সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ভূঁইয়া আশিক রহমান এতোটা হৈচৈ করে মার্জার করলে ব্যাংকিং খাতে আস্থার সংকট দেখা দিতে পারে : ড. আতিউর রহমান
[১] আমাদের অর্থনীতি : বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চার চ্যালেঞ্জ, তিন ঝুঁকি। বলছে বিশ্বব্যাংক। উচ্চমূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি, আমদানি নিয়ন্ত্রণ ও আর্থিক খাতের ঝুঁকির কথা বলছে তারা। এ ব্যাপারে আপনার অভিমত কী। তাদের ব্যাখ্যা কি যৌক্তিক?
ড. আতিউ রহমান, সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ : বিশ্বব্যাংক অর্থনীতির যেসব চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকির কথা বলছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। বিশেষ করে সামষ্টিক অর্থনীতির চ্যালেঞ্জগুলো খুবই বাস্তব। মূল্যস্ফীতির চ্যালেঞ্জটি এই মুহূর্তে আমাদের জন্য সবচেয়ে বড়ো সমস্যা। মূল্যস্ফীতি রাজস্ব নীতি বেশ খানিকটা সংকোচনমূলক করা সত্ত্বেও মূল্যস্ফীতি খুবই ধীর লয়ে কমছে। আমরা প্রথমে আশা করেছিলাম এটি জুন নাগাদ ৬ শতাংশে নেমে আসবে। পরে তা সংশোধন করে ৭.৫ শতাংশে ঠিক করলাম। কিন্তু এখন মনে হয় তা আগামী দু’মাসে ৯ শতাংশের নীচে নামানোই মুশকিল হবে। বিশ্বব্যাংক বলছে, আগামী অর্থবছরে তা ৮.৫ শতাংশে নামবে। দীর্ঘদিন এতো উচ্চ হারে মূল্যস্ফীতি বহাল থাকলে নির্দিষ্ট আয় ও কম আয়ের মানুষের জীবনচলা বেশ কষ্টকর হবে। এটা এমন এক সময়ে ঘটছে যখন দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও কমতির দিকে। চলতি অর্থবছরেও এই প্রবৃদ্ধি ৫.৬ শতাংশ হবে। তার মানে এ বছর বাড়তি বিনিয়োগ আশা করা যাচ্ছে না। অনেক কোম্পানি নতুন করে মানুষের চাকরি তো দেবেই না, বরং ছাটাইও করতে পারে। তাহলে মানুষের জীবনচলার উপায় কী? নিশ্চয় এসব মানুষের কষ্ট বাড়বে।
[২] উচ্চ মূল্যস্ফীতি থাকার ফলে আর্থিক খাত ও মানুষের আয়ে কি ঝুঁকির শঙ্কা বাড়ছে?
ড. আতিউর রহমান : উচ্চ মূল্যস্ফীতি বজায় থাকলে ব্যাংকে সঞ্চয় কমে যাবে। আর সঞ্চয় কমলে বিনিয়োগও কমবে। তাছাড়া মূল্যস্ফীতি বাগে আনতে সুদের হার আরও বাড়াতে হবে। তখন বিনিয়োগ আরও কমবে। ব্যাংক ঋণের পরিমাণও কমবে। তাই ব্যাংকের আয় কমবে। বেশি সুদের কারণে খেলাপি ঋণের পরিমাণও বাড়তে পারে। যাদের আয় বাড়ানোর সুযোগ কম তাদের কর্মচ্যুতির ঝুঁকিও থাকবে। সব মিলে সাময়িকভাবে দারিদ্র্যও বাড়তে পারে।
[৩] চলতি অর্থবছরে সরকার সাড়ে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে, কিন্তু বিশ্ব ব্যাংক বলছে ৫.৬ শতাংশ হবে। এর ফলে আর্থিক খাতে কী প্রভাব পরবে।
ড. আতিউর রহমান: এ বছর প্রবৃদ্ধি যে কমবে তা সবাই জানেন। বোঝেন। মূল্যস্ফীতি কমাতে হলে বাজেটের আকারও কমবে। তাই কর্মসংস্থান বাড়ানো যাবে না। এ বছর প্রবৃদ্ধি নয়, সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা অর্জনই হতে হবে বড় কাজ। আমার ধারণা এবারের বাজেটটি সেভাবেই বিচক্ষণতার সঙ্গে সাজানো হবে।
[৪] ব্যাংক একীভূত করার প্রক্রিয়ায় বিশ্বব্যাংক আরও সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছে। আপনি কি বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে একমত?
ড. আতিউর রহমান: হ্যাঁ, আমি একমত। আগে ঝুঁকিতে থাকা ব্যাংকগুলোর সম্পদ কতোটা মন্দ তা পরিমাপের জন্য দক্ষ অডিটর দিয়ে অডিট করাতে হবে। অডিটের পর সেই সম্পদ কীভাবে ওই ব্যাংকের ‘ব্যালেন্স শীট’ থেকে সরিয়ে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির কাছে বিক্রি করা হবে তা ঠিক করতে হবে। এরপর ওই ব্যাংককে হয় মার্জার বা অ্যাকুইজিশন করার প্রক্রিয়ায় ফেলা উচিত। আগে থেকেই এতোটা হৈচৈ করে মার্জার করলে ব্যাংকিং খাতে আস্থার সংকট দেখা দিতে পারে। তাই ধীরে সুস্থে সতর্কতার সাথে এগোনোর যে প্রস্তাব বিশ্ব ব্যাংক দিয়েছে সেটিই ভালো হবে।
[৫] জিডিপি অনুযায়ী আমাদের দেশে রাজস্ব আদায়ে ছাড় দেওয়া হচ্ছে, এর ফলে কি আর্থিক খাতে প্রভাব পরছে?
ড. আতিউর রহমান: আমাদের কর-জিডিপির হার এখন ৯ শতাংশের কম। আমাদের আশে পাশের দেশগুলোতেও এই হার এর চেয়ে অনেকটাই বেশি। তাই কর বাড়াতেই হবে। আরও বেশি করে প্রত্যক্ষ কর বাড়াতে হবে। আমদানি বিকল্প শিল্প গড়ার জন্য যেসব কর ছাড় দেওয়া হয়েছে তার একটা যৌক্তিক বিশ্লেষণ হওয়া দরকার। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বহাল রেখে বাকি ক্ষেত্রে এই ছাড় প্রত্যাহার করার প্রয়োজন রয়েছে। তবে খুবই সতর্কতার সঙ্গে এই ছাড় প্রত্যাহার করতে হবে।
[৬] আমাদের অর্থনীতির ঝুঁকি কতোটা কেটেছে বলে আপনি মনে করেন?
ড. আতিউর রহমান: আমাদের অর্থনীতির ঝুঁকি ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে। রপ্তানি আয় বাড়ছে। আমদানি তো আগেই কমেছে। প্রবাসী আয় যাতে বাড়ে সেজন্য বিনিময় হারকে আরও নমনীয় ও বাজার-নির্ভর করা গেলে এই ঝুঁকি আরও কমবে।
[৭] ডলার সংকট কি তাহলে কাটছে?
ড. আতিউর রহমান: ডলার সংকট কেটে যাচ্ছে। আগের চেয়ে বাজারে বেশি বেশি ডলার মিলছে। আরও বেশি ডলার প্রবাহ বাড়াতে বিনিময় হারকে বাজার-নির্ভর করা জরুরি হয়ে পড়েছে। আর তা করা গেলেই ডলার সরবরাহ বাড়বে। বৈদেশিক মুদ্রা বাজার স্থিতিশীল হবে।
[৮] শেয়ারবাজার নিম্নমুখী। এর জন্য কি অর্থনৈতিক পরিস্থিতি দায়ী, নাকি বিএসইসির পলিসি দায়ী?
