পেঁয়াজ, তরমুজ, ইলিশ ও অর্থনীতির ফাঁকফোকর
কাকন রেজা
আমার এক বন্ধু সামাজিকমাধ্যমে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ে লিখতে গিয়ে লিখলেন, পহেলা বৈশাখে ইলিশ বয়কটের কথা। জানি না, আমার প্রিয় বন্ধু ইলিশ বয়কটের প্রশ্নে এর সাংস্কৃতিক দৌরাত্ম্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়ে লিখেছেন কিনা। একশ্রেণির কথিত মুক্তমনা, ধর্মনিরপেক্ষ মানুষের মন ও নিরপেক্ষতা থাকে পান্তা-ইলিশের সংস্কৃতি চর্চায়। এখানে দাম বাড়া নিয়ে কথা হয় না, বরং রমনার বটমূলকে ঘিরে সংস্কৃতির নামে রীতিমতো পান্তা-ইলিশসহ না-না কিছুর মচ্ছব চলে। এখানে বয়কটের আলাপ করতে গেলেই ঝামেলা লেগে যাবে। সাথে লেগে যাবে প্রতিক্রিয়াশীল তকমা।
লিখেছিলাম তরমুজ বয়কট সম্পর্কে। তরমুজ বয়কট করা সহজ। কারণ তরমুজের সিন্ডিকেটের সাথে চুনোপুটিরাও ঠিক না, দাড়কিনা টাইপ পাবলিক জড়িত। সুতরাং তরমুজের বয়কট করলে হামলা-মামলার মতন ঝামেলার ব্যাপার নেই, নিদেনপক্ষে লাঠিপেটা খাবারও সম্ভাবনা নেই। বরং এতে এক অর্থে অ্যাস্টাব্লিশমেন্টের উপকারই হয়। কারণ মানুষ ভাবে দাম বাড়ানোর কারসাজি সব ব্যবসায়ীদের, সুতরাং অ্যাস্টাব্লিশমেন্টের এখানে কোনো দায় নেই। তারা পুত-পবিত্র। গরুর গোশত বয়কটের আলাপও তাই। এসব মূলত ডাইভার্শন প্রসেস। দৃষ্টি সরানোর প্রচেষ্টা। আর আমাদের একদল তো আছেনই, ঢাকে বাড়ি পড়লেই নাচতে থাকেন। ঢাকের বাড়িতে মূল বয়কটের আলাপটা তাদের কানে পৌঁছায় না।
পেঁয়াজ নিয়ে কথা উঠেছিলো। কথা মূলত পেঁয়াজের উৎপাদন ও চাহিদা নিয়ে। অনেকেরই ধারণা আমাদের দেশে চাহিদার চেয়ে কম পেঁয়াজ উৎপাদন হয়। কেউ কেউ নানা তথ্য উপাত্তও হাজির করেন। এটা সেই ডাইভার্শন প্রসেস। চাহিদা-যোগানের সূত্র ধরে আমদানির ধান্ধা করা। অন্য দেশকে অযৌক্তিক সুবিধা পাইয়ে দেয়ার চেষ্টা। পেয়াজ উৎপাদন বিষয়ে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে বিবিসি’র সাথে সাক্ষাতকারে বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মসলা গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শৈলেন্দ্রনাথ মজুমদার বলেছিলেন, বাংলাদেশের বার্ষিক পেঁয়াজের চাহিদা ২৭-২৮ লাখ টন, যার পুরোটাই বাংলাদেশের দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজ দিয়ে পূরণ করা সম্ভব’। তিনি সাথে যোগ করেছিলেন, ‘বছর জুড়ে পেঁয়াজের দাম নির্ধারণ করে দেয়া হলে কৃষক সঠিক দাম পাওয়ার নিশ্চয়তা পাবে। আর তাহলে বাংলাদেশেই বছরে ৩৫ থেকে ৪০ লাখ টন পেঁয়াজ উৎপাদন করা সম্ভব হবে’।
