বিশ্বাসের ব্যবসায় কি প্রোপাগান্ডা লাগেই?
মুজিব রহমান
প্রোপাগান্ডা শব্দটির উৎপত্তি হয়েছিল ১৬২২ সালে একটি ক্যাথলিক গির্জার একটি প্রশাসনিক কাঠামো থেকে। এর পুরো নাম ছিল কংগ্রেগেশিও ডে প্রোপাগান্ডা ফিদে অর্থাৎ বিশ্বাসকে ছড়িয়ে দেবার জন্য সংগঠন। এই প্রতিষ্ঠানকে অনানুষ্ঠানিকভাবে প্রোপাগান্ডা বলা হতো। তাদের কাজ ছিল অ-ক্যাথলিক দেশসমূহে ক্যাথলিক বিশ্বাসকে ছড়িয়ে দেয়া। এটি ছিল বক্তৃতা, প্রচারপত্র, পোস্টার, সংবাদপত্রে বিবৃতি, চলচ্চিত্র, ব্যক্তিগত ক্যানভাসিং, সংবাদ সম্মেলন ইত্যাদি মাধ্যমে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা বিস্তারের অন্যতম মাধ্যম। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণার নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য, অবস্থান অথবা রাজনৈতিক লক্ষ্য থাকে। এতে জনগণকে প্রভাবিত করার ও মনোভাব বদলে দেয়ার মনোবিজ্ঞানগত কৌশল থাকে। যার ফলে ওই উদ্দেশ্য বা লক্ষ্যের প্রতি জনসমর্থন তৈরি হয়। পোপাগাণ্ডা হচ্ছে এমন তথ্য যা বস্তুনিষ্ঠ হয় না। প্রাথমিকভাবে কোনো শ্রোতাকে প্রভাবিত করতেই ব্যবহৃত হয়। অন্যদের মতো খ্রিস্ট ধর্মও তাদের বিশ্বাস বিস্তারে সত্যকে আশ্রয় না করেই প্রচারণা চালাতো। একসময় এসব প্রতারণা মানুষ ধরে ফেলে। সেজন্যই শেষ পর্যন্ত তাদের কথাকে প্রোপাগান্ডা তথা মিথ্যাপ্রচারণা হিসেবেই ধরা হতে থাকে। সেখান থেকেই প্রোপাগান্ড মানে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মিথ্যা প্রচারণা হিসেবে গণ্য হতে থাকে। এগুলো এমন ধরনের পক্ষপাতমূলক ও ভ্রান্ত তথ্য যা একটি রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি বা উদ্দেশ্যের প্রচারণায় ব্যবহৃত হয়। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা সাধারণত আংশিক সত্য এবং আংশিক মিথ্যাকে মিশিল দিয়ে প্রচার করে। জনগণের আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গির কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন না আসা পর্যন্ত উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণার পুনরাবৃত্তি ঘটানো হয় এবং সব ধরনের প্রচার মাধ্যম ব্যবহার করা হয়। প্রোপাগান্ডার অর্থ হলো ছড়িয়ে যাওয়া। এর আভিধানিক অর্থ হলো যা ছড়িয়ে যায়। এসব প্রোপাগান্ডা করেই তারা খ্রিস্ট ধর্মের প্রসার ঘটায়।
প্রোপাগান্ডা সংগঠনটি অনবরত মিথ্যাচার করাতে, আজ মিথ্যা প্রচারের নামই হয়ে পড়েছে প্রোপাগান্ডা। যেমন সিরাজউদদ্দৌলার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে করতে মীরজাফর নামটির অর্থই দাঁড়িয়েছে বিশ্বাসঘাতক। ধর্মীয় সংগঠন ও ধর্মীয় বক্তাদের আজও একইরকম অবস্থাতেই দেখি। ইউরোপের মানুষ জ্ঞান-বিজ্ঞানে এগিয়ে যাওয়ায় তারা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানটির