ডলার সংকট, ঋণের সঠিক ব্যবহার ও উন্নয়ন-অর্জন
ড. মাহবুব উল্লাহ
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর একজন নামকরা ফরাসি অর্থনীতিবিদ রেনে দু্যঁমো এসেছিলেন এবং তিনি মন্তব্য করেছিলেন যে কতো কাজ করার আছে বাংলাদেশে। কিন্তু কতো লোক বেকার আছে। বেকারত্ব একটা বড় সমস্যা। আর তার থেকেও বড় সমস্যা হলো শিক্ষিত বেকার সমস্যা। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যেসব শিক্ষিত ছেলে বের হয় তাদের মধ্যে ২৮ শতাংশই বেকার, যা কিনা তরুণদের মনে হতাশা সৃষ্টি করছে। যারা দেশ ও রাষ্ট্র পরিচালনা করেন তাদের এসকল বিষয় বিবেচনায় নেওয়া উচিত। সর্বোপরি সাধারণ জনগণের মনে একধরনের চাপা অভিমান আছে, যা তারা স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ আশা করে তা দেখতে না পেয়ে জনগণের মনেও হতাশা আছে। তারা দেখছে সীমান্তে আমাদের নাগরিকদের হত্যা করা হচ্ছে, কিন্তু তার কোনো প্রতিকার হচ্ছে না। তারা দেখছে আমাদের নদীগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে পানির লাইন বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। দক্ষিণাঞ্চলে রাডার স্থাপন করা হয়েছে, সেটাও বিদেশি রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে। সব মিলিয়ে আমরা যদি চিন্তা করি বাংলাদেশ সত্যিকার স্বাধীন সার্বভৌম, উন্নত ও সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্র হবে তাহলে সে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য কিন্তু আমাদের অনেক কাজ করার আছে।
বেকার সমস্যার সমাধান করতে অর্থনৈতিক উদ্যোগগুলোকে আরও সম্প্রসারিত ও দক্ষ করা প্রয়োজন। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়ালে বেকার সমস্যার সমাধান হবে। স্বাধীনতা পরর্বতী সময়ে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা কী ছিলো। সে সময়ের অর্থের বা টাকার যে মূল্য আর বর্তমান সময়ে অর্থের যে মূল্য সে ব্যবধানটা দেখত হবে। প্রকৃত অর্থে লাখ কোটি টাকা আসলে কতো কোটি টাকা সেটার একটা সঠিক হিসেবে মূল্যস্ফীতি দেখিয়ে আনতে হয়। বাজেট নিঃসন্দেহে বেড়েছে।
বাজেট পেশ করার সময় খুব উচ্চাকাক্সক্ষা বাজেট পেশ করা হয় যা শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। এর ফলে আমাদের উন্নয়নে যে পরিমাণ অর্থ দরকার সেভাবে তা সংগ্রহ করতে পারছি না। সুতরাং বলা যায় আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় যে ঘাটতি আছে তা দূর করতে হবে এবং আমরা যে বিদেশ থেকে ঋণ নিয়ে দেশের অবকাঠামো তৈরি করছি সে ঋণের টাকা যেন সঠিক পথেই ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও আমরা ঋণ সঠিক সময়ে শোধ করতে পারবো কিনা সেটাও বিবেচনায় রাখতে হবে। স্বার্থের বাইরে যাওয়া যাবে না। আমদের অর্থনেতিক ব্যবস্থাপনা দুর্বল এবং এ অদক্ষতা দূর করতে পারলে আমাদের যে সীমিত অর্থ আছে সেটাও কাজে লাগাতে পারবো না। নতুন সম্পদ যোগানের জন্য চিন্তা করতে হবে। কয়লা দিয়ে তেল উৎপাদন কতোটুকু সম্ভব তা নিয়ে ভাবতে হবে। সমুদ্রের পানির নিচে এর গভীরতা ও সমুদ্রের মাটির গভীরতা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। এসব নিয়ে আমরা চিন্তা করিনি বরং অবহেলা করেছি।