অর্থাৎ মূল সমস্যা কৃষক, ব্যবসায়ী কিংবা মধ্যস্বত্বভোগী ফড়িয়া নয়, মূল সমস্যা হলো ব্যবস্থাপনায়। যেমন তরমুজ বয়কটের ফলে উৎপাদনকারী কৃষকের কোনো লাভ হয়নি, কৃষকরা দাম বেশি পায়নি। লাভ হয়েছে ভোক্তাদের। শুধুমাত্র ভোক্তাদের লাভ হলে এবং উৎপাদনকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হলে বিষয়টি একসময় বুমেরাং হয়ে দাঁড়াবে। কৃষকরা তরমুজ চাষ কমিয়ে দেবে, তখন এমনিতেই দাম বেড়ে যাবে এবং সে সময় বয়কট অব্যাহত রাখলে দেশের গ্রামীণ অর্থনীতি, যা মূল অর্থনীতির ভিত, তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সুতরাং তরমুজ বয়কটের আগে ব্যবস্থাপনার ফুঁটো বন্ধ করার আলাপ তোলাটা জরুরি।
আবার পেঁয়াজের কথায় ফিরি, ২০২৪ এর ফেব্রুয়ারিতে সময় টেলিভিশনের অনলাইন খবর করলো, ‘চাহিদার চেয়ে বেশি উৎপাদনের পরও অস্থির কেন পেঁয়াজের বাজার?’- এমন শিরোনামে। খবরের প্রথমেই তারা বললো, চীন ও ভারতের পরই বাংলাদেশ বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম পেঁয়াজ উৎপাদনকারী দেশ। কিন্তু তৃতীয় বৃহত্তম উৎপাদনকারী হওয়া সত্ত্বেও আমদানিতে শীর্ষে! অদ্ভুত না? সময় অনলাইন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বরাতে আরো বলছে, ঘাটতি নয় বরং দেশে চাহিদার চেয়ে বাড়তি উৎপাদন হচ্ছে পেঁয়াজ। ২০২২-২৩ সালে দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজের পরিমাণ ৩৪ লাখ মেট্রিক টন। চাহিদা ছিলো ২৮ থেকে ৩০ লাখ মেট্রিক টন। তাহলে শুভঙ্করের ফাঁকিটা কোন জায়গায়? কেন পেঁয়াজ আমদানি না করলেই পেঁয়াজের বাজার অস্থির হয়ে ওঠে? এই প্রশ্নের উত্তর রয়েছে ড. শৈলেন্দ্রনাথ মজুমদারের কথায়। তিনি বলছেন পেঁয়াজের দাম নির্ধারণ করে দেয়ার কথা। ইঙ্গিত মূলত ব্যবস্থার দিকে।
এই ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছে অ্যাস্টাব্লিশমেন্ট। ব্যবস্থাপনায় ফাঁক-ফোকর থাকায় ঝামেলটা বাঁধে এবং বেঁধেছে। আমরা আমাদের চাহিদার চেয়ে বেশি পেঁয়াজ উৎপাদন করি, অথচ আমাদের উপর ছড়ি ঘোরায় ভারত। তারা রপ্তানি বন্ধ করার কথা তুললেই আমাদের পেঁয়াজের বাজার অস্থির হয়ে ওঠে, দাম বেড়ে যায়। আমাদের ব্যবস্থাপনার ফোকর গলেই ভারত এই কাণ্ডটি ঘটায়। সবক্ষেত্রেই তাই। ভারতের ফোপর-ফাপর সব ব্যবস্থাপনার ফাঁক-ফোকর গলেই। শুরুতে বন্ধুর কথা বলেছিলাম। তার কথাতেই আসি। ইলিশ বয়কট করলে আমাদের হয়তো ক্ষতি হবে না, কিন্তু লাভ হবে ওপারের দাদাদের। আমাদের দেশে বিক্রি হচ্ছে না, সুতরাং রপ্তানি করো। পাঠাও দাদাদের কাছে। দাদারা মোটামুটি কমদামে ইলিশ পাবেন। মন্দ কি, উনারা তো এমনিতেই সব সুবিধা নিচ্ছেন। লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট