ভারতীয় পণ্যই যদি বয়কট করবেন, তার বিপরীতে দেশী পণ্য লাগবে না?
ইমতিয়াজ মাহমুদ
[১] এ বয়কট বিষয়গুলো নিয়ে কিছু বলতে চাইনি। এসব তো একরকম ফালতু আলাপ। বলে কিনা ভারতীয় পণ্য বয়কট করতে হবে। আড়ং বয়কট করতে হবে। অনেকদিন আগে কারা যেন ফ্রান্সের পণ্য বয়কটের আহ্বান করেছিল। আমি তো খুঁজে পেতে ফরাসি পণ্য কীভাবে বয়কট করবো, সেটা বুঝতেই পারছিলাম না। ফরাসি লেখকদের কিছু বই আছে আমার কাছে, কিন্তু সেগুলো তো ইংরেজিতে অনুবাদ ছাপা হয়েছে ইংল্যান্ডে বা ভারতে বা অন্য কোথাও। সেগুলো কি ফরাসি পণ্য হিসেবে বিবেচিত হবে? ফরাসি মদ অতি উত্তম- ওয়াইন ইত্যাদি। সেগুলো তো দেশে যাও কিছু মিলে দাম একটু বেশি। এমনিই কিনতে পাই না, বয়কট করব কী। ভারতের পণ্য বয়কট করার তো প্রশ্নই আসে না। ভারতে প্রকাশিত বই কিনতে হয়। পেশাগত বই থেকে শুরু করে সকল সিরিয়াস বই তো আছেই, গল্প উপন্যাসও তো কিনি। কেন বয়কট করবো? বললেই হলো? আমি তো মনে মনে একটা খসড়া লিস্টি করেই রেখেছি ফেসবুকে তক্ষশীলার বিজ্ঞাপন দেখে দেখে একগাদা ইন্ডিয়ান বই, হাতে কিছু টাকা এলেই কিনতে যাবো। আমার কাপড় চোপড় তো বেশির ভাগই দেশি-বিদেশি স্নিকারস আছে বটে। কিন্তু ওই স্নিকারসগুলো ছাড়া আমার জুতাও দেশি।
পেশাগত পোশাক আর এক্সেসরিজ কিছু আছে বিলিতি। ভারতীয় নেই। আর ধর্মীয় নানা প্রকার বই আসে আমাদের দেশে ভারত থেকে। ভালো মান। আমার ব্যক্তিগত ব্যবহার্য জিনিসপত্র ভারতীয় না হলে আমার অসুবিধা নেই। কিন্তু যারা ভারতীয় শাড়ি বা অন্যান্য পোশাক পরতে চায় তাদের বাধা দেবেন কেন? এছাড়া পেঁয়াজ, আলু এবং নানা রকম খাদ্যদ্রব্য আমাদের কিনতে হয় ভারত থেকে। না, ভারত থেকে না কিনলে যে আমরা মরে যাবো সেরকম নিশ্চয়ই নয়। কিন্তু অন্যখান থেকে একই জিনিস কিনতে গেলে পণ্যের দাম বেশি হবে, খরচ বেশি হবে। এ বাড়তি খরচ আমি কেন করবো? কী যুক্তিতে? ভারতের মদ নাকি অনেক উন্নত হয়েছে এখন। কিন্তু ভারতীয় মদ তো আমাদের দেশে আমদানি হয় না। গরু আসতো আগে, আমরা গরুর মাংস খাই, এখন আসে কিনা জানি না।
