব্যক্তি, তার দেখা করার বা কথা বলার সময় নেই। টাকা উড়াতে জানেন, পাওনা ফেরত দিতে হবে এ কথা এখনো জানেন না। বেশি নাম করা লোক বলে নাম বলা যাবে না। আরেক এমন বিজন্সে ম্যাগনেট, একটা প্রজেক্টে কাজ করে দিয়েছি,শেষ কিস্তির টাকা দেবেন না। তিনি নাকি মাইন্ড করেছেন কেন আমি টাকা চাইলাম, তিনি এমনিতেই দিতেন। এখন মালয়েশিয়া সেকেন্ড হোম করে সন্তানদের লন্ডনে পড়িয়ে ব্যবসাপাতি করছেন, টাকার অভাব নেই। কিন্তু অভিমান করে আছেন টাকা কেন চাওয়া হলো। অন্য এক প্রজেক্ট বলি। কাজটা খুবই কঠিন, তারপরও উৎরে এসেছি। কাজ হওয়ার পর তিনি এখন চেনেন না। নামাজ পরতে পরতে কপালে কালো দাগ পরে গেছে, কিন্তু ঢাকা শহরে ২৪টা ফ্লাটের মালিক, টাকা দেবেন না।
আমার বিশাল অপরাধ, তার একভাইকে চিনি, তাকে বলেছিলাম টাকা ফেরৎ দেওবার জন্য। তিনি অপমানিত বোধ করেছেন, টাকা চেয়ে মেসেজ দেখবেন, সীন দেখাবে, এরপর আর কোনো খবর নেই। এক বন্ধু বড় ব্যবসায়ী, ঢাকার আর আমেরিকার ব্যাবসা নিয়ে আছে। টাকা তার হাতের ময়লা। একটা প্রজেক্টে কাজ করতে গিয়ে দেখলাম ময়লা মানসিকতায়, না হলে টাকা জমতো না। একটা নির্দিষ্ট টাকা দেওয়ার কথা ছিলো, কিছু দেওয়ার পর আর খবর নেই। টাকা চাইতেই কারণ দর্শানো লাগলো, টাকার হিসাব দেওয়া লাগলো, এরপর ব্যাংক স্টেটমেন্ট চেয়ে বসলো। ছোট বেলার বন্ধু, বুঝলাম টাকা দেবে না, শুধু শুধু ঘোরানো। আজকাল সব হিসাব থেকে বাদ দিয়েছি, কোনো টাকাই ফেরৎ পাবো না, এখনই জানি। সনাতন ধর্মী, বিজ্ঞানী, বিদেশে বসবাসকারী, বিশাল ব্যবসায়ী, পাঁচওয়াক্ত নামাজী সবই আছে। সবার একটাই মিল, জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক। তবে যে যেখানেই আছে, টাকা ফেরতের আশা না করলেও ধর্মমতে আমার অধিকার আছে কোনো দাবি ছাড়বো না। মারা গেলেও ছাড়বো না। ধর্মে বলা আছে, মানুষের দুইরকম গুনাহ হয়, এক আল্লাহর কর্ম, যা ধর্মমতে করতে হয়, না করলে গুনাহ হয়। অন্যটা মানুষের সঙ্গে অন্যায্য আচরণ।
মহান আল্লাহ এটাও বলেছেন, তিনি ব্যক্তির সকল গুনাহ মাফ করতে পারেন। কিন্তু অন্য মানুষের প্রতি অবিচারে যদি সে ব্যক্তির কাছে ক্ষমা চাওয়া না হয় এবং ক্ষমা না করে, সেটা স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ক্ষমা করতে পারেন না বা করেন না। রোজার মাস আসছে, হিসাব করেন কে কে আপনার কাছে অর্থ পায়, তার দেনা আগে শোধ করেন। রোজা রাখবেন, নামাজ পরবেন, তারাবির নামাজ, তাহাজ্জুদের নামাজ পরে মনে করবেন আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কতো নেকি দান করলেন, সরি মাই ফ্রেন্ডস, এই নেকি আপনার কোনো কাজে আসবে না। সব ধর্মে মানব হয়ে অন্য মানবের প্রতি আচরণকে সবসময় সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। যেকোনো ধর্মের বই উল্টিয়ে দেখতে পারেন। লেখক: অর্থনৈতিক বিশ্লেষক