আমরা যদি এসব বিষয়ে গুরুত্ব দিতাম তাহলে বিদেশ থেকে এতো ঋণ নিতে হতো না। ঋণ নিতে গিয়ে মনে রাখতে হবে যে টাকাটা ঋণ নিয়েছি সে কাজঠা যেন সঠিকভাবে পরিচালিত হয় এবং এর পরিবর্তে যে আয় হবে সেটা থেকে যেন ঋণের সুদ এরপর পৃষ্ঠা ৭, সারি
(শেষ পৃষ্ঠার পর)এবং আসল পরিশোধ করতে পারি। শেষবারের মতো বলতে চাই এ দেশে অনেক কাজ করার আছে। সেটা চিন্তা ভাবনা করে সুষ্ঠুভাবে করতে হবে। দেশের মানুষের মনে স্বপ্ন জাগিে রেখে অবিচার, অনাচার চলতে থাকলে দেশের মানুষ অপরাধপ্রবণতা ও অসামাজিক কর্মকাণ্ডে ঝুঁকে পরবে। আমাদের দেশে নতুন ধরনের অপরাধ বাড়ছে, মাদকের ব্যবহার বাড়ছে। এ দিকগুলো নিয়ে রাষ্ট্রকে শক্ত হতে হবে। আমদানি বাড়ানোর জন্য ব্যবসাকে শৃঙ্খলায় আনতে হবে। ডলার সংকট থাকলে মূল্য¯ফীতি বেড়ে যাবে। ফলে বাজারেও দাম বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে।
শিক্ষা ব্যবস্থায় বড় ধরনের ফাঁকি আছে। আমাদের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চলছে না আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কেবল সার্টিফিকেট দেওয়া হচ্ছে। ভালো মানের শিক্ষা নেই। দেশে যদি মানবসম্পদ তৈরি করতে হয় তাহলে আমাদের অবশ্যই শিক্ষার উপর গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষার ক্ষেত্রে যে সকল নৈরাজ্য চলছে অনিয়ম চলছে সেগুলোকে পরিহার করে প্রতিরোধ করে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে যেন আমরা দেশেই প্রকৌশলী ও দক্ষ চিকিৎসক, বিজ্ঞানী, অর্থনীতিবীদ, সমাজবিজ্ঞানী গড়ে তোলার জন্য তৈরি করতে হবে এবং আরও অন্যান্য যে বিষয় আছে দর্শন ও সাহিত্য সেখানেও শিক্ষার প্রয়োজন। আমাদের দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাব নেই। কিন্তু মানসম্মত শিক্ষার অভাবে শিক্ষা ক্ষেত্রে ধস নেমেছে। একটি রিপোর্ট থেকে জানতে পারি যে, তৃতীয় শ্রেণির ছাত্ররা ভালো করে অক্ষর চিনতে পারছে না এবং চতুর্থ-পঞ্চম শ্রেণির ছাত্ররা অনেক সময় অক্ষর মিলিয়ে শব্দের উচ্চারণ করতে পারছে না। এটাই প্রমাণ করে যে, আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা বেহাল হয়ে পরেছে এবং দেশে ভালো শিক্ষকের অভাব রয়েছে।
কীভাবে ভালো শিক্ষক তৈরি করা যায় সেদিকে আমাদের মনোযোগ দেওয়া উচিত। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি স্কুল ভালো বিল্ডিংয়ের চেয়ে যেটা বেশি প্রয়োজন সেটা হচ্ছে ভালো শিক্ষক এবং পারিবারিকভাবে ভালো পরিবেশ। এগুলো যদি নিশ্চিত করা যায় তবে, আমাদের দেশে শিক্ষার মান উন্নত হবে পাশাপাশি সাংস্কৃতিক মান উন্নয়নের জন্য একটা লাইব্রেরী গড়ে তোলা জরুরি। আমাদের দেশে উপজেলায় যেসব লাইব্রেরী আছে সেখানে পর্যাপ্ত মানের বই নেই। যে সমস্ত বই পাঠাগারে থাকার কথা সেগুলো নেই। এমন অনেক বিষয় আছে যা স্বাধীনতার ৫৩ বছরে অগ্রগতি হয়নি। কারণ দুর্নীতির কারণে যে সম্পদ বিনিয়োগ হতে পারতো তা বিনিয়োগ না হয়ে ব্যক্তি বিশেষের হাতে চলে গেছে। দেশে তীব্র বৈষম্য বেড়েছে, যার ফলে উন্নয়ন অব্যাহত হচ্ছে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ, হতাশা এবং হতাশাগ্রস্ত হয়ে জীবনকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে। সব মিলিয়ে বলবো, আমাদের যেমন অর্জন আছে তেমনি আমরা অনেক কিছু করতে পরতাম যেটা করা সম্ভব হয়নি। পরিচিতি : অর্থনীতিবিদ। মুঠোফোনে মতামত গ্রহণ করেছেন রুদ্রাক্ষী আকরাম