আমাদের ব্যাংক খাতে ৬ সমস্যা
ড. সেলিম জাহান
আমাদের অর্থনীতি একটা চাপের মুখে আছে। এটি এমন এক জায়গায় পৌঁছেছে, যে কারণে বিশেষজ্ঞদের মধ্যেও শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এ শঙ্কা সাধারণ মানুষের মধ্যেও কাজ করছে। বৈদেশিক মুদ্রার মজুদের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) দাবি করছে বাংলাদেশের বর্তমানে যে মজুদ আছে তা হচ্ছে ২০ বিলিয়ন ডলার বা ২ হাজার কোটি ডলার। এ মজুদ দিয়ে চার মাসের আমদানি করা যেতে পারে। সাধারণত আন্তর্জাতিক মুদ্রাভাণ্ডার বলে থাকে তিন মাসের আমদানি করা যাবে এমন পরিমাণে মজুদ থাকা দরকার। মজুদ থেকে আমাদের ঋণ শোধ করতে হবে, অন্যান্য দায় শোধ করতে হবে। সেটা করে যদি মজুদের পরিমাণ আরো কমে আসে তাহলে বুঝতে হবে আমরা চাপের মুখে আছি। বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস বা জ্বালানি তেলের দাম বাড়ছে, আয়-ব্যয়ের সামঞ্জস্য না হওয়ায় সাধারণ মানুষ চাপের মুখে আছে। এ চাপের ফলে নীতিনির্ধারক থেকে শুরু করে সবাই শঙ্কার মধ্যে রয়েছে।
মোটা দাগে যদি বলি, আমাদের ব্যাংক খাতে ছয়টি সমস্যা দেখি। একটা হলো অনাদায়ী বা খেলাপি ঋণ যেটির পরিমাণ বিশাল। আইএমএফ বলছে প্রতি চারটি ঋণের একটি খেলাপি। বস্তুত অর্থনীতির স্বাস্থ্যের অবস্থা সবল থাকলেও মোট ঋণের ২ বা ৩ শতাংশের বেশি খেলাপি হওয়া উচিত নয়। বাংলাদেশে সেটা ১০ দশমিক ১১ শতাংশ। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই ঋণ যদি অনাদায়ী থাকে তাহলে ব্যাংক খাতের আয়ে সেটা একটা প্রভাব ফেলবে। ব্যাংক খাতে নাজুকতা বেড়ে যাবে। এটি একটি বড় সমস্যা। দুই নম্বর হলো, ব্যাংক খাতে আয় ব্যয়ের হিসাবের ক্ষেত্রে নানা অব্যবস্থাপনা কাজ করে। ঋণের মধ্যে সুস্থ ঋণ ও বাজে ঋণ রয়েছে। বাজে ঋণগুলো যদি যথাযথভাবে হিসাব-নিকাশে উপস্থাপিত হয়, তাহলে ব্যাংক খাতে প্রকৃত চিত্রের বদলে অন্য রকম চিত্র ফুটে উঠবে। তৃতীয়ত, অনেকে বলছেন ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট আছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে আমাদের কোনো তারল্য সংকট নেই। ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার মতো অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ব্যাংকগুলোর কাছে যথেষ্ট পরিমাণে তারল্য নেই। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রতিদিন ১৫-২০ হাজার কোটি টাকা ধার করতে হচ্ছে। কলমানি বাজারে টাকা পাওয়া যাচ্ছে না। ৮-১০টি ব্যাংক সিআরআর-এসএলআর সংরক্ষণ করতেও ব্যর্থ হচ্ছে। এ অবস্থায় আরো ঋণ গ্রহণ করা হচ্ছে। ফলে পুরো ব্যাপারটির মধ্যেই ভঙ্গুরতা কাজ করছে। চতুর্থত হলো ব্যাংকিং ব্যবস্থার মধ্যে জালিয়াতি রয়েছে। অর্থাৎ ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করে লাপাত্তা, পুরো ঋণ লোপাট হয়ে যাচ্ছে। কিছুদিন আগে খবর বেরিয়েছিল দেশের ব্যাংক খাত থেকে নামসর্বস্ব কিছু প্রতিষ্ঠান হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে, যেগুলোর কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। ভবিষ্যতে এসব ঋণ আদায় হওয়ার কোনো সম্ভাবনাও নেই। এমনটি অব্যাহত থাকলে ব্যাংকিং ব্যবস্থার সুশাসন ব্যাহত হবে। শেষ কথা হলো, ব্যাংকিং ব্যবস্থা যেহেতু অর্থের সঙ্গে জড়িত সেহেতু এখানে উচ্চস্তরের দায়বদ্ধতা থাকা উচিত। সেটা নিশ্চিত করা এবং বিধি-নিষেধগুলো ঠিকমতো চালিত করা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্ব। বহু ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণের আওতার মধ্যে আনা দরকার কিন্তু আনা যাচ্ছে না। এটির সঙ্গে সুশাসনের বিষয়টি জড়িত। ব্যাংক প্রতিষ্ঠা বা ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক প্রভাব বা বিবেচনা কাজ করে। এর মাধ্যমে বহু ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে ব্যাংক স্থাপনের সুযোগ দেয়া হয়েছে যেসব ব্যাংকের সবল ভিত্তি নেই। বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে যারা দুর্বল ব্যাংক এবং যারা বিধিনিষেধ মানছে না এমন ব্যাংক তাদের বিরুদ্ধে কোনো রকম ব্যবস্থা না নেয়া এবং তাদের বন্ধ করে না দেয়া বা নতুন কোনো ব্যাংক রাজনৈতিক কারণে স্থাপনের অনুমতি দেয়া এগুলোর কোনোটাই নেই। এটি না হওয়ার কারণে আমরা ব্যাংক খাতে সুশাসনের অভাব দেখছি এবং এটি শুধু দেশের অভ্যন্তর থেকে বলা হচ্ছে এমনটিও নয়। আইএমএফসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বলছে যে এখানে সুশাসনের অভাব রয়েছে। আমি মনে করি, ব্যাংক খাতে কাঠামোগত সংস্কারের দরকার আছে এবং অত্যাবশ্যক এবং এটা এখনই করতে হবে। কারণ ব্যাংকিং ব্যবস্থায় যদি সুশাসন না আসে তাহলে এ খাতে গ্রাহক বা সাধারণ মানুষের আস্থার জায়গাটা যদি নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে কিন্তু অর্থনীতির ভিত দুর্বল হয়ে যাবে। আমরা খবরে দেখি, কোন ব্যাংকগুলো আস্থাভাজন বা জনগণ কোন ব্যাংকগুলোর ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। এটা তো অত্যন্ত ভঙ্গুর একটি পরিস্থিতি। ব্যাংকিং ব্যবস্থা সেটা বড় ব্যাংক বা ছোট ব্যাংক হোক আমি যদি তার গ্রাহক হিসেবে আস্থা না পাই, যদি শঙ্কার মধ্যে থাকি, তাহলে একটা বড় ধরনের ধস নামতে পারে। এটা দীর্ঘদিন ধরে অর্থনীতিবিদ, শিক্ষিতজন, নীতিনির্ধারকরা বলে আসছেন।
লেখক : ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র