[২] আর ভারতে যায় অনেক মানুষ। তারা কেন যাওয়া বন্ধ করবে? কেন? আমরা গাড়োয়াল হিমালয় বেড়াতে যাবো না? অলকানন্দা ও ভাগীরথী মিলনক্ষেত্র, দেবপ্রয়াগ রুদ্রপ্রয়াগ যাবো না? আমি তো অলকানন্দায় ভেসে ভেসে দেবপ্রয়াগে যেখানে ভাগীরথী আর অলকানন্দা মিশে গঙ্গা হয়েছে সেটা হয়ে হৃষীকেশ পর্যন্ত অভিযান করেছি। আমাদের তরুণরা যাবে না? পাহাড়ে মরুভূমিতে সমুদ্রে দিনের পর দিন ঘুরে বেড়াবে না? মানুষ চিকিৎসার জন্য যায়, কেনাকাটা করতে যায়, তীর্থ দর্শনে যায়Ñ আপনি তাদের কেন বাধা দেবেন? কী কারণে? শুধু সিনেমা দেখতে বয়া খেলাধুলা দেখতেও অনেকে যায়। যাবে। আপনি কেন বয়কট করবেন? না, সেরকম কোনো পরিস্থিতি হলে আমরা নিশ্চয়ই বয়কট করবো। কিন্তু সেরকম কোনো পরিস্থিতি তো সৃষ্টি হয়নি। না, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে নানারকম টানাপড়েন আছে। নদী আছে, সীমান্তহত্যা আছে, ট্রেড ব্যাল্যান্স আছে, এরকম নানা ইস্যু। পাশাপাশি দুইটা দেশের মধ্যে কোনো প্রকার বিবাদ সংবাদ থাকবে না এটা তো হয় না। এগুলো মীমাংসা করেন। সৎ প্রতিবেশী হিসাবে শান্তিপূর্ণভাবে এসব সমাধান করতে হবে। কিন্তু বাণিজ্য বন্ধ করবেন কেন? ও ভাই, পাকিস্তান যে মাঝে মাঝেই ইন্ডিয়ার সঙ্গে গোলাগুলো শুরু করে, তারাও তো ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য বন্ধ করে না। পুওওয়ামার পর নাকি স্থগিত হয়েছিল, এখন কী অবস্থা জানি না। তাহলে ভারতের পণ্য কেন বয়কট করবেন? আমাদের ইলেকশন নিয়ে তারা মাথা ঘামিয়েছে বলে? ভাইয়া, আমাদের ইলেকশন নিয়ে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা কে করেনি? সবাইকে বয়কট করবেন?আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আপনারা অনেকে তো স্পষ্ট করেই চেয়েছিলেন যে আমেরিকা যেন হস্তক্ষেপ করে। চাননি? এসব কারণে বয়কট হয়? তাও সে ইলেকশন হয়ে সরাকর প্রতিষ্ঠা হয়ে এতদিন কাজ করার পর? বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আপনাদের ব্যর্থতার জন্য আপনারা দেশের মানুষকে কষ্ট দেবেন কেন? ফট করে বলে দিলেন বয়কট, আর হয়ে গেলো বয়কট? দেখেন না বাজারে গিয়ে বয়কটের কি অবস্থা?
