বিতর্কিত গোল্ডেন রাইসের অনুমোদন কৃষি ও কৃষকের সর্বনাশ হবে
ফরিদা আখতার
নতুন করে আবার জেনেটিকালি মডিফাইড ধান গোল্ডেন রাইস বা বিকৃত ধান প্রবর্তনের জন্য জোর প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে। পত্রিকার মাধ্যমে জানা গেছে যে গোল্ডেন রাইস এর কৃষক পর্যায়ের চাষের অনুমোদনের জন্য তৎপর হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) ও আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ইরি) কর্তা ব্যক্তিরা। এই ধানের জাতটি রিলিজ দেয়ার লক্ষ্যে নতুন কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুস শহীদের সাথে ৪ মার্চ তারা বৈঠক করেছেন। আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান (ইরি)’র ঐবধষঃযরবৎ জরপব এর প্রজেক্ট লিড জঁংংবষ জবরহশব এর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে জিএমও গোল্ডেন রাইস অবমুক্তির বিষয়ে কৃষিমন্ত্রীর সহযোগিতা কামনা করেছে। কৃষি মন্ত্রী তাদের এ বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়েছেন। এই বৈঠকে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি)-র মহাপরিচালক শাহজাহান কবীরও উপস্থিত ছিলেন। মূলত ইরি ও মার্কিন দাতব্য সংস্থা বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের সহায়তায় ব্রি বিশেষ জাতের ধান গোল্ডেন রাইস বানিয়েছে। (নিউজ লিংক কমেন্টে দেয়া আছে)। উল্লেখ্য ইরির নেতৃত্বে খোদ ইরির প্রধান সহ ২০১৯ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশ এসেছিলেন। তখনও ডিসেম্বর ২০১৮ এর নির্বাচনের পর জানুয়ারি মাসে নতুন ভাবে সরকার গঠিত হয়েছিল এবং ড. আব্দুর রাজ্জাক নতুন কৃষি মন্ত্রী হয়েছিলেন। তাকে গোল্ডেন রাইস প্রবর্তনের উদ্যোগ নেয়ার জন্য আহবান জানানো হয়েছিল। এবারও ৭ জানুয়ারি ২০২৪ এ নির্বাচনের পর মন্ত্রী সভায় কৃষি মন্ত্রণালয়ের নতুন দায়িত্ব পেয়েছেন ড.আব্দুস শহীদ। এবার তার কাছে ধরণা বা চাপ দেয়ার জন্য ?
গোল্ডেন রাইস একটি জেনেটিকালি মডিফাইড ফসল। যেহেতু তার স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক গঠন সংকেতে ভিন্ন জিন জবরদস্তি প্রবিষ্ট করানো হয়েছে তাই এই ধান বিকৃত ধান হিশাবে পরিচিত। তবে কৃষি মন্ত্রণালয় এর গবেষণার সাথে যুক্ত থাকলেও ছাড়পত্র দিতে হবে পরিবেশ মন্ত্রণালয়কে। ২০১৭ সাল বা প্রায় ৭ বছর আগে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের ন্যাশনাল কমিটি অন বায়োসেফটির ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করেছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান (ব্রি)। এই ধানের স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সংক্রান্ত ঝুঁকি, কার্যকারিতা এবং বিকৃত ধানের আদৌ কোন প্রয়োজনীয়তা আছে কি না এই সব প্রশ্নের উত্তর এখনো পাওয়া যায় নি তাই এর অনুমোদন দেয়া যাচ্ছে না। আমি পরিবেশ মন্ত্রণালয়কে ধন্যবাদ জানাচ্ছি যে তারা সময় নিয়ে এর নিরাপত্তার দিক বিবেচনা করছেন। কিন্তু কোম্পানি এবং উদ্যোক্তাদের তাড়া আছে। তারা সরাসরি সরকারের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে চাইছেন। গোল্ডেন রাইসের মধ্যে ব্রি ধান ২৯, ফিলিপাইনে অবস্থিত আই আর-৬৪ (ওজ-৬৪), এবং ফিলিপাইনের একটি জাত জঈ-২৮ এর সাথে ভুট্টার জিন ঢুকিয়ে বিটা কেরোটিন যা ভিটামিন এ সৃষ্টি করা হয়েছে। ধানটির চাল সোনালী রংয়ের বলে এর নাম গোল্ডেন রাইস। এর পেটেন্টধারি কোম্পানি হচ্ছে সিনজেন্তা। বাংলাদেশের অধিকাংশ কৃষক ব্রি-২৯ চাষ করেন। সেখানে কোন পেটেন্ট নাই। কৃষক এর বীজ নিজেই রাখে কিংবা বাজার থেকে কিনে নেয়। স্বাধীনভাবে তারা এই ধান চাষ করতে পারে। তাহলে এই ধানের স্বত্ত্ব বিদেশী কোম্পানির হাতে চলে গেলে বাংলাদেশের লক্ষ কোটি কৃষকের ভাগ্যে কি ঘটবে? এই প্রশ্নের জবাব কৃষি মন্ত্রণালয়কে অবশ্যই দিতে হবে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের কাজ বাংলাদেশের কৃষি এবং কৃষকের স্বার্থ দেখা, কোম্পানির স্বার্থ নয়।
গোল্ডেন রাইস সারা বিশ্বে বিতর্কিত। ফিলিপাইনে অনুমোদন দেয়া হয়েছে বলা হলেও সেখানে এর বিরুদ্ধে ফিলিপিনো কৃষকরা ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। কাজেই ফিলিপাইনের উদাহরণ দিয়ে বাংলাদেশে অনুমোদন নেয়ার কোন অর্থ নাই।
বাংলাদেশ বৈচিত্র্যপুর্ণ ধানের দেশ। এখানে হাজার হাজার জাতের ধান উৎপাদন হয়। আধুনিক কৃষি এসে আমাদেরকে ইউরিয়া সার-কীটনাশক নির্ভর ধান (নানা রকম ইরি ধান) ধরিয়ে দিয়ে এবং গালভরা সবুজ বিপ্লব ও উচ্চ ফলনশীলতার তত্ত্ব দিয়ে আমাদের পুরো খাদ্য ব্যবস্থাকে বিষাক্ত করে দিয়েছে। ধানের মৌসুম বদলে দিয়েছে, আগে আমন ধান ছিল ধানের মূল মৌসুম এখন মাটির তলার পানি তুলে সেচ নির্ভর বোরো ধান চাষ করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এরই মধ্যে সারা বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানীয় জাতের ধানের চাষ নিরুৎসাহিত করে প্রবর্তন করা হচ্ছে উফশী (ইরি), হাইব্রীড (কোম্পানি এবং ব্রি) এবং এখন আনা হচ্ছে জেনেটিকালি মডিফাইড বা বিকৃত ধান তথা কথিত গোল্ডেন রাইস।
বাংলাদেশের ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল ধান বিআর-২৯ এর মধ্যে জেনিটিক কারিগরি করে ডেফোডিল ফুলের বিটা কেরোটিন স্থাপন করে প্রথম এই জিএম (বা বিকৃত) গোল্ডেন রাইস প্রবর্তনের চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু এই প্রচেষ্টা সফল হয় নি। তাই দ্বিতীয় পর্যায়ে ডেফোডিলের পরিবর্তে ভুট্টা থেকে বিটা কেরোটিন ব্রি ধান ২৯ এর মধ্যে ভিটামিন-এ ঢোকানো হয়েছে। এই চেষ্টার সফলতা বা ব্যর্থতার কোন নিরপেক্ষ মূল্যায়ন হয় নি।
দাবি করা হচ্ছে এবং প্রচারনা চালানো হচ্ছে গোল্ডেন রাইস ভিটামিন-এ সমৃদ্ধ। বলা হচ্ছে এর মধ্যে কেরটিনয়েড রয়েছে এবং মানুষের শরীরে হজম হতে গিয়ে এটা ভাঙ্গে এবং ভেঙ্গে ভিটামিন এ-তে রূপান্তরিত হয়। এটা অনুমান। যদি অনুমান সত্যি ধরেও নেয়া হয় তাহলে জানতে হবে এই ভাত খেলে কী পরিমান কেরোটিনয়েড ভাত থেকে আলাদা করে শরীর গ্রহণ করতে পারে এবং তা ভেঙ্গে তার রূপান্তর ঘটিয়ে কী পরিমান ভিটামিন এ বানাতে সক্ষম হয়। গোলডেন রাইস খাইয়ে দিলেই সেটা আপনাআপনি ভিটামিন-এ হয়ে যাবে না। অথচ গোল্ডেন রাইসের সংযোজিত কেরোটিনয়েড কিভাবে এবং কি পরিমাণ ভিটামিন-এ হিসাবে মানুষের শরীর বানাতে পারবে সেই গোড়ার তথ্যের জায়গাতেই উপাত্তের অভাব রয়েছে। আরও তথ্যের দরকার যেমন এই বিকৃত ধান ঘরে রাখলে, গুদামজাত করলে এবং রান্নার পরে শেষ পর্যন্ত কি পরিমান কেরোটিনয়েড টিকে থাকবে? সেটাও জানার বিষয়। অথচ এই বিষয়ে কোনো উপাত্ত এখনো নেই। সেই তথ্য উপাত্ত ঠিক না করেই তারা ছাড়পত্রের জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। এটা যেন শুধু একটা কাগজের ব্যাপার। এর সাথে পরিবেশ, স্বাস্থ্য, কৃষকের অধিকার সব কিছু অঙ্গাঙ্গি জড়িত। ছাড়পত্র দিলেই সেসব নিশ্চয়তা মিলবে না।
বিল এন্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশান এই গোল্ডেন রাইসকে পুষ্টির একটি মাধ্যম হিশেবে দিয়ে দাতব্য ভাব দেখাতে চাচ্ছে। তারা দাবি করছে ভিটামিন-এ ঘাটতি এবং রাতকানা রোগের জন্য এই ধানের ভাত খেতে হবে। কিন্তু বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে ভিটামিন-এ পাওয়ার উৎস আমাদের খাদ্য ব্যবস্থার মধ্যেই আছে। বাংলাদেশ পুষ্টিবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় দেখা যায় নানা রকম কুড়িয়ে পাওয়া শাক যেমন কাঁটানটে, কলমি, সাজনা পাতা এবং আবাদী ফসল যেমন মিষ্টি কুমড়া, মিষ্টি আলু, পুঁইশাক, সীম, ঢেঁড়শ, ডাটার মধ্যে প্রচুর ভিটামিন-এ আছে। ফলের মধ্যে পাকা পেপে, বাংগি, কাঠাল, আম, কলা, আনারস সহ হলুদ রংয়ের ফল গুলোতে ভিটামিন-এর কোন অভাব নেই। ঢেঁকি ছাটা চালে ভিটামিন-এ পাওয়া যায়। তাহলে কেন আমরা অহেতুক আমাদের একটি প্রচলিত ধান ২৯ কে কোম্পানির হাতে তুলে দেব এবং পুষ্টির ভার দিয়ে দেবো বিল এবং মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশানকে? গ্রামের সাধারণ গৃহবধুরাই তাদের পরিবারের জন্য প্রয়োজনীয় এই খাদ্য সংগ্রহ করতে পারেন।
সবচেয়ে হাস্যকর হচ্ছে গোল্ডেন রাইসের মাধ্যমের ভিটামিন-এ-র এই দৈনিক চাহিদা মেটাতে হলে দৈনিক ৪০০ মাইক্রোগ্রাম রেটিনল খেতে হবে। এই ফলাফল পাওয়া যাবে যদি ঐ চালে প্রতি গ্রামে ২০ থেকে ৩০ মাইক্রোগ্রাম কেরোটিনয়েড থাকে। গোল্ডেন রাইস ১ এর ফলাফল ছিল দৈনিক দেড় কেজি ভাত খেতে হবে, গোল্ডেন রাইস ২ এ ভিটামিন এ এর কনশেনট্রেশান বাড়ানো হলেও এখনো বাস্তবতার সাথে এর কোন মিল নাই।
বিকৃত ধানের চাল থেকে শরীরকে যদি কেরোটিনয়েড গ্রহণ করতে হয় তাহলে তেল বা স্নেহ জাতীয় পদার্থ যেমন মাখন বা চর্বির প্রয়োজন পড়ে। এটা অস্বাভাবাবিক ভাত খাওয়ার পদ্ধতি। বাংলাদেশের বাস্তবতায় কি তাহলে মাখন দিয়ে গোল্ডেন রাইস খাওয়াবার ব্যবস্থা করতে হবে? যেখানে সামান্য পেঁয়াজ পাওয়া যায় না, সেখানে প্রতি বেলা ভাতের সাথে তেল বা মাখন খাওয়া কি হাস্যকর প্রস্তাব নয়?
ভিটামিন-এ ঘাটতির কারনে রাতকানা রোগ হয় ঠিক কিন্তু এখনো এই সমস্যা খুব বড় ধরণের পুষ্টি ঘাটতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় নি যে সাধারণ ব্রি-২৯ ধানকেই হলুদ বানিয়ে দিতে হবে! ক্লিনিকাল সমস্যা হিশেবে ভিটামিন-এ ঘাটতি দেখা দিলে সেটার চিকিৎসাও আছে। ব্রি-২৯ ধানকে ভিটামিন-এ সমৃদ্ধ করা হলে তা সকল মানুষ খাবে, যার ঘটাতি নাই সেও খাবে। তাহলে সেটা কি সঠিক হবে, নাকি ব্রি-২৯ ধানকে এখন ওষূধ হিশেবেই রেখে দেয়া হবে। তাহলে মানুষ স্বাভাবিক খাবার হিশেবে কোন ধান খাবে?
বাংলাদেশের মানুষ তাদের ক্যালোরী গ্রহণের ৭০ শতাংশ ভাগই পান ভাত থেকে। যারা পুষ্টি অভাবে দৃষ্টি শক্তির ক্ষতি হয় তাদ্রে প্রধান পরামর্শ হচ্ছে খাদ্যকে বোচিত্রপুর্ণ করা। শুধু ভাত খেয়ে কখনোই পুষ্টি ঘাটতি দূর হবে না।
মনে রাখতে হবে আমরা ভেতো বাঙ্গালী বটে কিন্তু শুধু ভাত খাই না। ভাতের সাথে শাক-সব্জি ছোট মাছ, একদম কিছু না থাকলে একটু মরিচের ভর্তা দিয়ে হলেও খাই। কোম্পানি শুধু দেখে আমাদের পেট আছে, কিন্তু এই পেটে খাদ্য যেতে হলে জিহ্ববা ছুঁইয়ে যেতে হবে। আর বাংলাদেশ ছোট দেশ হলে কি হবে? এলাকা ভেদে খাওয়ার ধরণ ও পছন্দ আলাদা। তাহলে ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে যদি স্বাদ না লাগে তাহলে কোনদিন এই খাদ্য গ্রহণযোগ্য হবে না। ওষূধ হিশেবে নিম তিতাও খাওয়া যায়। কিন্তু নিয়মিত খাদ্য স্বাদ ছাড়া গ্রহণ করা যাবে না। কাজেই ভিটামিন-এ ঘাটতি যা আছে তা সমাধানের পথ হচ্ছে শাক-সব্জির বৈচিত্র্য বাড়িয়ে দেয়া। বাংলাদেশে এককাট্টা কিছু চালিয়ে দেয়া অত সহজ নয়।
ভিটামিন-এ সমৃদ্ধ করার প্রক্রিয়াটা হয়েছে জেনেটিক ইঞ্জিনীয়ারিং এর মাধ্যমে। তাহলে আর সব জিএম ফসলের মতোই গোল্ডেন রাইস ও অজানা ক্ষতির শংকামুক্ত নয়, এবং এর মধ্যে বৈজ্ঞানিক গবেষণার সকল নৈতিক শর্ত মানা হয়েছে কিনা এবং আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলোর মধ্যে পরিবেশ ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্যে যে ব্যবস্থা ছিল তাও মেনে চলা হয়েছে কিনা আমাদের জানা নেই। আজ পর্যন্ত কোন প্রতিবেদনে গোল্ডেন রাইস গবেষণার প্রাথমিক ফলাফল তুলে ধরে পরিবেশবাদী এবং স্বাস্থ্য কর্মীদের আশ্বস্থ করা হয়নি।
আশা করছি পরিবেশ মন্ত্রণালয় সব বিষয়গুলো ভাল ভাবে পরখ করবেন। পরিবেশ মন্ত্রী হিশেবে দায়িত্ব পেয়েছেন সাবের হোসেন চৌধুরি, যিনি পরিবেশ বিষয়ে যথেষ্ট সংবেদনশীল। তার কাছ থেকে বাংলাদেশের জন্যে ক্ষতিকর কোন কিছু আমরা আশা করি না। লেখক : নয়াকৃষি আন্দোলনের নেত্রী