মিথ্যা প্রচারণা ধরে ফেলে এবং প্রশ্নের সামনে নিয়ে আসে। বাংলাদেশেও ধর্মীয় বক্তারা অনবরত মিথ্যা বলে। সেই ধারাবাহিকতাতেই প্রখ্যাত বক্তা তারেক মনোয়ার অনবরত মিথ্যা বলে যাচ্ছিল। তিনি অনায়াসেই দাবী করতেন যে, তিনি রকেটে চড়েন, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন, ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগে ফুটবল খেলেছেন ইত্যাদি। নির্বোধ লোকেরা মারহাবা ও ঠিক ঠিক ধ্বনি দিতো। কিন্তু বাংলাদেশেও এখন সচেতন মানুষ বেড়েছে। তারা তারেক মনোয়ারের লাগামহীন মিথ্যাচারকে নিয়ে ট্রল ও রোস্টিং করতে থাকে এবং প্রশ্নের মধ্যে ফেলে দেয়। তারেক মনোয়ার বাধ্য হয় মিথ্যা বয়ান থামাতে। মিজানুর রহমান আযহারীও ভয়ানকসব মিথ্যাচার করে যাচ্ছিল। তিনি কাতার থেকে কায়রো যাওয়ার পথে হিমালয় দেখার দাবি করেন। এমনকি নবী মোহাম্মদ সা.কে সিক্সপ্যাক ঘোষণা দেন। নবীর প্রথমা স্ত্রী খাদিজা রা.কে আন-ইনট্যাক ও নন-ভার্জিন বলে অশোভন মন্তব্য করেন। কিন্তু এসব মিথ্যাচার ও নিকৃষ্ট নিন্দাসূচক বক্তব্যের প্রতিবাদ হওয়ায় তিনিও থামতে বাধ্য হন। কাজী মো. ইব্রাহিম আরেক কাঠী সরেস। তিনি হাদিস গবেষণা করে ঘোষণা দেন, পৃথিবীর নিচে আরো সাতটি পৃথিবী রয়েছে। সেখানে সাতটি আসমান রয়েছে। হিটলার তার ২০ লক্ষ সৈন্য নিয়ে পৃথিবীর ভিতরে আরেক পৃথিবীতে চলে গিয়েছেন। তিন করোনা-ভাইরাস নিয়েও আজগুবি কথাবার্তা বলেন। আমির হামযা ঘোষণা দেন, মুসলমানদের করোনা হলে প্রমাণ হবে কোরান মিথ্যা। শুধু তারাই নন, ওয়াজের সকল বক্তাই বিস্তর আজগুবি কথাবার্তা দিয়ে শ্রোতাদের আকৃষ্ট করে থাকেন। কেউ প্রোপাগান্ডা চালিয়ে বলেন, নীল আর্মস্ট্রং চাঁদে ফাটা দাগ দেখেছেন বা চাঁদে আজান শুনে মুসলমান হয়েছেন। নীল আর্মস্ট্রং নিজে প্রতিবাদ করলেও তারা প্রোপাগান্ডা থামান না। চরমোনাইর মুরিদদের পুলসিরাত পার করতে নাকি হাশরের ময়দানে জাহাজ চলে আসবে। তাদের পূর্বপুরুষ নাকি ইরাক থেকে বাঘের পীঠে চড়ে এসেছে! তাদের এসব দাবি প্রোপাগান্ডা ছাড়া কিছুই নয়। তাও অনেকেই বিশ্বাস করে বসেন। তবে আজ দেশের মানুষ এসবকে মিথ্যা বলেই বক্তাদের রোস্ট করে দিচ্ছেন। চোখের সামনে ভেসে উঠছে সেই পোপাগান্ডা সংগঠনটির কথা।
আমাদের দেশেও ধর্মব্যবসায়ী বক্তারা যেভাবে অনবরত মিথ্যাচার করে যাচ্ছেন তাতে তাদেরও এমন কোন স্বীকৃতির মধ্যেই পড়তে হবে। তারাও যা বলেন তা সত্যের সাথে মিথ্যার মিশেলই। সেটা ওই প্রোপাগান্ডার মতোই। ধর্মীয় বক্তারা ধর্মসভাকে মিথ্যা বলার একটা জায়গা বানিয়ে নিয়েছেন। মানুষ যে মিথ্যা ধরে ফেলছেন তবুও তারা ইনিয়ে-বিনিয়ে প্রোপাগান্ডা চালাতে থাকেন। এর একটাই কারণ যে, মিথ্যা না বললে তারা বোকা লোকদের আকৃষ্ট করতে পারবেন না। বিশ্বাসের ব্যবসা যে, মিথ্যার উপর ভিত্তি করেই টিকে থাকে। লেখক : ব্যাংকার