দেশের শেয়ারবাজারকে ঘিরে আবারও অসাধু চক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে?
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
দেশের শেয়ারবাজারকে ঘিরে একটা অসাধু চক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে বলে আশঙ্কা করছে অনেকেই। কারণ গত দেড় মাস ধরে ভয়ংকর মন্দা চলছে বাজারে। প্রথম আলোর এক প্রতিবেদন পড়লাম টানা দরপতনে মাত্র ৪৮ কার্যদিবসে শেয়ারবাজারে দেশের প্রধান বিনিয়োগকারীদের ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। ডিএসই’র হিসাব অনুযায়ী গত ১৮ জানুয়ারি বাজারে মূলধন ছিলো ৭ লক্ষ ৮৭ হাজার ৯শ ৫ কোটি টাকা, যা ১ মার্চ সোমবার কমে দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৭৭ হাজার ৬শ ৭৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ, ৪৮ দিনে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা বা তার চেয়েও বেশি বাজারমূল্য হারিয়েছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালকের সঙ্গে কথা হলে জানতে পেরেছি যে, বর্তমান শেয়ারবাজার পরিস্থিতি ভয়ংকর এবং উনারও প্রায় ৩ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। শেয়ারবাজারে টানা দরপতনের কারণে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে চরম হতাশা বাসা বেঁধেছে, যার ফলে অনেকেই বাজার ছেড়েছেÑ এটাও পতনের কারণ। ২১ জানুয়ারি থেকে শেয়ারবাজারে নিয়ন্ত্রক সংস্থা, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশন কয়েক ধাপে ফ্লোর প্রাইস তুলে নেয় যার প্রভাব পরেছে শেয়ারবাজর। প্রায় দেড় বছর শেয়ারবাজারকে সীমাবদ্ধ রাখতে কৃক্রিমভাবে ফ্লোর প্রাইসকে আটকে রেখেছিলো। কিন্তু প্রাইজ ওঠে যাবার পর থেকে বাজারকে আর নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। বিনিয়োগকারীরাও বাজার ছেড়ে দিচ্ছে আগেও ছেড়েছে। কিন্তু ১০ কার্যদিবসে প্রায় ৩৪ হাজার বিও একাউন্ট খালি হয়েছে এবং নতুন বিও একাউন্ট খুলেছে মাত্র ২ হাজার। সুতরাং বলা যায় যে, সার্বিক শেয়ারবাজার পরিস্থিতির কারণে বিনিয়োগকরীর আস্থা ও আগ্রহ একেবারেই ওঠে যাচ্ছে।
শেয়ারবাজারের দরপতনে মানুষ বিনিয়োগ বন্ধ করে ফোর্সড সেল করে বর্তমানে ব্যাংকমুখী হচ্ছে, যার ফলে শেয়ারবাজার বিনিয়োগকারী হারাচ্ছে। এ সকল বিনিয়োগকারীরা ব্যাংকে অতিরিক্ত মুনাফার লোভেই ব্যাংকের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এছাড়াও অনেকদিন ধরে মার্জিন ঋণের বিষয়ে কথা হচ্ছে। কিন্তু এ নিয়ে কারোর মাথা ব্যাথা নেই, তাই কোনো সমাধান নেই। বিনিয়োগকারীরা তাদের শেয়ার বিক্রি করতে না পারলেও তাদের ঋণের বোঝা বাড়ছে। তার সুদ বাড়ছে, যা তাদের পরিশোধ করতে হবেই। যারা ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করেছে তারা সমস্যায় আছেন এমনকি মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাইজগুলো। অর্থাৎ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান উভয়ই মার্জিন ঋণের চাপে আছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালক মনে করেন মার্চেন্ট ব্যাংকের যে ঋণ দেওয়ার নিয়ম তা বাজার থেকে তুলে দেওয়া উচিত। মার্জিন ঋণের সুদ অনেক বেশি শেয়ারবাজারের জন্য ঝুঁকি ডেকে আনে বিনিয়োগের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। মার্জিন ঋণ শোধ করার জন্য অনেকেই তাদের জমি বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছে। মানুষ আর্থিকভাকে সচ্ছল থাকার আশায় মার্জিন ঋণ নিয়ে থাকে। এ ঋণ নেশার মতো, তাই নেশা চড়ে বসলে মানুষের সুদের হারের কথা মনে থাকে না নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বন্ড ছাড়ার অনুমতি পেয়েছে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত বেক্সিমকো কোম্পানি লিমিটেড। গাজীপুরের একটি আবাসন প্রকল্প উন্নয়নের কাজে বিনিয়োগ করার জন্য ২ হাজার ৬শ ২৫ কোটি টাকার বন্ডের অনুমোদন পেয়েছে। বন্ডটির প্রতি লটের দাম হবে ৫০ হাজার টাকা এ বন্ড ইস্যু করে অর্থ উত্তোলন করে ঋণ পরিশোধ করবে। বন্ডের ট্রাস্টি হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে বীমা কোম্পানি, সন্ধানী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মালিক বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টুটু তিনি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাবেক সভাপতি ছিলেন এবং ম্যানেজারের দায়িত্বে থাকবে সালমান এফ রহমানের আইএফইসি ব্যাংক লিমিটেড। আমাদের মনে থাকার কথা অনেক দিন ধরে আইএফইসি ব্যাংক আমার বন্ড চালু করেছিলো। গাজীপুরের একটি আবাসন প্রকল্পে তহবিল সংগ্রহের জন্য চোখ ধাঁধাঁনো রিটার্ন দিয়ে বন্ড ইস্যু করে এ রিয়েল ইস্টেট কোম্পানিটি। তবে, ১০০ হাজার কোটি তোলার জন্য বন্ডটি বিনিয়োগকারীদের কাছে উপস্থাপন করা হয়েছে তা নিয়ে অনেকের মনেই প্রশ্ন উঠেছিলো। আইএফইসি ব্যাংক বন্ড ইস্যু না করলেও সালমান এফ রহমানের নামে চালানো হয়েছে। ২০২১ সালেও বেক্সিমকো কোম্পানি লিমিটেড ইসলামি বন্ড ছেড়ে শেয়ারবাজার থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা তুলেছিলেন।
শেয়ারবাজারে বর্তমানে মন্দা যাচ্ছে বিনিয়োগকারীদের সামনের কী হবে তা জানা নেই। উচ্চ প্রবৃদ্ধির দেশে শেয়ারবাজার উল্টো পথে হাঁটছে। শেয়ারবাজারকে স্থিতিশীল রাখতে সরকারের পক্ষ থেকে তেমন কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখছি না। এছাড়াও টানা দরপতনের কারণে শেয়ারবাজার থেকে বিনিয়োগকারীর আস্থা কমে যাচ্ছে, যার ফলে বিনিয়োগের সংখ্যা কমে গেছে। লেনদেন পরিচালনার কোম্পানিগুলো লোকসানে আছে। বর্তমানের শেয়ারবাজার পরিস্থিতি মানুষের মনে আশংকা তৈরি করেছে যে, ১৯৯৬ ও ২০১০ সালের মতো ধসের পথে কী তবে এবারো শেয়ারবাজারে ধস নেমে আসবে?
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক। সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ফেসবুক পেজের ভিডিও কনন্টেন্ট থেকে শ্রুতিলিখন করেছে রুদ্রাক্ষী আকরাম