[৩] বাংলাদেশ ভারত অর্থনৈতিক সম্পর্কের পুরো হাল জানেন? আমাদের সঙ্গে তাদের ট্রেড ব্যাল্যান্স নেতিবাচক। অর্থাৎ আমরা কিনি বেশি বেচি কম। এর মধ্যে আবার কিছু পণ্য আছে যেগুলো আমাদের রপ্তানি পণ্য উৎপাদনের জন্য লাগে। সেগুলো যদি আমরা ইন্ডিয়া থেকে না এনে চীন থেকে সব আনতে পারব না, যেগুলো পারব সেগুলোও খরচ বেশি হবে। এমনিতেই চীন থেকে অনেক জিনিস আনতে হয়। বললেই হলো বয়কট? এরকম একটা সিরিয়াস প্রস্তাব এমনিই একজন দুজন লোক গায়ের চাদর পুড়িয়ে দিয়ে বলে দিল আর হয়ে যাবে? এজন্যই মানুষ আপানদের কথা শোনে না, আপনারা বলেন বয়কট, আর মানুষ আরও বেশি কিনে। শোনেন, সেরকম পরিস্থতি হলে আপনাকে বলতে হবে না বয়কটের কথা, মানুষ নিজেই বয়কট করবে। কিন্তু সেটার জন্য একটা কারণ লাগবে তো। সে ১৯৪৭ সাল থেকে শুরু করে আজকে পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে ভারতের যে সমীকরণ সেটাতে তো অভিনব কোনো বয়া নাটকীয় কোনো পরিবর্তন সম্প্রতি ঘটেনি যে আপনি হঠাৎ বয়কট বয়কট বলে চিল্লাবেন। ভারত বিরোধী রাজনৈতিক ফায়দা নিতে চান, সে তো জিয়াউর রহমান, এরশাদ, বেগম জিয়া সবাই নিয়েছে। কিন্তু তারা কেউ বয়কটের আহ্বান করেছে? করেনি। উল্টা বিএনপির সময় ব্যবসা বাণিজ্যে ভারত বেশি সুবিধা পেয়েছে। তাহলে এখন কীসের বয়কট? ফাজলামি পেয়েছেন। এসব বাদ দেন। যারা এখন বয়কটের পরামর্শ দিচ্ছেন তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকবেন। আমি তো দেখি তাদের মতলব ভালো না। মতলব ভালো হলে বলতেন যে দেশি পণ্য কিনুন, দেশি পণ্যের উৎপাদন বাড়ান, নিজস্ব শিল্পের বিকাশে সাহায্য করুন। লাক্স সাবানের কথা বলি। একসময় ভারতে গায়ে মাখার সাবান খুব ভালো ছিল না। বাংলাদেশ থেকে আমরা সঙ্গে লাক্স বা ইম্পেরিয়াল লেদার এসব সাবান নিয়ে গেলে লোকে খুশি হতো। রাজীব গান্ধীর লিবারাইজেশনের পর লিভার ব্রাদার্স ইন্ডিয়াতে লাক্স বানায় আরও উন্নত করে। বাংলাদেশেও এখন অনেক সাবান হয়। কিন্তু লাক্সের বাজারও রয়ে গেছে। এটা বয়কট বয়কট বলে পাল্টাতে পারবেন?
[৪] এখন আসেন আড়ং বয়কটের কথায়। একই লোককে দেখছি ভারতীয় পণ্য বয়কটের কথাও বলে, আবার বলে কিনা আড়ং বয়কট করতে হবে। ও ভাই, আমাকে একটু বুঝিয়ে বলেন, ভারতীয় পণ্যই যদি বয়কট করবেন, তার বিপরীতে দেশী পণ্য লাগবে না? আপনার তো বলার কথা আড়ংয়ের পণ্য বেশি করে কিনুন। নাকি? আড়ং হচ্ছে দেশি পণ্য। কেন আড়ং বয়কট করবেন? আমি আসলেই এখনো জানি না কে ডেকেছে এ আড়ং বয়কট বা কেন ডেকেছে? ফেসবুকে আমার ফ্রেন্ডলিস্টে আড়ং বয়কটকারী কেউ সম্ভবত নেই, এজন্য আমি আড়ং বয়কটের কোনো আহ্বান দেখিনি, বয়কট নিয়ে হাসাহাসি করতে দেখেছি। আড়ং বয়কটের আহ্বানটা ফালতু। এটা নিয়ে বিশেষ কিছু বলার নেই, ভারতীয় পণ্য বয়কটের ধারণাটাও ফালতু, তবে বিএনপির এতো বড় নেতা যেহেতু এটার সঙ্গে একমত করেছেন সেজন্য সেটা নিয়ে আলোচনা হয়। আড়ং বয়কটের ধারণাটাই ফালতু এবং হাস্যকর একটা ব্যাপার। ইগনোর করেন। লেখক: আইনজীবী। ৪-৪-২৪। ফেসবুক থেকে