ড. আতিউর রহমান: এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না।
[৯] ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা ঠেকাতে খুব সম্প্রতি সরকার চালের দর বেঁধে দিয়েছে। এতে কি চালের বাজার স্থিতিশীল থাকবে?
ড. আতিউর রহমান: বাজার অর্থনীতিতে সুদের হারই বলি আর চালের দামই বলি ঊর্ধ্বসীমা বেধে দিলে তা বাজার ভালোভাবে নেয় না। বাজারের যে ধর্ম তাতে চাহিদা ও যোগানের ভারসাম্য আনা গেলেই রক্ষা পায়। একথাটি মনে রেখেই বাজার ব্যবস্থাপনা করা শ্রেয়।
[১০] চালের সরবরাহ ঘাটতি আছে বলে অনেকেই মনে করছেন, যা সরকার স্বীকার করে না। ব্যবসায়ীরা জেনে গেছেন। ফলে ব্যবসায়ীরা সেই সুযোগ নিচ্ছেন। চালের সরবরাহ ঘাটতি কি আসলেই আছে? কী মনে হয় আপনার।
ড. আতিউর রহমান: বাজার ব্যবস্থাপনায় অনেক অংশীদার আছে। তাদের সবার সহযোগিতা না পেলে বাজারদর স্থিতিশীল করা মুশকিল। তাই চালের মজুত, প্রতিযোগিতার মাত্রা, সরবরাহ চেইনে প্রতিবন্ধকতা এবং বাজার-নির্ভর পদ্ধতির ওপর মনোযোগ দিয়ে এই সমস্যার সমাধান করা উচিত।
[১১] অন্য অনেক পণ্যের দামও সরকার নির্ধারণ করে দিয়েছে। পণ্যের দাম নির্ধারণ করে কি এর সুফল পাওয়া গেছে? ব্যবসায়ীরা তো মানছেন না কিছুই?
ড. আতিউর রহমান: যদি পর্যাপ্ত রেশনিং ব্যবস্থা ও সুনির্দিষ্ট দোকান বা সরবরাহ কেন্দ্র থাকে তাহলেই পণ্যের দাম নির্ধারণ করার সুফল পাওয়া যেতে পারে। বর্তমানে বাজারের যে কাঠামো ও বাস্তবতা তাতে দাম নির্ধারণ করে খুব বেশি সুফল মিলবে বলে মনে হয় না।
[১২] বাজার সিন্ডিকেট বলে কি আসলে কিছু আছে?
ড. আতিউ রহমান: বাজারে প্রতিযোগিতার অভাব দেখা দিলেই কতিপয়তন্ত্র মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। আর তখনই কয়েকটি সরবরাহকারী কোম্পানি নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে দাম ম্যানিপুলেট করে। আর এভাবেই সিন্ডিকেট শব্দটি দানা বেঁধেছে। আসলে এটি প্রতিযোগিতাহীনতার কুফল। তাই প্রতিযোগিতা কমিশনকে আরও দক্ষ ও ক্ষীপ্র হতে হবে।
[১৩] বাজার নিয়ন্ত্রণ জরুরি, নাকি বাজারে পণ্যের সরবরাহ বৃদ্ধি অপরিহার্যÑ কোনটা আগে করা দরকার।
ড. আতিউর রহমান: বাজার নিয়ন্ত্রণ নয়, বাজারের সুব্যবস্থা জরুরি। সরবরাহ বৃদ্ধি না করে বাজারে সুশৃঙ্খলা আনা মুশকিল হবে। তাই পথে পথে চাঁদা তোলা বন্ধ করা, বাজার পরিচালনা কমিটিকে আরও স্বচ্ছ ও জবাবদিহির আওতায় আনা, ই-কমার্সের সুযোগ বাড়িয়ে কতিপয়ের হাত থেকে বাজারকে পুনরুদ্ধার করা এখন সময়ের দাবি। বাজার সংশ্লিষ্ট সকল অংশিজনের মধ্যে সমন্বয় আরও নিবিড় করার কোনো বিকল্প নেই।