ভারতীয় পণ্য বর্জন ক্যাম্পেইন আসলে কার?
মাসুদ কামাল
ভারতীয় পণ্য বর্জনের আন্দোলন নিয়ে আমি মাঝে মাঝে একটু দ্বিধায় পড়ে যাই যে এই অন্দোলনটা আসলে কে করছে! এই আন্দোলন কি দেশের সাধারণ জনগণ করছে, অথবা এই আন্দোলন কি সোশ্যাল মিডিয়া থেকে এসেছে, কিংবা বিএনপি করছে, নাকি আওয়ামী লীগ করছে! আমি যতদূর জানি এই আন্দোলনটা প্রথমে শুরু হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে। তারপর সোশ্যাল মিডিয়ার এই আন্দোলনকে এদেশের মানুষ গ্রহণ করেছে এবং এখন তারা এটা তাদের মতো করে চালাচ্ছে। সাধারণ মানুষেরদেরও সবাই করছে না। তবে আমার জানা মতে, আমি যতদূর দেখেছি বেশিরভাগ মানুষই এই আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত হয়ে পরেছে।
এই আন্দোলনটা শুরু হয়েছে জানুয়ারির দিকে। নির্বাচনের পর যখন সাধারণ মানুষ দেখলো ভারত সরকার বাংলাদেশের জনগণকে নয় বাংলাদেশের একটি সরকারি দল, অর্থাৎ আওয়ামী লীগকে সমর্থন করছে এবং আওয়ামী লীগের ইচ্ছামতো তারা নির্বাচনে সমর্থন দিয়েছে; তখন সাধারণ মানুষের মনে ভারতের বিরুদ্ধে একটা ক্ষোভ তৈরি হয়। সেই ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ ভারতীয় পণ্য বয়কটের এই ক্যাম্পেইন। এই ক্যাম্পেইনকে বিএনপি সমর্থন দিয়েছে মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ে এসে। বিএনপিও দেয়নি। বিএনপির একজন নেতা মার্চ মাসের মাঝামাঝি এসে বলেছেন তিনি এই আন্দোলনকে সমর্থন করেন। তারপর বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এটা নিয়ে দ্বিধা প্রকাশ করেছে। এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য তারা তাদের স্থায়ী কমিটির সঙ্গে মিটিং করেছে। সেই মিটিংয়ে তারা কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে না পেরে তারা বলেছেন, আগামী মিটিংয়ে তারা সিদ্ধান্ত নেবেন।
সেই পরের মিটিং এখনো আর হয়নি। ফলে বিএনপি এই আন্দোলন সমর্থন করেছে এটা বলার কোনো সুযোগ নেই। বিএনপির কিছু কিছু নেতার এই আন্দোলনের প্রতি একধরনের দুর্বলতা আছে। বিপরীত দিকে সরকার কী করেছে। রুহুল কবির রিজভী যখন এই আন্দোলন সমর্থন করেছেন, তারও আগে ওবায়দুল কাদের এই আন্দোলন নিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছেন। তিনি এই আন্দোলন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছেন, আবার বিএনপির ওপর চালিয়ে দিয়েছেন। এই আন্দোলন সফল হচ্ছে নাÑ এমনটিও বলেছেন। কিন্তু বিএনপির পক্ষ্য থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এই আন্দোনে সমর্থন না দেওয়া সত্ত্বেও আমরা দেখছি, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে লাগাতারভাবে এই নিয়ে কথা বলছেন।
ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপি নেতাদের শোবার ঘরে, রান্না ঘরে ভারতীয় পণ্য আছে। তিনি আরও বলেছেন, বিএনপি ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দিয়েও ব্যর্থ। বিএনপি নেতাদের শোবার ঘরে, রান্না ঘরে ভারতীয় পণ্য। তথাকথিত এই ডাক (ভারতীয় পণ্য বর্জন) ভাওতাবাজি, এই ভাওতাবাজির অবসান হয়েছে। এখন আমার প্রশ্ন হলো বিএনপি নেতাদের শোবার ঘরে, রান্না ঘরে যে ভারতীয় পণ্য এটা তিনি কী করে জানলেন? তিনি কি গিয়ে দেখে এসেছেন? এই সমস্ত কথা যদি একজন জাতীয় নেতার কণ্ঠে আসে তাহলে সেই নেতার রুচি নিয়ে সন্দেহ হয়। আমি মনে করি এ ধরনের কথা বলার মাধ্যমে তিনি সাধারণ মানুষের সেন্টিমেন্টকে অপমান করেছেন।
যুবলীগের একজন নেতা শেখ পরশ। তিনি আরেক অনুষ্ঠানে গিয়ে বলেছেন, ভারতীয় পণ্য বর্জন আন্দোলন উগ্র জাতীয়তাবাদী চিন্তার প্রতিচ্ছবি। উনার মতো একজন শিক্ষিত ব্যক্তি কীভাবে এ ধরনের কথা বলেন আমি জানি না। কেউ বাজারে কিছু কিনতে গেলে সে বাজারের কোন পণ্য বা কোন দেশের পণ্য কিনবে সেটা তার রুচির উপন নির্ভর করে। আমি যদি আমেরিকার কোনো পণ্য না কিনি তাহলে কি সেটা উগ্র জাতীয়তাবাদের পরিচয় হয়ে গেলো? তিনি আবার লজিক দিয়েছেন। সেটা হলো, মুক্তিযুদ্ধের সময় যেই ভারত আমাদের শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে, অস্র-প্রশিক্ষণ দিয়ে সাহায্য করেছে, বিএনপি-জামায়াত এখন তাদের বিরুদ্ধাচারণ করছে। মুক্তিযুদ্ধে তো অনেকে সাহায্য করেছে। তখন কী করেছে সেটি নিয়ে আপনি এখন বসে থাকবেন? মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বঙ্গবন্ধুও তো অনেক কিছু করেছেন। তার সব কথা কি আপনারা শুনেন? বঙ্গবন্ধু কি কখনো ৩০ লাখ টাকা দামের ঘড়ি পরেছেন, যেটি বর্তমান আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক পড়েন? তার এমন ঘড়ি ১৫-২০টি আছে। আমি মাঝে মাঝে ভাবি যে কেন আওয়ামী লীগ হঠাৎ করে এই আন্দোলন নিয়ে ওঠেপরে লাগলো।
আওয়ামী লীগ যদি মনে করে যে এটি সফল হবে না, তাহলে চুপ করে থাকলেই হয়। আমার ব্যাখ্যা হলো, এই যে ভারতীয় পণ্য বর্জনের আন্দোলন শুরু হয়েছে, তার জন্য সারা দুনিয়াতে ভারতের ইমেজে আঘাত পড়েছে। ভারত তার কোনো প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখতে পারছে না। একমাত্র ভালো ছিলো আমাদের সঙ্গে। দেশের জনগণ এখন ভারতের পণ্য বর্জন করছে সেই খবর এখন সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ছে এবং সারা দুনিয়ায় ভারতের ইমেজ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এই ইমেজ রক্ষার জন্য তারা আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর চাপ দিচ্ছে। আওয়ামী লীগ নেতারা বলার চেষ্টা করছেন যে এই আন্দোলনটি আসলে জনগণের আন্দোলন নয়, এটি বিএনপির আন্দোলন এবং এই আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু এটি কখনোই বিএনপির আন্দোলন ছিলো না, এটি সাধারণ মানুষের আন্দোলন। বিএনপি সাধারণ মানুষের সেন্টিমেন্ট স্পর্শ করার চেষ্টা করেছে এবং তাদের মিছিলে যোগ দেওয়ার চেষ্টা করেছে।
পরিচিতি: সিনিয়র সাংবাদিক। ‘কথা’ ফেসবুক পেজের ভিডিও কনটেন্ট থেকে শ্রুতিলিখন করেছেন সঞ্জয় চন্দ্র দাস